
নতুন বছরের, প্রথম দিনেই যদি অর্থ যোগের সম্ভাবনা থাকে তাহলে মন ফরিঙ তো উড়ে ফুড়ুৎ- ফারুত। আগের পনেরদিন থেকেই রাশি ফল দেখছি। বৃশ্চিক এর অর্থ যোগের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। অন্য ব্যাপারে যেমনই কাটুক আমার মতো হাত খোলা মানুষের অর্থ যোগ হলো আগামীর ভালোর আভাস।
ভাবছিলাম, কিভাবে অর্থ যোগ হতে পারে? ঠিক শেষ দিনই সম্ভাবনার ফোন এলো। যেতে হবে ভূরুঙ্গামারী। বেশ দুর, কুড়িগ্রাম থেকে ষাট কিলোমিটার হবে। তবুও মনের মতো সঙ্গী আর অর্থ যোগ বলে কথা! কষ্ট সেখানে কোন বিষয় না।
ফজরের নামাজের পর সকালের মিষ্টি হাওয়া নিতে দরজা খুললাম। ওরে বাবা, কুয়াশায় কিছু তো দেখা যায়না। শীতের নাকি বাপ-মা নাই। তাই শীতের শিক্ষা দেবারও কেউ নাই। গরীব এলাকায় বেশি ছোবল মারে। কিংবা হয়তো এটাই তার নতুন বছরের শুভাগমন।
তবুও ’কুচ পরোয়া নেহি, পায়সা কি বাত হ্যায়,,,সেটা ভেতর ভেতর বেশ অনুভব করছি। দুটো দেশী মুরগীর ডিম সেদ্ধ আর পোড়া কফিতে মুখ তেতো করে বেরিয়ে পড়লাম।রেজওয়ানা কবিরকে স্ট্যান্ডে মিট করবো।
ও বাবা, বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি রেজওয়ানা কবির নীল কাতানে একেবারে বাম্পার ফলন দিচ্ছেন। পাতলা চাদর খানা ডানপাশ দিয়ে প্রেমিকের মতো ফেলে দিয়ে, আমার অপেক্ষা করছেন। আমার কাছে নতুন পুরোনো বছর বলে কিছু নেই, আমি সেই চিরাচরিত বেশভূষায়। অতি শীতের গরম লং সোয়েটার পরে তার শাড়ীর সাথে কেমন যেন বেমানান হয়ে গেলাম। শাড়িতেই নারী কিন্তু এই শীতে? আমার দ্বারা সম্ভব না।
আজ ভূরুঙ্গামারী রোডে গাড়ি বন্ধ। কুড়িগ্রাম থেকে ভূরুঙ্গামারী পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের কাজ চলছে প্রায় বছর খানেক থেকে। তখন থেকেই এ এলাকায় যাতায়াত খুবই কষ্টদায়ক। তার উপর যদি বাস বন্ধ থাকে তাহলে তো রীতিমতো বিপদ!
ঢাকা কোচ গুলো আটটার মধ্যেই চলে যায়। এখন সোয়া আটটা বাজে। শেষের দুচারটে অচল কোচ আসে, তার মধ্যে একটা পাওয়া গেল।
গাড়িতে উঠে আমি বেহাল। প্রায় প্রতিটি সিটে বমি, পাশে পলিথিনে বমি। নাভিশ্বাস অবস্থা। দাঁড়িয়েই থাকবো ভাবছি, চোখ গেল সামনের দিকে এক হেলমেট হাতে ভাই সিটে বসে আছেন। বাসে বসেছেন, হাতে হেলমেট বুঝলাম না।
রেজওয়ানা অতি বিনয়ের সাথে বললেন, ভাইয়া যদি একটু চাপতেন। আমরা একসিটেই দুজন এডজাষ্ট করতাম। পেছনের গুলোতে অনেক বমি।
তিনি বুক ফুলিয়ে উত্তর দিলেন, দেখছেন না অন্যসিটে আমার হেলমেট রাখা আছে। এবং হেলমেটটি পাশের সীটে হাত থেকে রাখলেন।
পরে জানা গেলো, তিনি গাড়ির লোকের আত্নীয়। শুনেছি চাকরি- বাকরীতে আত্নীয়ের পোদ্দারী চলে। এখন দেখছি গাড়িতেও চলে।
বাধ্য হয়ে দুবোন ইন্জিন কভারে এডজাষ্ট করলাম। গরমের দিন হলে তো পাছু মিয়া গরমে সেদ্ধ হতো। আজ তার বদলে পাছু মিয়া ঠান্ডায় যে কাহিল হয়ে ছিলো, তার উপকার হলে। কিছুক্ষনের মধ্যেই পাছু মিয়া আরাম বোধ করতে লাগল।
আমার শাড়ি ম্যাডাম বলেই ফেললেন, যাক আরাম হলো। বোঝেন, তার অবস্থা। শীতে পাছু মিয়া জমে বরফ হোক, তবুও ফ্যাশান ছাড়া যাবে না!
কলেজের দোতলার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে রোদ পোহাচ্ছি। রেজওয়ানা কবির ওয়াশরুমে। দুজন ছাত্রী গটগট করে নেমে এলো। আশেপাশে কাউকে না পেয়ে আমার কাছে জানতে চাইলো। উপরে কোন স্যার- ম্যাম নেই। আজ কি ফাস্টইয়ারের ক্লাস হবে?
আমিও দুখ্খভরাক্রান্ত হয়ে জবাব দিলাম, এই শীতে আমিও অনেক কষ্টে এসে কোন স্যার- ম্যাম না পেয়ে দাড়িয়ে আছি। মনে হয় আজ আর ক্লাস হবে না।
রেজওয়ানা এ কথা শুনে মহাবিরক্ত! শাড়ি না পরে জিন্স পরো? স্টুডেন্ট তো ভাববেই? তোমারই রাজ্যের শীত। কথা ঠিক, আমার খুব শীত।
ভিজিট, মিটিং, ভালোমন্দ খাবার তার উপর পকেটও গরম। বেশ একটা ভালো দিন কাটিয়ে, বিকেলে বাসস্ট্যান্ডে এলাম। ফেরার সময় তো আর কোচ নেই। একটা লোকাল বাস এসে দাঁড়ালো। রেজওয়ানা বললো, দেখছো বাস খুলে গেছে। চলো টিকিট নেই। টিকিট কেটে আধা ঘন্টা বাসে বসে। বাসের লোক শুধু চিৎকার করছে। তখনও বাসে মাত্র আটজন প্যাসেন্জার।
জানা গেলো, লোক ভর্তি হলে তবেই এ গাড়ি ছাড়বে। তার আগে নয়। মহা বিপদ! সামনে একটা জে, এস গাড়ি দাঁড়িয়ে। এগুলোতে তারাতারী আসা যাবে। তাই টিকিটের টাকা ফেরত চাইলাম। ভাই, তোমার অনেক দেরী টাকা দাও আমরা অটোতে যাবো।
এতদুর অটোতে যাবেন? মাথা খারাপ!
রেজওয়ানা চট করে বললো, না আমরা অতো বোকা না। ওই যে দেখছেন, জে, এস দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ওটাতে যাবো!
বরাবর রেজওয়ানা আমার চেয়ে বেশি ইন্টেলিজেন্ট। আজ সে একটা বোকামী করে ফেললো। তার এটা বলা ঠিক হয়নি। কারন এখানে জে, এস লোক নিতে পারে না।
গাড়ির লোকজন ভীষন হিংসুটে হয়। সে গিয়ে জে, এস অলাকে অকথ্য গালিগালাজ শুরু করলো। বেচারা জে, এস ড্রাইভার ভয়ে আটজন লোকের বদলে চারজন নিয়েই গাড়ি স্টার্ট দিল।
মহা বিপদ! গাড়িতে তো আর আমাদের নেবে না। রেজওয়ানা রাগে গরগরাচ্ছে। তাৎক্ষনিক বুদ্ধি হাজির! অটো রিকশায় উঠে তাকে টানতে বললাম। পেছন থেকে জে, এস কে ইশারা করলাম সে যেন দাঁড়ায়। অবশেষে আমরা জে, এস, ধরতে পারলাম।
সমস্যা হলো, পেছনের বাসটিও ততোক্ষন ছেড়ে দিয়েছে। আর তার ভয়ে জে, এস জান- জীবন ছেড়ে দিয়ে তার গাড়ি টানছে। সামনের সিটে বসা একজন সহকারী অধ্যাপক আর দুজন ছাত্র। তারা পরীক্ষা দিয়ে ফিরছে। তারাও নাকি ওই গাড়িতেই উঠেছিল।
এসময় আমাদের সাথে বসা একজনের ফোন এলো। ফোনে তার বহুত টেনশানের আলাপচারিতা চলছে। সম্ভবত, তিনি খুনের আসামী, পরের দিন ওয়ারেন্ট্র হবে তাই তিনি পালাচ্ছেন। বেচারার কপাল খারাপ, বাসের বদলে জে, এস গাড়িতে পালাতে হচ্ছে।
তবুও ভাগ্য ভালো, গাড়ি চলছে খুব জোরে। রাস্তা উঁচু- নিচু। আর ভেতরে এতো কম জায়গা যে, পা রাখলে হাত রাখার জায়গা নেই। আর মাথার উপর মাত্র আঙ্গুল তিনেক ফাঁকা মোটা মোটা রডের ছাউনি।
এক ঝাঁকুনিতে আমি মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেলাম। রেজওয়ানা তা দেখে মাথা খানিকটা নিচু করে বসলো।এবার আর এক ঝাকুনিতে সে চোট পেলো, থুতনিতে। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার মাথা আর তার থুতনি ফুলে গেলো।
পাশের খুনি আসামী তখন বলছে, আরে কিসের ধরা দেয়! প্রয়োজনে আরও একটা খুন করবো!
আমরা আরও জড়োসরো। তার হুমকি জনিত ঘুন- খারাপির কথায় ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছি। এক ঝাকুনিতে তার ফোন কান থেকে পড়ে গেল। যাক বাঁচা গেল!
আমি এবার তাকে সাহস করে বলেই ফেললাম, ভাই কি বউ খুন করে পালাচ্ছেন?
সে বললো, মেয়েমানুষ যতো নষ্টের গোঁড়া।
কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, রেজওয়ানা আমায় গুতা মারল। যার মানে, চুপ থাকো। বোকার মতো আচরণ করো না। বরাবরই আমার বোকামীতে আমায় শাসনই করে।
পেছনের চারজনের খুনি ভাইয়ের পাশেই আবার উকিল মহোদয় বসা। তিনি সামান্য আগ্রহ দেখিয়ে জানালেন, তিনি একজন শিক্ষানবীশ উকিল। যদি খুনি ভাইয়ের কোন উপকারে আসতে পারেন। কিন্তু খুনী ভাই উকিলের কোন প্রশ্নের উত্তরই দিলেন না। চোখ লাল করে বসে আছেন।
ষাট কিলো রাস্তা এভাবে পার হলো। আমার বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা। এক ঝুকি চীনা কমলা নিয়ে খুশি মনে বাসায় ফিরে নতুন ধাক্কা খেলাম।
মা পড়ে গিয়ে হাত কেটে রক্তারক্তি অবস্থা। আমাকে ফোন দেয়নি, টেনশান করবো। আর মা বলছিলো, এতটুকু সেরে যাবে তারাতারী। আমার টেনশান করার দরকার নেই।
জীবন এমনই, শুরু না হতেই শেষ হয়ে যায়। বিরহ, বেদনা, দুখ্খ, যন্ত্রনারা সাথে সাথেই থাকে। করোনা আবার অগ্রগামী হতে যাচ্ছে। পাশে পাশে নিয়েই তবুও আমরা স্বপ্ন দেখছি নতুনের, নবউদ্দোমের!
ছবি- নেটের
৮টি মন্তব্য
আলমগীর সরকার লিটন
জি রুকু আপু সুন্দর লেখেছেন- শুভ বর্ষ শুভেচ্ছা রইল আশা করি সব সময় ভাল থাকবেন—————-
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ লিটন ভাই।
খাদিজাতুল কুবরা
তোমার এ ব্যপারটি আমার ভালো লাগে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সেটি আবার রসিয়ে কষিয়ে গল্প বুনে ফেলতে পার।
কলম চলুক দিনভর।
ভালো থেকো বন্ধু
রোকসানা খন্দকার রুকু
একটা কষ্টের দিন গেছে তবে অনেক হেসেছি। জানিনা এই শীতে খুনি ভাইয়ের কি হাল। মেয়েমানুষ ছাড়া পুরুষরা এক পাও চলতে পারে না আবার মেয়েরাই নষ্টের গোঁড়া। এটা অবাক লাগে। ভালো থেক।
বোরহানুল ইসলাম লিটন
চলাচলে সবত্রই বিপদ
বিশেষ করে বাস সার্ভিসে!
মানুষ আজব নিয়ম কানুনও!
তার উপর খুনি ভাই সামনে থাকলে তো শীতও হার মানে।
আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানবেন সতত।
রোকসানা খন্দকার রুকু
জী ভাই। ধন্যবাদ।
হালিমা আক্তার
যাত্রা পথের চমৎকার পর্যালোচনা। দুরের বাস জার্নির কথা শুনলেই গায়ে জ্বর এসে পড়ে। তবুও প্রয়োজনে চলতে হয়। শুভ কামনা রইলো আপা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
অশেষ কৃতজ্ঞতা ও শুভকামনা নতুন বছরের। ভালো থাকবেন।।