আমরা জানি জীবনানন্দ যুক্তাক্ষরকে উচ্চারণে অনুচ্চ করে দিতেন। কিন্তু এখানে বি-শী-র্ণ’র অনুচ্চ অথচ বিলম্বিত স্টোকাটোই ‘এই বাংলার মাঠে’ থামিয়ে দেয় নি বরং পর্বাঙ্গগুলোকে মসৃণ প্রবহমানতায় ভাসিয়ে নিয়েছে। পাখি নীড় থেকে বেরিয়েই ত্বরিত ঘরে ফেরে নি। এই হচ্ছে জীবনানন্দীয় ধ্বনির বুনোহংসীর অনব্যাহত সঞ্চালন।
জীবনানন্দীয় প্রবহমানতার আরো কিছু নমুনা:
পুরোনো ক্ষেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার;
পৃথিবীর পথে গিয়ে কাজ নাই-কোন কৃষকের মত দরকার নাই দূরে
মাঠে গিয়ে আর!
রোধ-অবরোধ-ক্লেশ-কোলাহল শুনিবার নাহিকো সময়,
[অবসরের গান (ধূসর পাণ্ডুলিপি)]
বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়
পিপাসার সান্তনায়-আঘ্রাণে-আস্বাদে!
কোথাও বাঘের পাড়া বনে আজ নাই আর যেন!
মৃগদের বুকে আজ কোন স্পষ্ট ভয় নাই,
সন্দেহের আবছায়া নাই কিছু;
কেবল পিপাসা আছে,
রোমহর্ষ আছে।
মৃগীর মুখের রূপে হয়তো চিতারও বুকে জেগেছে বিস্ময়!
লালসা-আকাক্সক্ষা-সাধ-প্রেম-স্বপ্ন স্ফুট হয়ে উঠিতেছে সব দিকে
আজ এই বসন্তের রাতে;
এইখানে আমার নক্টার্ন-।
[ক্যাম্পে (ধূসর পাণ্ডুলিপি)]
তারি পাশে তোমারো রুধির কোন বই-কোন প্রদীপের মত আর নয়,
হয়তো শঙ্খের মত সমুদ্রের পিতা হ’য়ে সৈকতের প’রে
সে-ও সুর আপনার প্রতিভায়-নিসর্গের মত:
রূঢ়-প্রিয়-প্রিয়তম চেতনার মত তারপরে
তাই আমি ভীষণ ভিড়ের ক্ষোভে বিস্তীর্ণ হাওয়ার স্বাদ পাই;
না হলে মনের বনে হরিণীকে জড়ায় ময়াল:
[তার স্থির প্রেমিকের নিকট (বেলা অবেলা কালবেলা)]
২.১ বাকস্পন্দ ও পুনরাবৃত্তি
ধ্রুপদী কবিরা জনপদের কথ্য ভাষা থেকে যতোটা সম্ভব দূরে গিয়ে সংস্কৃত কবিতার দেব ভাষা তৈরি করেছিলেন। অতঃপর রোমান্টিকদের উদ্দেশ্য হলো, কবিতার ভাষাকে কথ্য ভাষার সক্রিয়তা এবং সজীবতা প্রদান করা। মধুসূদনী মহাকাব্য থেকে রাবীন্দ্রিক ক্ষণিকা, এই অগ্রসরের বাস্তবিক দলিল। কিন্তু নেহাতই লোকায়ত ভাষা, এমনকি গদ্য কবিতাতেও আধুনিকতার পূর্ণাঙ্গতা আসতে নাও পারে। বরঞ্চ কবিতা তখনই যুগোপযোগী, হয়তো যুগোত্তীর্ণ বক্তব্য ও পেশি ধারণ করতে পারে যখন কবিতা তার যুগবাহিত সুরের মধ্যে বাকস্পন্দ ধারণ করতে পারে। ‘প্রাত্যহিক বাচনের শব্দভঙ্গি, স্বরভঙ্গি আর শ্বাসক্ষেপণ ভঙ্গিই’ কবিতাকে দিতে পারে নাট্যপ্রাণ বেগ আরূঢ় নিয়মানুবর্তিতা ভেঙে-ভাবনাতেও এবং সুরে-শ্রুতিকল্পে। হয়তো আমাদের অতি-পরিচিত, তবুও পুনরুদ্ধার করা যাক সেইসব বাকস্পন্দ:
হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?
বাল্টিতে টানিনি কি জল?
কাস্তে হাতে কতবার যাইনি কি মাঠে?
মেছোদের মত আমি কত নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি;
[বোধ (ধূসর পাণ্ডুলিপি)]
অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালী ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচা এসে
বলেনি কি : ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
চমৎকার!-
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার।’
[আট বছর আগের একদিন (মহাপৃথিবী)]
উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলোর মধ্যে প্রশ্নের ছড়াছড়ি আর সেগুলোতে কথ্য সংলাপের সান্নিধ্য। এবং ঐসব সম্ভাষণের মধ্যেই ধ্বনির বিশিষ্টতা যা বড় একটা স্তবকের বুনোটের মধ্যে শ্রুতির বিভিন্ন আঙ্গিকে বিকশিত হয়ে উঠছে।
শব্দ অথবা শব্দগুচ্ছের পুনশ্চতাও তেমনি নতুন ধ্বনি এবং সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনির তীব্রতাকে তুঙ্গ করে তুলতে সক্ষম। এলিয়ট লক্ষ্য করেছিলেন এই ধ্বনির পুনরাবৃত্তির ব্যবহারের বিষয়-সঙ্গীতে এবং কবিতায়। জীবনানন্দের কবিতা স্বরণ করা যাক:
কাল কারা অতিদূর আকাশের সীমানার কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে করে
কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন-
মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য?
জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য?
প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য?
[হাওয়ার রাত (বনলতা সেন)]
সিংহ হুংকার করে উঠছে:
সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,
স্থবির সিংহ এক-আফিমের সিংহ-অন্ধ-অন্ধকার।
… … …
সিংহ অরণ্যকে পাবে না আর
পাবে না আর
পাবে না আর
কোকিলের গান
বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খ’সে-খ’সে
চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।
[শীত রাত (মহাপৃথিবী)]
অবাক হ’য়ে ভাবি, আজ রাতে কোথায় তুমি?
রূপ কেন নির্জন দেবদারু-দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়া চেনে না-
পৃথিবীর সেই মানুষীর রূপ?
স্থুল হাতে ব্যবহৃত হ’য়ে-ব্যবহৃত-ব্যবহৃত-ব্যবহৃত হ’য়ে
ব্যবহৃত-ব্যবহৃত-
আগুন বাতাস জল: আদিম দেবতারা হো-হো ক’রে হেসে উঠলো:
‘ব্যবহৃত-ব্যবহৃত-হ’য়ে শুয়ারের মাংস হ’য়ে যায়?’
হো-হো ক’রে হেসে উঠলাম আমি!’
[আদিম দেবতারা (মহাপৃথিবী)]
হাওয়ার রাত এবং শীতরাত, দুটোই গদ্য কবিতা। প্রথমটিতে ‘করবার জন্য’, ‘তুলবার জন্য’ পুর্নব্যবহৃত হয়ে জীবনের জয়কে আবেগতীব্র করে তুলেছে ধ্বনি-প্রতিধ্বনির সহায়তায়। শীতরাত-এর স্তবকটিতে শ্রুতিকল্পের সংবদ্ধতা আরো গাঢ়। ‘ব্যথিত সিংহ’ ‘স্থবির সিংহ’, ‘আফিমের সিংহ’-এই পুনশ্চতার পরে ‘অন্ধকার’, ‘পাবে না আর’, ‘পাবে না আর’, ‘পাবে না আর’, ব্যবহারের বেগ এবং স্রোত সমন্বিত হয়ে কতোগুলো যুগ্ম শব্দের ধাক্কা পেরিয়ে ‘চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ’, এই স্টোকাটোতে এসে স্তব্ধ হচ্ছে। স্তবকটির ধ্বনির প্রবাহ সেকেলে স্তবকের আদলের মোটেই নয়। গদ্য কবিতা, তবুও তা বিলম্বিত খেয়ালের (বিস্তারের) মতো ধ্বনির বিচিত্রতা, স্বরের উত্থান-পতনের পর অত্যন্ত আনোখাভাবে সমে ফিরেছে।
আদিম দেবতারা কবিতাটিতে ‘ব্যবহৃত’ শব্দের অব্যর্থ অলৌকিক ব্যবহার একমাত্র রাজা কবিদের হাতেই সম্ভব। ‘ব্যবহৃত’ শব্দের পৌনঃপুনিক এবং বিচিত্র সন্নিবেশে জীবনানন্দ এই শব্দটির মধ্যে এর নিজস্ব অর্থের বহুগুণ অর্থ নিবিষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন। ‘কোথায় তুমি’র বাকস্পন্দ, ‘ব্যবহৃত’র পুনরাবৃত্তি, ‘হ’-ধ্বনির অনুপ্রাস-এসব মিলে শ্রুতিকল্প; ‘দেবদারু-দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়া’র চিত্রকল্প; ‘আগুন বাতাস জল: আদিম দেবতাদের অতীতমুখী অনুষঙ্গ; দেবতাদের এবং উত্তম পুরুষের হো-হো করে হেসে উঠবার ধ্বনি-প্রতিধ্বনিবিজড়িত দৃশ্য-এসব মিলে এই স্তবকটি রাজা কবিদেরও ঈর্ষণীয়রূপে চূড়ান্ত সার্থকতা লাভ করেছে। কোনো ছন্দোবদ্ধ কবিতায় এই সার্থকতা আনা প্রায় দুরূহ। জীবনানন্দীয় শ্রুতিকল্প ব্যবহার বিনা এ ধরনের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি প্রায় অসাধ্য।
(…………………………………………………………………………………………..চলবে)
আগের পর্বগুলোর লিংক:
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (১) http://sonelablog.com/archives/23872
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (২) http://sonelablog.com/archives/23989
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (৩) http://sonelablog.com/archives/24057
১০টি মন্তব্য
মামুন
খুব সুন্দর বিশ্লেষণ!
ভালো লাগা রেখে গেলাম। -{@
সাতকাহন
ধন্যবাদ, মামুন।
জিসান শা ইকরাম
খুব সহজ করেই বিশ্লেষন করছেন।
কঠিন হলে বুঝতে কষ্ট হতো।
লিংক দেয়ার বেলায় শুধু পুর্বের পর্বের লিংক দিন
তাতেই ধারাবাহিকতা থাকবে।
নইলে তো এক সময় লিংকে পুর্ন হয়ে যাবে পোষ্ট।
শুভ কামনা।
সাতকাহন
ধন্যবাদ জিসান ভাই।
মেহেরী তাজ
কঠিন মনে হয়। আরো পড়তে হবে।
সাতকাহন
কবিতার বিশ্লেষণ এর থেকে সহজ কোথাও আছে?
মোঃ মজিবর রহমান
আপনাদের অনেক ধ্যান সাধনা
স্বারথক বিশ্লেষণে অনেক বুঝলাম।
অনেক অনেক ধন্যবাদ সহজ করে বঝানর জন্য।
সাতকাহন
মজিবর রহমান ভাই, অসংখ্য ধন্যবাদ।
নুসরাত মৌরিন
জীবনানন্দের কবিতা গুলো এমন যে তা শুধু পড়ে যেতেই ভাল লাগে।এতকাল শুধু পড়ে গেছি।
আপনার বিশ্লেষন কবিতার বাঁকে বাঁকে,পদে পদে লুকিয়ে থাকা কত অজানা রহস্যের উন্মোচন করছে!!
এই পর্বটা বেশি ভাল লাগলো।
সাতকাহন
ধন্যবাদ, নুসরাত মৌরিন। সাথে থাকবেন।