কুড়ি দশকের কবিতার চলনের পটভূমিতে মাত্রাবৃত্তের কিছু কৈশোরিক চর্চা করলেও উল্লিখিত ঐ এগারো বছরের অনুশীলন ও রচনার মধ্যে জীবনানন্দ বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর মনের স্বাভাবিক সুর বিলম্বিত অক্ষরবৃত্তের উত্থান-পতনে নয় বরং ধীরে নুয়ে পড়ে পাথর এড়িয়ে জলের মতো ঘুরে ঘুরে। কেউ কেউ ইশারা দিয়েছেন যে এই ধ্বনির পূর্বসূত্র রবীন্দ্রনাথের কৈশোরিক রচনা তারকার আত্মহত্যা (সন্ধ্যাসঙ্গীত) কবিতায় নিহিত।

এ পুনরুদ্ধারের সায় আমার কানে বাজে না বরং এটাই বোধহয় অধিকতর সত্য যে, জীবনানন্দের মনের স্বাভাবিক মন্থরতার সুর যৌবনের ইয়েটসের কবিতার মেজাজ ও শ্রুতির সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছিলো। The Falling of the leaves, Ephemera, Down by the Salley Gardens (Crossways, 1889); The White Birds,(The Rose, 1893); The Lover Tells of the Rose in His Heart, He Reproves the Curlew, The Valley of the Blank Pig (The Wind Among the Reeds)-ইয়েটসের এই কবিতাগুলোয় জীবননান্দীয় বিলম্বিত সুরের ইংরেজি রূপ শোনা যায়। ইংরেজি উচ্চারণ অবশ্য ফরাসি বা ফারসি ভাষার স্বরবর্ণবাহিত টানা সুর মেনে চলে না বরং স্বর প্রক্ষেপনের ধাক্কায় গড়িয়ে চলে। এই ‘স্টোকাটো’ প্রক্ষেপের চলন এবং বৈচিত্র্য পাওয়া যাবে এলিয়টের কবিতায়।

তুলনামূলকভাবে উনিশ শতকের শেষ দশকের ইয়েটসের কবিতার (অন্তত উল্লেখিতগুলোর) ধ্বনি অনেক ঢিলে। জীবনানন্দ কি মনে মনে আরো ঢিলে করে পড়েছিলেন এ কবিতাগুলো; এই কবিতার বাক্যগুলোর ভিতরে ড্যাশ ভরে ভরে? বুঝেছিলেন বাঙলা কবিতায় এই সুর, আরো বিলম্বিত সুর ব্যবহারের সম্ভাবনা এবং প্রতিশ্রুতি? ইঁদুর, চাঁদ, হেমন্ত, ঘোড়া, চিল, শিশির, বুনোহাঁস, ঝরাপাতা-জীবনানন্দের বহুল ব্যবহৃত এইসব উপকরণও লক্ষ করা যাবে ইয়েটসের কবিতায়। অবশ্য এ তাঁর নিতান্ত পাঠজনিত উপলব্ধি নয়।

বরিশালের শহরপ্রান্তের বাইরে কুড়ি দশকে তিনি এইসব দেখেছিলেন, শুনেছিলেন, ছুঁয়েছিলেন, ঘ্রাণ নিয়েছিলেন। জীবনানন্দ অনুভব করেছিলেন, আবিষ্কার করেছিলেন কথ্য ভাষাকে কীভাবে ব্যবহার করলে, তৎসম শব্দের উচ্চারণ কীভাবে বিশ্লিষ্ট করলে বাঙলা উচ্চারণে ইয়েটসীয় আইরিশ কবিতা-সুর মেকন করে আরো গভীর, প্রগাঢ় ও মর্মভেদী হয়ে ওঠে। হৃদয়স্পর্শী হয়ে ওঠে স্মৃতি এবং প্রকৃতিসম্পৃক্ত বিষয় কবিতায় উদ্ভাসিত করতে গেলে। কোন সম্ভাবনাকে লক্ষ্য করে কী কী উপকরণের সাহায্যে জীবনানন্দ তাঁর ধ্বনি-চারিত্র্য তৈরি করলেন, বিষয় এবং ধ্বনির আবেগকে অঙ্গাঙ্গি পরিপূরক হিসেবে মিলিয়ে দিলেন-এইসব পর্যবেক্ষণে আমি হাত দেবো। তার পূর্বে শুধু কবিতার ধ্বনি বিষয়ে অল্প ঐতিহাসিক তথ্য স্মরণ করা যাক।

১.   

ক্লেদজ কুসুম-এর দ্বিতীয় ভূমিকায়, ১৮৬১ সালে, বোঁদলেয়ার সঙ্গীতের সঙ্গে কবিতার ছন্দের, বড় অর্থে শ্রুতিকল্পের আত্মীয়তার কথা বললেন। এবং উল্লেখ করলেন এ নিবিড় বন্ধনের যোগ্য ব্যবহার পাঠকের জন্য ক্লাসিক্যাল কবিতা যতোটা সংবেদন জাগাতে পারে তার চেয়ে অনেক বেশি হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করাতে সক্ষম। কবিতার চরণ একটি সমান্তরাল রেখার মতো, একটি ঊর্ধ্বমুখী কিংবা নিম্নগামী রেখার সমধর্মী হতে পারে (এই ব্যাপারগুলো সঙ্গত কিংবা গণিত বিজ্ঞানের মতো); নিশ্বাস না নিয়ে স্বর্গে উঠতে পারে অথবা যেকোনো ভাব অবলম্বন করে নরকে নামতে পারে; একটি স্পাইর‌্যালের অনুগামী হতে পারে, প্যারাবোলা হতে পারে অথবা আঁকাবাঁকা কতোগুলো কৌণিক খণ্ডনের মতো হতে পারে।এখানে বোঁদলেয়ার আমাদের জানাচ্ছেন কবিতার ধ্বনির প্রবাহ ও বিচিত্রতা কবিতার বিষয়ভাবকে কী ভাবে প্রগাঢ় করতে পারে, কতো বিশদভাবে প্রকাশ করতে পারে।

স্তেফান মালার্মে বোঁদলেয়ারের ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে কবিতায় ধ্বনিকে সঙ্গীতের মর্যাদা দিতে উদ্যত হলেন। কবিতার শব্দকে সম্পৃক্ত করতে চাইলেন সাঙ্গীতিক ‘শ্রুতি’র মতো চরিত্রের সঙ্গে যার গুণে শব্দের অর্থকে উত্তরণ করে ধ্বনি-ব্যঞ্জনাতেই পাঠক গভীরতর ইঙ্গিত ও দ্যোতনায় পৌঁছতে সক্ষম। তিনি ‘ফুল’ উচ্চারণ করে ফুলের বাস্তবিক রূপেই পৌঁছাতে চান না, এমন ধ্বনিবিশিষ্ট শব্দ পেতে চান যার স্বরগুণ স্বাভাবিক ফুলের চেয়ে স্বতন্ত্র একটা কিছু-একটা সঙ্গীত, স্বপ্ন, সারৎসার, নমনীয়তা-এমন কোনো ফুল যা সব তোড়ার ঊর্ধ্বে। মালার্মের এই ভাবনা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবু এই আদর্শের সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শব্দ, শব্দ থেকেও, অর্থভার বহন করেও ধ্বনি-চারিত্র্যের গুণে কবিতার সারবত্তাকে আরো সম্মোহনশালী করতে পারে। ছন্দশাস্ত্রের তাল-তান্ত্রিক নিয়মকানুন বাঁধাধরা। সেইখানেই তার একগুঁয়েমি। মালার্মে মাত্রার মেকানিজমে ধ্রুবপদী কাব্যের ফলপ্রসূতা স্বীকার করে নিয়েছেন। স্বীকার করে নিয়ে তিনি `secret and unfailing charm of defective verse’-এ পৌঁছানোর সাধনা করেছেন, পরিশ্রম করার জন্য অন্যদের অনুপ্রাণিত করেছেন তিনি।

ক. গতানুগতিক মেট্টোনোমিক পুনরাবৃত্তি, বাঁধাধরা পর্ব-পর্বাঙ্গ পুনরুক্তির থেকে মুক্তি চান এবং এক সুরের (melody) পরিবর্তে বহুব্রীহি সুরের (polymorphic) কবিতা নির্মাণ করতে চেয়েছেন।

খ. সাঙ্গীতিক বর্ণ (স্বর) তা কণ্ঠ অথবা যন্ত্রপ্রসূত হোক যতোটা ভাবব্যঞ্জক অর্থ-তীব্রতা প্রকাশ করতে পারে অর্থভারবহ শব্দ ব্যতিরেকে, মালার্মে কবিতার শব্দ এবং ভাষাকে তেমনি এক স্তরে উত্তীর্ণ করতে চেয়েছেন যাতে কবিতা শুধু কর্তব্যকেই ব্যক্ত করে না বরং বাণীর বহু বেশি ব্যঞ্জনা দ্যোতিত করে। এ হচ্ছে মর্ত্যবাসীর ব্যবহৃত ভাষা থেকে কাব্যলক্ষ্মীর অমর্ত্যবাণীর দিকে অভিগমন। ফরাসি ভাষা না জেনে মালার্মে, লাফর্গ এবং ভ্যালেরির এইসব কারিগরি এবং কৃতিত্বের সফলতা বোঝা মুশকিল। তবে বাঙলা কবিতাধ্বনির আওতায় বনলতা সেন বা মৃত্যুর আগের মতো কবিতার আবেগ-তীব্রতা যে বিশ্লিষ্ট শব্দ, ধ্বনি এবং স্বরবর্ণ-সমাহারের উপর একান্তই নির্ভরশীল, সেটা বুঝতে কাব্যতত্ত্ব পুঁথি পাঠের প্রয়োজন হয় না।

উনিশ শতকী ফরাসি পথপ্রদর্শকদের অনুসরণ করে ১৯৪২ সালে কবিতার সঙ্গীত (Music of Poetry) নামে এক সুবিদিত প্রবন্ধে টিএস এলিয়ট যা লিখলেন তার সারমর্ম মোটামুটি এ রকমের:

* অর্থ বিনা সঙ্গীতের কবিতা বলে কিছু নেই। তবে কবিতার সংগতিশীল ধ্বনি অর্থকে বহন করে এবং তীব্রতরভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম।

* কথ্যভাষার মধ্যে লুকোনো ধ্বনিরূপ থেকেই কবিতাকে সঙ্গীত নিঙড়ে নিতে হবে।

* সুরেলা হলেই কবিতা ভালো হয় না; কর্কশ স্বরের প্রতিপাদ্য স্থানও কবিতায় আছে। যতোক্ষণ না কবি গদ্য কঠোরতার স্বয়ম্ভূ হচ্ছেন ততোক্ষণ সংঘাততীব্র কবিতা রচনা সম্ভব নয়।

* স্বরগুচ্ছের পৌনঃপুনিকতা সঙ্গীত এবং কবিতা উভয় রচনায়ই স্বাভাবিকভাবে প্রযোজ্য।

* সিম্ফনী সঙ্গীতের লয়ের বিভিন্ন ও বিচিত্র উত্থান-পতনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ঐ ধরনের কবিতা সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

ধ্বনিচারিত্র্য বিষয়ে ইউরোপীয় কবিদের কী কী রচনা জীবনানন্দ পড়েছিলেন তা নিরূপণ করা কঠিন। তবে এ বিষয়ে যে তিনি বিশদ ভেবেছিলেন, ‘কবিতার কথা’য় তার স্বাক্ষর আছে। সর্বোপরি তাঁর কবিতাই প্রমাণ করে যে, বাঙলা কবিতায় তিনি একটি সম্পূর্ণ নতুন ধ্বনির জনক।

(……………………………………………………………………………………………………………চলবে)

আগের পর্বের লিংক:

জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (১) http://sonelablog.com/archives/23872

১জন ১জন
0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ