১
জটাধারী সুনিপুণ দক্ষতার সাথে আরেকটা একশ’ টাকার নোটকে লাল টকটকে গোলাপ বানিয়ে ফেললেন। আমি লক্ষ্য করলাম, সামনে বসা পৌঢ় লোকটা অল্প অল্প কাঁপছে!
পলাশদের গ্রামে এসেছি গোলাপবাবাকে দেখতে। দেড় মাস হল এই বাবা এখানে আস্তানা পেতেছেন। পলাশ বলছিল- ‘দোস্ত, প্রথমে আমিও বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এখন বাবার কার্যকলাপ দেখে একটা সম্ভ্রম চলে এসেছে।’
আমি বললাম- ‘সম্ভ্রম মানে কী? তুই কি তার অতিলৌকিক ক্ষমতা বিশ্বাস করিস?’
-‘ঠিক বিশ্বাস করি না, তবে অবিশ্বাসও করতে পারি না!’
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। পলাশ আমার বন্ধু; যথেষ্ট আধুনিক ছেলে, ভালো ছাত্র। ভালো বিতর্ক করে, যুক্তি ছাড়া কিছুই মানে না। -সেই পলাশ যখন বলছে, তখন একবার দেখার আগ্রহ দমাতে পারলাম না।
বয়স্ক লোকটা বাবার সামনে থেকে উঠে এসে আমার পাশে বসল। জিজ্ঞেস করলাম- ‘চাচার নাম কী?’
লোকটা ভীত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, ‘মোবারক শেখ।’
আমি বললাম- ‘কী কাজে আসছেন?’
মোবারক শেখ আরেকবার শীতল চোখে আমাকে দেখে উঠে চলে গেল!
আমি আবার জটাধারীর দিকে তাকালাম। তাঁর সামনে একশ টাকার নোট হাতে নিয়ে এক ত্রিশোর্ধ যুবক বসা। যুবকের গায়ে কটকটে হলুদ শার্ট। যুবকের হাতের উপর জটাধারী হাত রাখলেন। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে হাত সরিয়ে নিলেন। আমি ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলাম। যুবকের হাতের মধ্যে একটা লাল গোলাপ! পলাশ আমার কনুইয়ে গুতা দিয়ে বলল- ‘দেখছিস?’
আমি নিজের হতভম্ব ভাবটা খুব দ্রুত লুকিয়ে ফেললাম। বললাম- ‘এটা কোনো ব্যাপার না পলাশ, সে হাতের মধ্যে একটা গোলাপ কৌশলে লুকিয়ে রাখছিল।’
পলাশ নির্জীব কণ্ঠে বলল- ‘হতেও পারে।’
পলাশকে যেটা বললাম, আমি নিজে সেটা পুরোপুরি বিশ্বাস করি না। আমি টুকটাক পামিস্ট্রি চর্চা করতাম, এই গোলাপের ব্যাপারটা ঠিক সেরকম কিছু না। জটাধারী অন্য কোনো কৌশল ব্যবহার করছেন।
আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গোলাপবাবাকে দেখতে লাগলাম। একটা লাল চাদরে পুরো শরীর ঢাকা। এই চাদরেই কিছু একটা আছে। ফিসফিস করে পলাশকে বললাম- ‘দ্যাখ তো, চাদরের নিচে তোদের বাবার হাতের মাঝামাঝি জায়গাটা উচু না?’
পলাশ বলল, ‘কী বললি?’
-‘বাবার কবজির উপরের জায়গাটা উচু মনে হচ্ছে না?’
-‘হ্যা। তো?’
আমি বেশ শব্দ করে বললাম- ‘এখানেই ঘটনা আছে।’
গোলাপবাবা আমার দিকে তাকালেন। আশ্চর্য রকমের রক্তাক্ত চোখ। আমার পুরো শরীরে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল। পিছন থেকে কেউ একজন হিসহিসে কণ্ঠে বলল- ‘কথা কইয়েন না ভাইজান।’
আমি পলাশকে নিয়ে সরে এলাম। পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি। কবজির উপরের অংশে অনেকগুলো গোলাপ রাখা আছে, প্রয়োজনের সময় একটা করে গোলাপ বের করে আনার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। সুতা কিংবা ইলাস্টিক জাতীয় কিছু ব্যবহার করছে। তবে তাঁর দক্ষতা প্রশংসনীয়, হুট করে কেউ টের পাবে না।
আমরা হলুদ শার্ট যুবকের সাথে কথা বললাম। যুবকের নাম বিজয় মণ্ডল, স্থানীয় চেয়ারম্যানের ছোট ভাই।
-‘বুঝলেন ভাই, মাইয়া মানুষ কন্টোল করার মতো কঠিন কাজ আর নাই।’
পলাশ বলল- ‘আপনি কি এই কাজেই এখানে আসছেন?’
-‘জ্বি ভাই। একদমই কথা শোনে না। দেখি বাবার গোলাপে কী হয়।’
আমি বললাম- ‘আপনার কি মনে হয়, কাজ হবে?’
-‘আমি পুরা বিশ্বাস করি না বুঝছেন? সবাই বলে উনি বিরাট তালেবর মানুষ, এইজন্যে একটা টেরাই দিলাম আরকি।’
-‘কত টাকা নিল?’
-‘একশ’ এক।’
-‘ওহ! তো গোলাপের ব্যাপারটা কী একটু বলেন তো।’
বিজয় মণ্ডল সাবধানে গলা নামিয়ে বললেন- ‘ভাই শোনেন, আমার ধারণা এইসব ভণ্ডামি। এত বড় বুজুর্গ মানুষ, মুখে দোয়া করলেই হয়, গোলাপ দেওয়ার কাম কী? খালি ধান্দা বুঝলেন!’
আমার মনে হল, এই যুবকের সাথে খোলামেলা আলোচনা করা যায়। আমরা বাবার আস্তানার বাইরে চলে এলাম। ভণ্ড লোকটা কীভাবে মানুষকে ঠকাচ্ছে, সেটা খুলে বললাম। গোলাপের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার পর বিজয় বললেন- ‘আমারও এইরকম মনে হইছিল, বুঝলেন? হাত ধইরা কেমুন যানি একটা মোচড় দিল। তারপরই দেখি হাতের মধ্যে গোলাপ।’
***
আমরা যখন দ্বিতীয়বার গোলাপবাবার আস্তানায় ঢুকলাম, তখন ভিড় বেড়ে গেছে। ভিতরে ঢুকেই বিজয় মণ্ডল জটাধারীর সামনে লোকজনের প্রথম সাড়িতে গিয়ে বসলেন। বাবার সামনে এক কিশোরী বসে আছে। তাঁর বিরাট থাবার নিচে কিশোরীর হাতে নিশ্চয়ই একশ’ এক টাকার নোট আছে। গোলাপবাবা হাত সরিয়ে নিলেন; কিশোরীর হাতে ফুল আর মুখে বিহ্বল আনন্দ। বিজয় মণ্ডল ধমকের সুরে বললেন- ‘ওই বুইড়া থাম!’
আমরা হতভম্ব হয়ে গেছি। বিজয় যে এভাবে আক্রমণ করে বসবেন, এটা ভাবিনি। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে। বাবার দু’জন সাগরেদ এগিয়ে এলো। বিজয় বললেন- ‘কেউ লড়াচড়া করবি না, এক্কেবারে পুইতা ফেলব!’
একজন সাগরেদ বলল- ‘ভাই, আপনার কী সমস্যা?’
বিজয় বললেন- ‘সমস্যা? জানিস আমি কে? এইখানে ভণ্ডামি! আমার গ্রামে!’
এই যুবক হঠাৎ করে এতোটা ক্ষেপে গেলেন কেন বুঝতে পারছি না। সাগরেদদের মুখ আতংকে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। যেহেতু স্থানীয় চেয়ারম্যানের ভাই, বিজয়ের নিশ্চয়ই একটা প্রতাপ আছে আর এরা ইতোমধ্যে সেটা জেনে গেছে। গোলাপবাবা শান্ত চোখে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।
পলাশ আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘চল, চলে যাই।’
আমি পলাশকে থামালাম। এখন চলে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি পুরো নাটক দেখতে চাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজন উত্তেজিত হয়ে যাবে। আর এদের হাতে এই জটাবাবা-বাহিনী খুন হওয়াও বিচিত্র নয়।
বিজয় মণ্ডল সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন- ‘আপনেরা যার যার বাড়ি যান। এই শালা একটা ভণ্ড। এই যে ফুলগুলা দিতেছে, এইগুলা সব এর ডাইন হাতে বান্ধা আছে। একটা একটা করে বাইর করতেছে! আপনেরা যান, এরে আমি সাইজ করতেছি!’
একজন সাগরেদ এগিয়ে এলো, ‘ভাই, আল্লাহর দোহাই, বাবার সাথে বেদপি কইরেন না। এইগুলা রহমতের ফুল। উনি কামেল মানুষ, উনি নাখোশ হইলে আল্লাহ নারাজ হবেন!’
‘তোর কামেলগিরি বাইর করতেছি…’ -বিজয় মণ্ডল এক টানে জটাবাবার গায়ের চাদর সরিয়ে ফেললেন।
আমরা আশ্চর্য হয়ে আবিস্কার করলাম, গোলাপবাবার শরীরে একটা সুতাও নেই! পুরোপুরি উলঙ্গ।
১৪টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
অনেকদিন পর দারুণ চমক দেয়া গল্প পরে ভাল লাগল।
নাজমুল আহসান
সময় নিয়ে পড়েছেন বলে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
জিসান শা ইকরাম
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।
কিছু একটা আছে এনাদের মাঝে
ইনি না হয় টাকা নিচ্ছেন,টাকা না নেওয়া বাবাও আছেন দু-একজন,নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
নাজমুল আহসান
পরের পর্ব কবে লিখব বলতে পারছি না। এরকম অনেক গল্প লিখেছি, যেগুলোর “পরের পর্ব” আর লেখা হয়নি :p
আশা জাগানিয়া
বাবাদের মাঝে কি পায় মানুষ?
নাজমুল আহসান
বিরাট প্রশ্ন করেছেন 🙁
ব্লগার সজীব
সিনেমাটিক সাসপেন্স বজায় রেখে পর্ব শেষ 🙂 পরের পর্ব চাই।
নাজমুল আহসান
লেখার সময় পাই না ওস্তাদ 🙁
সানোয়ার
বেশ মজা পেলাম ভাই গোলাপবাবা ভন্ডামি
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
নাজমুল আহসান
ধন্যবাদ সানোয়ার 🙂
মেহেরী তাজ
আমি তো ভাবলাম গল্প শেষ। এতো দেখি সবে শুরু। তারাতারি পরের পর্বটা পড়তে চাই। অনেক ভালো লেগেছে।
নাজমুল আহসান
প্রতিটা শেষ-ই নতুন কিছুর শুরু দিদি। কষ্ট করে পড়েছেন বলে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
শুন্য শুন্যালয়
অনেক গল্প এমন লিখেছেন যার পরের পর্ব আর লেখা হয়নি? 🙂
এই গল্পের পরের পর্ব অবশ্যই জলদি দিন। যতদিন না দেবেন, ততদিন টেনশনে থাকবো।
এমন দারুন গল্প লিখতে পারলে এমন হাওয়া হয়ে থাকা ঠিক না।
নাজমুল আহসান
আচ্ছা ঠিকাছে 🙂