জায়বুন্নেসা বেগম চুপচাপ বারন্দার চেয়ারটাতে বসে আছেন। বারান্দার এ পাশটা অন্যান্য রুম থেকে দূরে থাকায় এখানে চুপচাপ বসে থাকার সুযোগ পান। এশার নামাজ পড়ার পর তিনি এখানে বসে তসবি পাঠ করেন , তসবির ফাকে ফাকে পান খান , আর ফেলে আসা সময়ের স্মৃতিগুলো রোমন্থন করেন।আজ অবশ্য ওনার তসবি পড়ায় মন বসছে না ।এমনকি অভ্যাসমত পানও খাচ্ছেন না ।শুধু পানের কৌটা নিয়ে নাড়াচারা করছেন।
পানের কৌটাটি বেশ পুরানো । ওনার দাদীজান কৌটাটি দাদীজানের মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন।পুরানো এই কৌটাটি দাদীজান পরে আম্মাকে দেন । তারপর ওই ভরদুপুড়ে হঠ্যাৎ করে মা যখন পুকুরপারে মাথা ঘুড়ে পরে যান, আর যে কখনও জেগে উঠেন নি , তখন মায়ের পানের কৌটাটি তার অধিকারে আসে । সে অনেকদিন আগের কথা । আধো আধো আলোয় তিনি পানের কৌটাটি দেখতে লাগলেন । কৌটাটি কাঠের তৈরি , গোল, চারপাশে অদ্ভুত সুন্দর লতা ও ফুলের কারুকাজ ।একবার দেখতে শুরু করলে , মুগ্ধতার রেশ কাটতে অনেকক্ষণ লেগে যায়। কৌটার ঢাকনাটা আরও সুন্দর । এখানে লতা ও ফুলের কারুকাজ থাকলেও একটু ভিন্ন ধরনের।জায়বুন্নেসা এই সময় তনিমার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন । তার ভাবনায় ছেদ পড়ল।তার ছেলের বউ এর গলাও কানে আসতে লাগল।বেশ রুক্ষ স্বরেই মিরাজের সাথে কথা বলছে।শুনতে পেলেন তার ছেলে মিরাজ বলছে “মা মাঝে মাঝে বাচ্চাদের মত কাজ কেন করেন , বুঝি না”। অজান্তেই জায়বুন্নেসার বুক থেকে একটা দীঘনিশ্বাস বের হল।
সেই ছোট্ট বেলায় যখন মা হারিয়ে গেল। তখন জায়বুন্নেসার পুরো পৃথিবীটাই শূন্য হয়ে গেল।মায়ের পানের কৌটাটা মায়ের কথা মনে করিয়ে দিত । আস্তে আস্তে এই শূণ্যতা অভ্যাস হয়ে গেল। তখন তার অতি কাছের মানুষ ছিল মেজফুপি । মেজফুপির সাথেই ঘুমাতেন ,মেজফুপির কাছেই পড়তেন ।মেজফুপির খাটের অর্ধেকটা তার নামে ছিল।তার অংশে মেজফুপি আসলেই তিনি চেচাতেন । আরেকটু বড় হওয়ার পর ফুপি তাকে তার আলমারির একটা তাক দিলেন।ওখানেই তিনি তার পানের কৌটা ও অন্যান্য টুকিটাকি জিনিস রাখতে শুরু করলেন।বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার অধিকারও বাড়তে লাগল।একটা পড়ার টেবিল পেলেন , আলমারির তাক একটা একটা করে চারটা দখল করলেন । একসময় পুরো আলমারীর অর্ধেক – এক পাশ দখল করলেন।এভাবেই করে তার দিন কাটছিল। এমন সময় হঠ্যাৎ করে ফুপির বিয়ে হয়ে গেল।তাকে আগলে রাখার মানুষটাও দূরে চলে গেল।ফুপির বিয়ের পর ফুপির সব বস্তুই তিনি নিজের অধিকারে নেন । ফুপির খাটে একাই ঘুমাতে লাগলেন । ফুপির রুমটা তার আয়ত্বে ।তিনি খুব ঘর গুছানো পছন্দ করতেন।তাররুমটা সবসময় সাজানো গুছানো থাকত । তখন তার ছোট্ট ঘরের রাজত্বটা তার খুব প্রিয় জায়গা ছিল।
জায়বুন্নেসা বেগম পানের কৌটা থেকে একটা পান বের করে মুখে দিলেন।ছেলের বৌ তাকে ভাত খেতে ডাকছে ,কিন্তু যেতে ইচ্ছা করছে না । তনিমার কোন সারাশব্দ নেই।কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে হয়ত । পান চিবুতে চিবুতে তিনি তার বিয়ের কথা ভাবতে লাগলেন । গ্রীষ্মে বিয়েটা হয়েছিল।দুপুরের বিয়ে ।গরমে সবাই অস্থির । বিয়ের সময় তার অধিকারে থাকা অনেক জিনিসই তিনি অন্যদের দিয়ে দিয়েছেন । পেয়েছেনও অনেক কিছু । মিরাজের বাবা শৌখিন মানুষ ছিলেন। নানা ধরণের আসবাবপত্র দিয়ে ঘর সাজিয়েছিলেন। বিয়ের পর জায়বুন্নেসাকে পুরো সংসারের দেখাশোনা করতে হত ।আর কেউ ছিল না। তিনি একাই সব সামলাতেন।নিজের সংসারের দিকে তাকালে তার গর্বে বুক ভরে উঠত । এর পর মিরাজ পৃথিবীতে আসল।তাকে নিয়ে আরও ব্যস্ততা । হঠ্যাৎ একদিন খেয়াল করলেন ছেলেটা বড় হয়ে গেছে । এরপর সেই সন্ধ্যাটা আসল।মিরাজের বাবা ওই দিন খুব অস্থির ছিলেন।এখনও মনে পড়ে ্উনি বলছেন- আলো জ্বালাও , পর্দাটা একটু সরাও , সব এত আধার কেন ?
মিরাজের বাবা মারা যাওয়ার পর নিসঙ্গতা ভালই অনুভব করতে লাগলেন।সন্ধ্যার পর সে মানুষটা জন্য আর অপেক্ষার মূল্য নেই,তবু তিনি অপেক্ষা করতেন।বিশেষ কোন খাবার রান্না করার পর ওই তৃপ্তির মুখটা দেখতে চাইতেন ।দিবা স্বপ্নের মত অবাধ্য আর কিছুই নেই ,না চাইলেও নিজ থেকে কত অবাস্তব স্বপ্নবোনা হয়ে যায়।
সেই একই বছর মিরাজ চাকরি পেল।তার দুবছর পরই মিরাজকে বিয়ে করালেন।বিয়ের পর মিরাজ কোন রুমে থাকবে তা চিন্তার বিষয় হয়ে দাড়াল। তখন জায়বু্ন্নেসা নিজে থেকেই তার রুমটা মিরাজকে দিলেন।সেদিন যখন শোবার রুমটা তিনি ছাড়ছিলেন , এখনও মনে পড়ছে একরাশ স্মৃতি তাকে বার বার জ্বালাচ্ছিল।তার ব্যবহারের অনেক জিনিস ছেলের বউকে দিয়ে দিলেন।এভাবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতিটা জিনিস উপরই তার অধিকার হারাতে লাগল।তার আলমারির তাকগুলোও একটা পর একটা অন্যর অধিকারে গেল।দখল হল ওনার আলনা সিন্ধুক । খাটও ভাগাভাগি করে শুতে হল।ঘরে থেকে কিভাবে যেন বাহিরের মানুষ হতে লাগলেন।এক সময় দেখলেন একটা মাত্র বস্তু তার নিজের অধিকারে আছে , সেটা হল তার এই পানের কৌটা।এখন তনিমা , তার আদরের নাতি , এ জিনিসটাই চাইছে তার কাছে থেকে । কিন্তু তিনি কোনভাবেই এ কৌটা দিতে রাজি না। মিরাজের কাছে এটা শুধুই এক পুরানো কৌটা , কিন্তু তার কাছে এটা শেষ সম্পত্তি।শেষ অধিকার।
রাত অনেক হয়েছে । তিনি অনেকক্ষণ পানের কৌটাটা নিয়ে বসে ছিলেন। এবার দূর্বল পায়ে হেটে হেটে তনিমার পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে , টেবিলের উপর কৌটাটা রাখলেন।তারপর আবার এসে চেয়ারটাতে বসলেন।কৌটাটা তনিমাকে দেওয়ার পর উনার বুকের উপর থেকে একটা বোঝা যেন নেমে গেল।ফিক করে হেসে তিনি মনে মনে বললেন “এই শরীরের উপরই আমার কোন অধিকার নেই, আবার কৌটার উপর । রাতের বাতাসে জায়বুন্নেসার হাল্কা হাল্কা শীত করছে । তিনি আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লেন-যেমনটা সবাই ঘুমায়।অনেকেই এ ঘুম থেকে জেগে উঠে ,আবার কেউ কেউ আর জাগে না।
১৫টি মন্তব্য
বোকা মানুষ
খুব ভাল লাগলো পড়ে! বিশেষ করে জায়বুন্নেসা বেগমের মনোবিশ্লেষণটা চমৎকার ছিল!
অপদেবতা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ
জিসান শা ইকরাম
সোনেলায় স্বাগতম।
ধীরে ধীরে একটি সময়ে মানুষ প্রিয় সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়।
ভালো লেগেছে আপনার গল্প।
অপদেবতা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ
শুন্য শুন্যালয়
অপদেবতা আপনাকে আমাদের সোনেলা পরিবারে স্বাগতম। -{@
লেখাটির বিভাগ সিলেক্ট করতে হবে গল্প।
অসম্ভব সুন্দর একটি গল্প দিয়ে শুরু করলেন লেখা। আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের প্রত্যেকটি জিনিস কে ঘিরেই আমাদের অনেক গল্প থাকে। আমাদের পরিবর্তনের পেছনে মনের ভাঙ্গন থাকে কিছু কিছু, সেটা অন্যরা বুঝতে পারেনা, কখনো কখনো নিজেরাই বুঝতে পারিনা। জয়বুন্নেসার মত কখনো চুপ করে বসে হয়তো একদিন আমরাও এমনি স্মৃতি আওড়াবো। শুরু থেকে সমাপ্তি দারুন।
অপদেবতা
স্বাগত জানানোর জন্য ধন্যবাদ , পড়ার জন্য ধন্যবাদ , (y)
বিভাগটি খেয়াল করি নি , সামনে খেয়াল থাকবে । 🙂
অরুনি মায়া
অনেক ভাল লাগল গল্পটি। আমাদের পরিবারে আপনার আগমন শুভ হোক,,,, শুভ কামনা রইল 🙂 -{@
অপদেবতা
পড়ার জন্য এবং শুভ কামনা জন্য ধন্যবাদ , -{@
আপনার জন্যও শুভ কামনা রইল 🙂
মোঃ মজিবর রহমান
শুভেচ্ছা অবিরত।
সুন্দর পরিপাটি একটি লেখা।
-{@
অপদেবতা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ
সিকদার
কলম যেন না থামে । পড়া লেখা অনেকেই করে , অনেকেই বিদ্বান হয় কিন্তু মানুষের জীবনের ঘটনাগুলোকে কলমের কালি দিয়ে কাগজের বুকে ছবি আঁকতে সবাই পারে না । এটা চর্চা করলেও হয় না । কারন এই যোগ্যতা সম্পুর্ন স্রষ্টার দান । তিনি কাউকে দান করলে তখন চর্চার মাধ্যমে লেখার তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় । যত বেশি লেখা হবে ততই জীবনের বিমূর্ত চিত্রগুলো লেখানীর মাঝে আরো গভীরতা অর্জন করে বাস্তব হয়ে ফুটে উঠবে।
একজন পাঠক যখন কোন লেখকের লেখা পড়ে তখন লেখকের লেখার যোগ্যতা অনুযায়ী ঘটনাগুলোর বাস্তব চিত্র তার মনের মুকুরে যেন দেখতে পায় । তাই বেশি বেশি লেখার চর্চাটা চালিয়ে যেতে হবে ।দোয়া রইল ।
অপদেবতা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ
এই দোয়াটা দরকার ছিল
এই দোয়াটাই খুজছিলাম ।
ইমন
সোনেলায় স্বাগতম -{@ লেখাটা খুব ভালো হয়েছে 🙂
অপদেবতা
পড়ার জন্য এবং স্বাগতম এর জন্য ধন্যবাদ , -{@
শুভকামনা থাকল। 🙂
মেহেরী তাজ
প্রথমত আমাদের সোনেলায় স্বাগতম। -{@
অনেক সুন্দর একটা লেখা দিয়ে ঘরের চৌকাঠ পেরোলেন। লিখতে থাকুন সাথেই আছি।