
প্রতিবছরের বিজয় দিবসে নানা আয়োজনে কখনও মনে হয়নি তাকেও এতখানি মিস করা যায়। এবার বিজয় দিবসে সেরকম কোন আড়ম্বর নেই। শুধু সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ হবে। তারপর যে যার মত বাড়িতে, উপস্থিত না হলেও সমস্যা নেই।
এমনিতে ফজরের নামাজের পর না ঘুমালেও আমার একটু শুয়ে থাকা হয়। আজ শুয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না।কলিগদের সাথে অনেকদিন দেখা হয়না। গল্প,আড্ডা কিছুই হয়না তাই মনটা উতলা হয়ে আছে।তাদের সাথে কখন দেখা হবে এজন্য আনন্দিতও ছিল। নিজেকে দ্রুতই তৈরি করে নিয়ে দৌড় দিলাম কলেজ। প্রত্যাশামত কিছুই হলনা। বয়স্ক শিক্ষকরা তেমন কেউই আসেননি। অল্পকজন আমরা। যাহ্ কেউ নেই মনটা কেমন যেন হল । এত তারাতারি বাসায় ফিরতে হবে এটাও ভালো লাগলো না। সকালের সংসার মোটামুটি গুছিয়েই এসেছে সবাই। মাঠে দাডিয়ে রোদ পোহাতে পোহাতে একজন বলেই ফেললেন কতদিন পর আমাদের দেখা এভাবেই চলে যাব সব। একটু নদীর পাড়ে যাওয়া যায়। হইহই করে সবাই রাজী হয়ে গেল। কিছু শুকনা খাবার কিনে সবাই মিলে রওয়ানা নদীর পাড়।
নদীর পাড় বেশ জমজমাট, লোকজনে ভর্তি। হাসিখুশি, আনন্দিত মানুষজন সব ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমাদের ও যার যারমত ছবি তোলা, গল্প হচ্ছিল। অধিকাংশ গল্পই একাত্তরের, ডিসেম্বর, যুদ্ধ এসব নিয়ে। আমরা জুনিয়ররা শুনছিলাম মনোযোগ দিয়ে। প্রিয় দেশের কথা ভালোই লাগে শুনতে। কিছুটা অন্তত শান্তি অনুভূত হয়। কিছুই তো করতে পারিনি।
আমাদের দলনেত্রী দাদী। তাকে মজা করেই দাদী ডাকা। কারন বয়স ষাটের কাছাকাছি হলেও চল্লিশের বেশি লাগে না।একসময়ের ঢাকা ইডেন কলেজ পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের ক্রাশ। এখনকার ইতিহাস বিভাগের সহযোগীঅধ্যাপক। আমরা সবাই তাকে ধরে বসলাম কিছু বলার জন্য। আজ তিনি তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন। যুদ্ধের সময়কিভাবে পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে তর্কযুদ্ধে জয়ী হয়ে তার প্রিয় মুরগী ছিনিয়ে এনেছিলেন।
দাদীর বয়স তখন ছয় সাত বছর হবে। রংপুর পীরগঞ্জের কাছাকাছি ক্যাম্প ছিল পাক হানাদারদের। রংপুর বদ্ধভূমির কথা আমরা সবাই জানি। শতশত মানুষ সেখানে মেরে ফেলেছিল। এই হানাদাররা প্রতিদিন এলাকার বাড়ি থেকে গরু,খাসি, চিকন চাল নিয়ে যেত স্বদেশী হায়েনাদের সহযোগিতায়। সেগুলো জবাই করে, পুড়ে কাবাব আর রোষ্ট বানিয়ে খেয়ে খেয়েশরীরে শক্তি বানাতো অশুরের। মধ্যরাত অবধি চলত পৈশাচিক বর্বরতা। পাকিস্তানীরা নাকি মানুষের নখ কেটে মদে ডুবিয়ে খেত।
মানুষদের ধরে ধরে মেরে ফেলত। মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত। এসব গল্প শুনছিলাম আর নদীর পাড়ের বাতাসের সাথে ভেতরটা কাঁপছিল। এ কাঁপুনি যতটা না ঠান্ডার ।তার চেয়ে বেশি হায়েনাদের সাথে রাগের, দুঃখের, ক্ষোভের। যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে মর্মান্তিক দৃশ্য।
সেদিনও পাকবাহিনী বেশকিছু বাড়িতে হামলা চালিয়ে মুরগী, খাসি নিয়েছে। দাদীদের বাড়ি থেকেও একটা খাসি নিয়েছে।রাতে সেটার রেজালা হবে। সেদিন কম পরে যাচ্ছিল। লোকজনের কত আর হয়। হানাদারদের সেদিনের শখ ছিল মুরগীর রোস্ট খাবে। দাদীদের লাল সুন্দর দুটোই মুরগী ছিল। একটা মোরগ আর একটা মুরগি। একজন অন্যজনকে ছাড়া থাকতে পারতনা এমন অবস্থা। দাদীরও ভীষন শখেরও পছন্দের।
হানাদাররা মুরগীটাকে তুলে নিল। মোরগকে ধরতে পারেনি। দাদী লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলেন। হঠাৎ প্রিয় মুরগীর শোকে চোখেমুখে ফ্যাকাসে ভাব চলে এল। তিনি তাদের পিছু পিছু রওয়ানা দিলেন। আর ভাবতে থাকলেন কি করে উদ্ধার করা সম্ভব। অবশেষে নিজেকে মোটামুটি তৈরি করে নিলেন কি বলা যায়!
হানাদারদের লিডার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট মেয়েটিকে কৌতুহলী দেখে ডেকে পাঠালেন। মেয়েটি নির্বিকারে বলে ফেলল সে তার মুরগী ফেরত নিতে এসেছে। মুরগী ছাড়া সে যাবে না।
লিডার প্রশ্ন করল, মুরগী ফেরত দিলে তাদের কি লাভ হবে।”
মেয়েটির উত্তর,” এ দেশ তো আপনাদের। আর আপনারা তো খান, খান বেশি। গ্রামের লোকজন এখুনি আপনাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে পারছেনা। পরে আপনাদের কি খাওয়াবে। আমাদের তো একটাই মুরগী। এটা খেয়ে ফেললে মুরগী আর ডিমও দেবেনা, বাচ্চাও হবে না। তখন আপনারা খাবেন কি? আর যে মুরগীটা নিয়ে এসেছেন সেটা তো প্রেগন্যান্ট।প্রেগন্যান্ট মুরগী কি খাওয়া যায়? আমার মুরগীটা ফেরত দেন আমি চলে যাই। পরে বাচ্চা হলে সেগুলো না হয় নিয়েন”।
বোকা খানেরা ভেবেই নিল মুরগী প্রেগন্যান্ট এটা খেলে হারাম হবে। তাই ফেরত দিয়ে দিল। সন্ধ্যে ছুঁইছুঁই, বাড়িতে সবাই অস্থির। এমন সময় মেয়েটি তার প্রিয় মুরগী হাতে বিজয়ীর বেশে বাড়ি ফিরল।
তার গল্প শুনে আমরা সবাই হাততালি দিয়ে বিজয় উদযাপন করলাম। আজ থেকে তিনি হয়ে গেলেন যোদ্ধা দাদী।
প্রেগন্যান্ট মুরগী হারাম, খায়না ইসলামে নিষিদ্ধ। কিন্তু নারী মাংস কি হালাল কিংবা লুটতরাজের খাবার সেটা। কত প্রেগন্যান্ট নারীকে ধরে নিয়ে গিয়ে রেপ করতে করতে জরায়ু বের করে ফেলেছে। কতজনের রক্তপাত হতে হতে মারা গেছে। কতজনকে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দিয়ে ভেতরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল পাক হানাদারদের ক্যাম্প মা-বোনের আর আমাদের ভাইদের রক্তে।
কতটা খারাপ হলে মানুষ এমন হয়। আমরা তাদের পক্ষ নেই। সহভাই বলি। ক্ষমা করে দেই! কেন ক্ষমা? কিসের ক্ষমা? কিসের মুসলমান ভাই ভাই? শয়তানের কোন ক্ষমা নেই। আল্লাহ আমাদের সঠিক জ্ঞান দান করুক। শুভ কামনা।
ছবি-নেট থেকে।
১৬টি মন্তব্য
আলমগীর সরকার লিটন
চমৎকার এক গল্পপাঠ করলাম বেশ মজাই পেলাম মুরগী প্রেগন্যান্ট হা হা রুকু আপু—————
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ লিটন ভাই।
মজার আবার দুঃখের কারন তারা মুরগীও ছাড়েনি।
ভালো থাকবেন।
আরজু মুক্তা
সেটাই। নামাজ পরি। হাদীস কোরআন মানিনা। প্রেগন্যান্ট নারী কুড়মুড়িয়ে খাইছে সেনারা। এদের আখেরাতেও শান্তি হবে না।
সেই দাদিকে সালাম জানাইয়েন।
আপনিও ভালো থাকেন সবসময়।
খান সেনা নাই, দেশি সেনারও অভাব নাই।
রোকসানা খন্দকার রুকু
অসাধারণ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
শুভ কামনা রইলো।❤️❤️
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ঐ বয়সে কত বুদ্ধি ছিল দাদীর! মুরগীরে প্রেগন্যান্ট বানিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসলো হায়েনাদের কবল থেকে। কিন্তু কত শত গর্ভবতী নারী রেহাই পায়নি ওদের নিষ্ঠুর থাবা থেকে।
খুব ভালো লাগলো আপু
নিরন্তর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন
রোকসানা খন্দকার রুকু
রুপক হলেও বাস্তবতা সেটাই।
ধন্যবাদ দিদিভাই। শুভ কামনা রইলো।❤️❤️
জাহাঙ্গীর আলম অপূর্ব
সুন্দর লেখা
পড়ে মুগ্ধ হলাম
শুভকামনা রইল প্রিয়
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাইয়া।
শুভ কামনা আপনার জন্যও।
ফয়জুল মহী
চরম বাস্তবতার আত্মার অনুভূতি ।
অনেক শুভ কামনা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাইয়া।
শুভ কামনা আপনার জন্যও।
তৌহিদ
গল্পে নির্মম সত্য ফুটিয়েছেন। তারা হীন মনোকামনা চরিতার্থ করার জন্য মা বোনদের হালাল করেছে নিজের মত। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন না।
মুরগী জবাই করার পরে অনেক সময় পেটে ডিম পাওয়া যায়। কর্তা জানেনই না মুরগীর পেটে ডিম ছিলো? সেটি কি খাওয়া হালাল একটু জানাবেন?
ভালো থাকুন আপু।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাইয়া। সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।
সাবিনা ইয়াসমিন
প্রেগন্যান্ট মুরগী সহ যেকোনো পশু খাওয়া হারাম, কিন্তু প্রেগন্যান্ট নারী বৈধ! এটা হলো ঐ টাইপের হাদিস, যেখানে বলা হয়েছে বিধর্মীদের সাথে উঠবস করা যাবে না কিন্তু সহবাস চলবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে কলংকজনক অধ্যায় হলো নারী ধর্ষণ, কারণ একটা মুসলিম দেশ হয়ে আরেক দেশের মুসলিম নারীদের উপর তারা অত্যাচার করেছে।
পাকিস্তানিরা মানুষের নখ কেটে মদে ডুবিয়ে কেন খেত বুঝলাম না।
ভালো থাকুন, শুভ কামনা 🌹🌹
রোকসানা খন্দকার রুকু
নখ ডুবিয়ে খাওয়া হল একধরনের উল্লাস। পাশের মানুষটির নখ থাকবেনা, সে কাঁদবে। আর কেউ মজা নেবে।
শুভ কামনা রইলো।🥰🥰
খাদিজাতুল কুবরা
জন্মের পর থেকে এমন পানসে বিজয় দিবস আর দেখিনি। একাত্তরের লুটেরাদের কাণ্ড কারখানা ভালোই তুলে ধরেছো।আর দাদী সত্যি বুদ্ধিমতী! খানসাহেবদের বোকা বানিয়ে মুরগী নিয়ে এসেছেন।
নীলিমা ইব্রাহীমের “আমি বীরাঙ্গনা বলছি ” পড়ে জানতে পেরেছি কত ভীবৎস ছিলো সেসব দিনকাল।
রোকসানা খন্দকার রুকু
খুবই বিভৎস দৃশ্য। মা মেয়ে একসাথে ধর্ষণ করত।
ভালো থেক।🥰🥰