তুমুল তারুন্যে তার সামনে ছিলো দুইটা পথ – সোনালী ভবিষ্যতের হাতছানি, ছিলো ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে চলে গিয়ে জীবনের প্রয়োজন মিটিয়ে একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জীবন কাটিয়ে দেয়ার।
আর ছিলো, দেশের ডাকে মাতৃদায় শোধ করবার ডাক। প্রমিথিউস হয়ে নিজের জীবন জ্বালিয়ে দেশকে , মাকে মুক্ত করার আহবান।
নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে রুমী বেছে নিয়েছিলেন দ্বিতীয়টি, বেছে নিয়ে ছিলেন মাতৃদায় শোধের ডাক। আমাদের প্রমিথিউস আমাদের রূমী। আজ তার জন্মদিন – একজন সত্যিকারের ইয়ুথ আইকনের জন্মদিন । শাফি ইমাম রুমী বীর বিক্রম (জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৫২ – নিখোঁজ: ৩০ আগস্ট, ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন গেরিলা যোদ্ধা। তিনি ছিলেন শহীদ জননী খ্যাত জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠ পুত্র।
রুমী ছিলেন অসাধারন বাগ্মী এবং তুখোড় তার্কিক, যার বর্ণনা পাওয়া যায় আম্মার লেখায় – যুদ্ধে যাওয়ার জন্য যখন আম্মাকে বোঝাচ্ছিল রূমী অনুমতি দেয়ার জন্য, তখন আম্মার জবানীতে ” ডিবেট চ্যাম্পিয়ন রূমীর সাথে তর্কে জেতার সাধ্য কার ”
যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে, রুমী ধারাবাহিকভাবে তার মা ও বাবাকে নিজের যুদ্ধে যাবার ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করেন। ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মাকে অবশেষে রাজি করিয়ে ২ মে রুমী সীমান্ত অতিক্রমের প্রথম প্রয়াস চালান। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তাঁকে ফেরত আসতে হয় এবং দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় সফল হন।
রুমী যোগ্য পিতা মাতার যথাযোগ্য সন্তান ছিলেন, ছিলেন প্রচন্ড রকমের দায়িত্ববান একজন মানুষ , নিজে কি করছেন তার ব্যাপারে স্বচ্ছ চিন্তার মানুষ – যার প্রতিফলন দেখা যায় রনাঙ্গন থেকে মামাকে লেখা চিঠিতে –
আগরতলা
১৬ জুন, ’৭১
সুপ্রিয় পাশা মামা,
বিস্মিত হয়ো না! এটা লেখা হয়েছিল এবং তোমার অবধি পৌঁছালোও। এবং পড়ার পর চিঠিটা নষ্ট করে ফেলো। এ নিয়ে আম্মাকে কিছু লিখে জানানোর চেষ্টা করো না। এটা তাদের বিপদে ফেলবে। তাড়াহুড়ো করে লিখলাম। হাতে সময় খুব কম। আগামীকাল বেস ক্যাম্পের উদ্দেশে এখান থেকে চলে যেতে হবে।
আমরা একটা ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ লড়ছি। আমরা জয়ী হব। আমাদের সবার জন্য দোয়া করো। কি লিখব বুঝতে পারছি না… কত কি নিয়ে যে লেখার আছে। নৃশংসতার যত কাহিনী তুমি শুনছ, ভয়াবহ ধ্বংসের যত ছবি তুমি দেখছ, জানবে তার সবই সত্য। ওরা আমাদের নৃশংসতার সঙ্গে ক্ষতবিক্ষত করেছে, মানব ইতিহাসে যার তুলনা হয় না। আর নিউটন আসলে যথার্থই বলেছেন, একই ধরনের হিংস্রতা নিয়ে আমরাও তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। ইতিমধ্যে আমাদের যুদ্ধ অনেক এগিয়ে গেছে। বর্ষা আরম্ভ হলে আমারা আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেব।
জানি না আবার কখন লিখতে পারব। আমাকে লিখো না। সোনার বাংলার জন্য সর্বোচ্চ যা পারো করো।
আজকের মতো বিদায়। ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাসহ
রুমী
রুমী সেক্টর-২ এর অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই সেক্টরটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল খালেদ মোশাররফ ও মেজর হায়দার। প্রশিক্ষণ শেষ করে তাদের নিয়ে তৈরি স্টুডেন্ট কোম্পানী কে ঢাকায় ফেরত পাঠানো হয় কিছু গেরিলা হামলার উদ্দ্যেশে , কিন্ত রক্তে যার অমিত তেজ নিয়তির লেখন যার স্বাধিনতার প্রমিথিউস হবার সে কি আর চোরাগোপ্তা হামলায় সন্তষ্ট থাকার মানুষ – রুমী ও তার দলের ঢাকায় আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন হামলা করা। সেই আক্রমন শেষে তারা করেন দুঃসাহসিক ”হোটেল ইন্টার কন্টিনেটাল হামলা ” এবং তাদের সেই স্টুডেন্ট কোম্পানীর নাম হয়ে যায় ”ক্রাক প্লাটুন” এ সময় তাদের আরও কিছু ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনা করতে হয় যার মধ্যে ধানমণ্ডি রোডের একটি আক্রমণ ছিল উল্লেখযোগ্য।
১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট রুমী তাঁর নিজের বাড়িতে কাটান, এবং এই রাতেই বেশকিছু গেরিলা যোদ্ধার সাথে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী একটি অজ্ঞাত!! উৎস থেকে তথ্য নিয়ে বেশ কিছুসংখ্যক যোদ্ধাকে গ্রেফতার করেন যার মধ্যে ছিলেন আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারাক আলভী, আজাদ ও জুয়েল। রুমীর সাথে তার বাবা শরীফ এবং ভাই জামীকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের স্থানে রুমীকে ভাই ও বাবাসহ একঘরে আনলে রুমী সবাইকে তার যুদ্ধে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করতে বলেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, পাক বাহিনী তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন এবং এর সব দায়-দায়িত্ব তিনি নিজেই নিতে চান।
ইয়াহিয়া খান ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলে অনেক আত্মীয় তাঁর জন্য আবেদন করতে বলেন। কিন্তু রুমী যে বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ধরা পড়েছে, তাদের কাছেই ক্ষমা চাইতে রুমীর বাবা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী, দেশপ্রেমিক শরীফ ইমাম রাজি ছিলেন না। এবং এই বীরযোদ্ধা কে ৩০ আগস্টের পর আর দেখা যায়নি।
– রুমীর মতো যোদ্ধারাই একেকটা দেশের একেকটা যুদ্ধের নায়ক, সত্যিকারের নায়ক।তাদের জন্মই গ্রীক পুরানের প্রমিথিউসের মতো নিজে জ্বলে বাকি সবাইকে আলোকিত করে যাবার জন্য।
জন্মদিনে অন্তরের অন্তস্থল থেকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানাই – রুমী, মাই হিরো শুভ জন্মদিন।
১৪টি মন্তব্য
নীতেশ বড়ুয়া
দুঃখ ‘এই প্রমিথিউস এখন শুধুমাত্র শাব্দিক চেতনার প্রজন্মে’ লালিত হচ্ছে…
আগুন রঙের শিমুল
ক্ষেত্রবিশেষ , হ্যা জেনারালাইজ করলে কেমনে হবে নীতেশ , বুকে হাত দিয়া বলতো দেশের যেকোন দুর্দিনে বুকের ভেতর একজন রূমী জেগে ওঠেনা ?
শুন্য শুন্যালয়
কি অসাধারন দেশাত্ববোধ ছিলো এক একজন যোদ্ধার মনে। কতো সাহসী হলে এই বয়সের ছেলেগুলো সব লোভ ছাড়তে পারে দেশের জন্য। স্যালুট বীর যোদ্ধা রুমিকে, জন্মদিনের এই দিনে অসীম শ্রদ্ধা জানাই তাকে। রুমী কে নিয়ে আরো লেখা চাই ভাইয়া।
আগুন রঙের শিমুল
হ্যা এদের দান আমার বাংলা মা ।
চেষ্টা করব শুন্য
জিসান শা ইকরাম
রুমিরা ছিল বলেই আজ আমরা স্বাধিনতার স্বাদ পেয়েছি
আমাদের আছে এখন একটি দেশ,একটি পতাকা।
বীর রুমীকে আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলী।
আগুন রঙের শিমুল
শ্রদ্ধাঞ্জলী
লীলাবতী
বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রুমীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।এমন বীর আমাদের গর্ব।
আগুন রঙের শিমুল
পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা লীলাবতী
ছাইরাছ হেলাল
এমন আত্মত্যাগ বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ফিকে ফিকে মনে হয়।
আর কিছুদিন পরে হয়ত আমরা বিসৃত হয়ে যাব অকুতভয় জীবন উত্সর্গকারী এই মহান বীরদের কথা।
আগুন রঙের শিমুল
হ্যাঁ, দাদা মাঝে মাঝে বিফল মনে হয় – এই মৌলবাদের উত্থান এই অন্ধকার সময় এইসব দেখে আসলেই ফিকে মনে হয়
নুসরাত মৌরিন
রুমি- উনিশ বছরে স্থির এক আশ্চর্য স্বাপ্নিকের নাম। যাঁর স্বপ্ন আজো আমাদের বিভোর করে।রুমি নেই কিন্তু তাঁর স্বপ্ন বেঁচে আছে “বাংলাদেশ” হয়ে…।
১৯৭১ এ এমন রুমিরা ছিল বলেই আমরা পেয়েছি বাংলাদেশ।এমন অমিত সম্ভাবনাময়,এমন নিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানিকে পিছনে ফেলে যে শুধুই দেশের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে,সেই রুমির জন্মদিনে মাথানত করে শ্রদ্ধাটুকু তাকে পৌঁছে দিতে চাই।
আগুন রঙের শিমুল
শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা প্রমিথিউসের মতই হিরন্ময় ছিল যার জীবন
খেয়ালী মেয়ে
সপ্তম শ্রেণীতে থাকতে প্রথম পড়ি আমি একাত্তরের দিনগুলি–সেই থেকেই রুমী প্রেমে মগ্ন…রুমীর কথাগুলো মনে গেঁথে গেছে…তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি আজো..
রুমী মুখ তুলে কি এক রকম হাসি যেন হাসলো–মনে হল অনেক বেদনা সেই হাসিতে–একটু চুপ করে থেকে বললো, “বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন একটা কথা আছে না আম্মা? হয়তো জীবনের পুরোটা তোমাদের মতো জানিনা, ভোগও করিনি, কিন্তু জীবনের যত রস-মাধুর্য, তিক্ততা, বিষ সবকিছুর স্বাদ আমি এর মধ্যে পেয়েছি আম্মা–যদি চলেও যাই, কোন আক্ষেপ নিয়ে যাব না……
রুমী নেই————নবীন বয়সে যখন পৃথিবীর রুপ—রস–মধু—সৌরভ উপভোগ করার জন্য সবে বিকশিত হচ্ছিল—তখনই সে নেই………………
একই রকম কমেন্টস আজ সোনেলাতে দুজনের লেখাতে করলাম, কারণ দুজনই রুমীকে নিয়ে লিখেছে…
আগুন রঙের শিমুল
আহা রুমী , জেনারেল খালেদ ঠিকি বলেছিল স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায়না । তাই হয়তো …