মেডিকেলের হোস্টেলে একটা কমন ব্যাপার চালু আছে যে সিনিয়র আপু/ ভাই রা তাদের প্রফের সময় তাদের টিউশনী টা কাউকে মাসখানেক এর জন্য প্রক্সি হিসেবে দিয়ে দেয়। এমনই এক প্রক্সি টিউশনিতে গেলাম সেখানে দুইটা বাচ্চা ক্লাস সিক্স আর ক্লাস থ্রি’র। দুইটাই ইংলিশ মিডিয়ামের। ওদের মা শুরুতেই বলে দিলেন বাংলায় ওরা খুব কাঁচা। যেন একটু এক্সট্রা কেয়ার নেই।
তো প্রথম দিন তাদের দুইজনকে পড়তে বসাতেই শুরু হয়ে গেল ক্লাস পার্টির গল্প। আহ্লাদ করে আমিও খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতে লাগলাম। কিন্তু মিনিট দশেক পরে বুঝলাম মস্ত বড় ভুল করে ফেলছি – আমি তো বাচ্চা গুলার পাতা ফাঁদে পা দিয়া ফেলছি। তারা গল্প করে টাইম কাটাইতে চাইতেছে। এবং আমার তেলতেলা হাসি দেখে ওরা বুঝে ফেলছে আমি মোটেই ভয় পাবার মত কোন বস্তু না।
যাই হোক, অনেক কষ্টে তাদেরকে পড়াইতে শুরু করলাম। সবই ঠিকাছে খালি বাংলা বই বের করতে বলার পরেই একটু মোচড়া দিয়া উঠল দুই বোন। যথা সম্ভব গাম্ভীর্য বজায় রেখে তাদের পড়া ধরতে শুরু করলাম। এক জায়গায় দেখলাম সে বাক্য রচনা লিখেছে- “দাগী চোর টিকে মেরো না, ওকে ছেড়ে দাও”
এমন মহানুভবতার হেতু জানতে চাইলে সে বলল- “মিস, একটা লোককে কেন মারবে শুধু শুধু তাই তাঁকে ছেড়ে দিতে বলেছি”
“সে তো চোর, তুমি তাঁকে পুলিশে দেবার কথা বলতে পারো”
“নো মিস, দ্যাট ম্যান ওয়াজ টেইকেন টু বি এ চোর। বাট হি ইজ নট”
“কে বলেছে ?”
” সুমনা মিস কে দাগী মানে জিগেস করেছিলাম শি সেইড দ্যাট এন আইডেন্টিফায়েড চোর। ও তো আসলে চোর না, ওকে চোর হিসেবে আইডেন্টিফাই করা হয়েছে।”
তাঁকে “দাগী” এর মানে অনেক কষ্টে বুঝাইতে সন্ধ্যা হয়ে গেল, সেইদিনের মত পড়াশোনা শেষ। নিজেরে নেহাতই ভদাই প্রমাণ কইরা আসলাম প্রথম দিনই।
পরদিন বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে একসময় বললাম “সব ফল গাছেই আগে ফুল হয় তারপর ফল”
দুই বোন চোখ কপালে তুলে তাকাইলো।
পিচ্চি জিগেস করে “মিস আমগাছে কি ফুল হয়?
“ডেফিনেটলি, তুমি আম গাছের ফুল দেখো নাই?
“হিহিহি, হ্যা দেখেছি। আমগাছের ফুল দিয়ে আমাদের বার্থ ডে পার্টি তে ঘর সাজানো হয়” বলেই কি বিদ্রুপের হাসি!
বড়টা আরেক কাঠি বেশি- “মিস, কাঁঠালের ফুল মাথায় লাগালে আপনাকে খুব সুন্দর লাগবে”।
টিচার হিসেবে তো না ই, এরা দেখি আমারে একটা মুরুব্বি মানুষ হিসেবেও পাত্তাই দেয় না। মনে করতেছে আমি কিছুই জানি না। মেজাজ খারাপ কইরা বান্দর পিচ্চি দুইটার চোদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে হোস্টেলে ফিরলাম
তার পরে একদিন পড়ার ফাঁকে হঠাত প্রশ্ন- “মিস অন্ডকোষ মানে কি?”
ভ্যাবাচ্যাকা খাইলাম অল্প। কিন্তু স্মারটনেস আর গাম্ভীর্য দুইটা চেহারার মধ্যে অনেক কষ্টে জোগাড় কইরা মিন মিন কইরা বললাম, “তুমি স্ক্রোটাম চিন”?
“না”
“টেসটিকলস চিন?”
“নোপ”
“ওকে, পেনিস চিন?”
“হ্যা চিনি”
তারপর তাকে অনেক কসরত করে বুঝাইলাম।
পিচ্চি আমারে নেহাতই অবজ্ঞাসুচক ভঙ্গিতে বলল- “ওহ, ইউ মিন বলস?”
নিজেরে নিজে একটা চটকানা দিলাম মনে মনে। আজকালকার বাচ্চারা কোন ভাষা বুঝবে তা কোন গাধায় না জানে?
এইভাবেই বারবার পিচ্চি বিচ্ছু গুলার কাছে ভারবাল ল্যাং খাইতে খাইতে ভিত্রে ভিত্রে অবস্থা বেগতিক হইলেও উপরে উপরে খুব ভাব ধইরা রেগুলার আসা – যাওয়া করতে থাকলাম। হাসি তো এক্কেবারে বন্ধ।
হয়ত ভাগ্য আমার সহায় ছিল । তাদের টুকটাক ভুল বানান, আর বাক্যবিন্যাসে বিভ্রাট হজম করে যাইতেছিলাম। কিন্তু মান্থলি টেস্টে বাংলায় লাড্ডু পাওয়ায় বাচ্চার মা এসে খানিক রাগ প্রকাশ করে গেল। বললাম তোমার কপি দেখাও আমাকে, কি লিখছ?
এখানে একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া দরকার, কোন এক গল্প নাকি ছড়ায় “জ্বালা” শব্দটি “কলসি” বা হাড়ী অর্থে ব্যাবহার করা হয়েছিল। এবং সেটা তার খুব মনে গেঁথেছিল কারন তার কিছুদিন আগেই সে জীবনে প্রথম কলসি দেখেছে যেটাতে করে তার খালা সুন্দরবনের গুড় এনেছিল।
তো তার টেস্টে “মরণ জ্বালা” শব্দটা দিয়ে বাক্যরচনা করতে বলা হয়েছিল। সে লিখেছে- “আমার খালামনি মরণজ্বালায় এক জ্বালা গুড় কিনেছিল”
এই বাক্য পড়ার পর আমি যেভাবে গড়াগড়ী দিয়া হাসা শুরু করছিলাম তাতে এই প্রথম চৌকস বাচ্চাদ্বয় অপ্রতিভ হইয়া আমার দিকে তাকায় থাকল।
ওর ভুল ভাঙ্গায় দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। সেই যে আসছি, আর ওইমুখো হইনাই লজ্জায়।
তবে সারাটা মাস আমারে বোকাচুদা বানানোর প্রতিশোধ টা আমি নিতে পারছি।
১৮টি মন্তব্য
আগুন রঙের শিমুল
পিচ্চি গুলানের লাইগা মায়া লাগতেছে, এই টাইপের পিচ্চিগুলা বড় হইয়া একেকটা ফার্মের মুর্গী হয় 🙁
লেখা ভালো হইছে 🙂
সিনথিয়া খোন্দকার
ফার্মের মুরগীর জ্বলায়ই অতিষ্ট ছিলাম। দেশী মুরগী হইলে যে কি হইত। 🙁
আগুন রঙের শিমুল
দেশী মুরগী ই ভালু 😀
সিনথিয়া খোন্দকার
😀
স্বপন দাস
হাসতে হাসতে প্রান যায় — সত্যিই কি ইংলিশ মিডিয়াম এর অবস্থা এত ভয়ংকর ? ?
সিনথিয়া খোন্দকার
আসলেই এমন। বাস্তব অভিজ্ঞতা আরো আছে। এইটা তো নমুনা।
নীল রঙ
ইংলিশ মিডিয়াম!!! 😮 সামওয়ান প্লিজ মাইরালা আমারে। 😀
সিনথিয়া খোন্দকার
আজকালকার বাচ্চাগুলা এমনি রে… 🙁
শুন্য শুন্যালয়
হাসি না, বরং ভয় ই লাগতেছে আমার 🙁
কি এক মরন কলসিতে যা পরছি আমরা, নাম তার ইংলিশ মিডিয়াম 🙁
সিনথিয়া খোন্দকার
আসলেই এলারমিং ব্যাপার। ওরা নিজেরাও জানে না কি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ওরা। 🙁
মিথুন
কি অবস্থা পিচ্চিগুলার, আর আমাদের ই বা কি অবস্থা ।
সিনথিয়া খোন্দকার
এই সেদিন এক বন্ধু তার ডানপিটে শৈশবের গল্প করছিল। এখনকার বাচ্চারা এমন শৈশবের কথা জানেই না। কল্পনা করাও দুরের কথা। ওদের শৈশব টিভি আর খটোমটো কতগুলো ডিভাইসের স্ক্রীনে বন্দী।
ফরহাদ ফিদা হুসেইন
“ওহ মিস ইয়্যু মিন বলস্!” 😛
ভালো অভিজ্ঞতা হাসতে হাসতে তব্দা খাইয়া গেলাম।
সিনথিয়া খোন্দকার
ওই সময়টা মনে করলে নিজের ভদাই চেহারাটা চোখে ভাসে। 😀
মিসু
আপু হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে গেলাম । আমিও শিক্ষকতা করি । পিচ্চিদের নিয়ে কত যে হাসির ঘটনা ঘটে যা বলে শেষ করা যাবেনা । ঘটনা বর্ননায় আপনি তো সেরাদের সেরা ।
সিনথিয়া খোন্দকার
যে পেইন সহ্য করে একমাস এই বাচাদেরকে পড়াইছি, তাতে আমার লেখক হওয়া বাধ্যতামুলক ছিল। অনেক আগের লেখা, খুঁজে বের করে পড়েছেন এজন্য ধন্যবাদ। 🙂
জিসান শা ইকরাম
লেখাটি নজর এড়িয়ে গেলো কিভাবে বুঝলাম না ।
আপনার মত শক্ত মানুষকে নাকানি চুবানি খাইয়েছে এরা , ভাবলেই তো অবাক লাগে ।
যাক শেষ পর্যন্ত মান সন্মান রক্ষা হইছে ।
সিনথিয়া খোন্দকার
হ্যা ভাই, রাখে আল্লাহ মারে কে?
একটা কথা আছে না ওস্তাদের ও ওস্তাদ থাকে, এই পিচ্চিগুলা ছিল সেরকম।