দৃশ্যপট-০১
ভীষণ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরা আলো যেন স্বপ্নে শুনতে পেলো শিশুকন্ঠ,
– তোমার ছোট ছোট প্রাণীগুলো আমাকে কামড়াচ্ছে!
আলো বলে উঠলো,
– কি কামড়াচ্ছে?
জবাব এলো,
– ঐ ছোট ছোট প্রাণীগুলো!
আলো খেয়াল করে দেখলো, ও মশার কথা বলছে। পিচ্চির পাকনামীতে মজা পেয়ে ওর মাথায় দুষ্টুমি খেলে গেলো, “ছোটই তো! এমন করো কেন?”
পিচ্চি চোখ ছোট করে চেয়ে মুখ ভেঙ্গিয়ে বলে উঠলো, “যাও!”
আলো মুচকি হেসে আবার ঘুমোতে লাগলো।
খানিক সময় পর আবার পিচ্চির কণ্ঠ,
– তুমি কি আজকে ঘুমাইছো?
– হুউউউ, আমি তো ঘুমাচ্ছিইইই! তুমি দেখছো না?
– তুমি ঘুমাচ্চো কেন?
– আমি খুব টায়ার্ড!
“অ!” বলে চুপ! কতক্ষণ পরে__ বেশ রেগে বলে উঠলো কণ্ঠটা…
– এইইই, তুমি ঘুমাও কেন? আজ আমার সাথে খেলবে না?
এক চোখ খুলে আলো ঘুম জড়ানো গলায় বলে উঠে, “আজ তুমি একাই খেলো, কেমন?”
আবার কিছুক্ষণ নিরবতা। পেনসিলে কিছু আঁকার খসখস শব্দ, বই রাখছে ধুপ ধাপ!
আলো বলে উঠে এইবার, “মীম, কি কর তুমি?”
– “উঁ? আমি কবিতা লিখতিশি”! খাতা টেনে মুখে উচ্চারণ করে লিখতে শুরু করলো, “চলে হন হন…ছোটে পন পন…!” একটু লিখে আবার বলে উঠে, “কয় লাইন লিখবো?”
আলো জেগে উঠে বসে বিছানায়। সিরিয়াস কণ্ঠে বলে উঠে, “পুরাটাই লিখ।”
দৃশ্যপট-০২
বছর তিন-সাড়ে তিন বয়সী শিশু, সোহাগ পড়ার টেবিলে বসে ছবি আঁকছে। আলো ওর টেবিলের ধার ঘেঁষে দাঁড়ালো।
সোহাগ বলে উঠলো, “তুমি ভূত দেখছোওও?”
আলো ভয় পাওয়া কণ্ঠে বলে উঠে, “ওরে বাবা! ভূত! না, ভূত দেখিনি! ভূত ভয় করে আমার!”
সোহাগঃ “আমা ভয় করে না! আমি ভূত দিখছি।“
তারপর আর কথা বলে না। চুপচাপ রঙ করে যায়। কিছুক্ষণ পরে, ড্রয়িং খাতাটা বাড়িয়ে ধরে আলোর দিকে, “কি রঙ করবো?”
আলোঃ “তোমার ইচ্ছা!”
সোহাগঃ “এটা কমলা না?”
আলো সরাসরি উত্তর দিলো না। জিজ্ঞেস করলো, “ভাইয়া যে সেদিন কমলা এনেছিলো, তুমি খেয়েছিলে?”
সোহাগঃ “হুঁ!”
আলোঃ “কি রঙ ছিলো ওটা?”
সোহাগ কমলা রঙ এর প্যাস্টেল কালার স্টিকটি বাড়িয়ে দিয়ে উচ্ছ্বল হাসিতে নতুন আবিষ্কারের ভঙ্গীতে মুখে দুষ্টুমি হাসি নিয়ে বলে উঠলো, “এটার মত।“ বলে আর কিছু জিজ্ঞেস না করেই খাতায় আঁকা কমলায় রঙ ঘষতে লাগলো।
দৃশ্যপট-০৩
পত্রিকার পাতায় ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গেলো আলোর;–
“শিশুমন বুঝতে সক্ষম শিশুর সার্বক্ষণিক পরিচর্যার একজন সজীব মনের মানুষ চাই। আগ্রহী ব্যক্তিরা ০১৭৩২…… নম্বরে সাত দিনের মধ্যে যোগাযোগ করুন। মহিলা প্রার্থী অগ্রগণ্য।“
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে নাম্বারটায় ফোন দিলো ও;—
ওপাশ থেকে কথা বলে উঠলো একজন তরুণ কণ্ঠ!
তুষার বলছি। তুষার আব্দুল্লাহ!
আলোঃ “হ্যালো, আজকের নয়া দিগন্তের শেষ পাতার একটি বিজ্ঞাপন দেখলাম।“
তুষারঃ “হ্যাঁ। আপনি কি কাজটি করতে আগ্রহী?”
আলোঃ “কাজটা ঠিক কি ধরনের যদি বলতেন!”
তুষারঃ “আপনি কোত্থেকে বলছেন?”
আলোঃ “ঢাকা থেকে।“
তুষারঃ “আপনি কাজটি করবেন কি-না তা ভেবে নিন।“
আলোঃ “আমার আগ্রহ আছে। কিন্তু যশোরে আমার থাকার জায়গা নেই।“
তুষারঃ “আপনাকে আলাদা কোথাও থাকার প্রয়োজন নেই, ম্যাডাম।
সার্বক্ষণিক লোক চেয়েছি আমরা।“
দৃশ্যপট-০৪
টেবিলের ওপাশে বসে আছেন চোখে মুখে আশ্চর্য্য নির্ভরতা জড়ানো চৌত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী একজন যুবক।
আলোর সাক্ষাতকার পর্ব চলছে।
তুষারঃ “মিস রায়হানা আলো, আপনি এখন যেখানে বসে আছেন এই বাড়িটা আমার বাবার। তার সাথে অভিমান করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলাম। আমার দূর্ভাগ্য, তাঁর জীবদ্দশায় ফিরে আসা হয়নি। একমাত্র সন্তান আমি। বাবাও ছিলেন এই পৃথিবীতে খুব একা। এখন আমিও।“ এই পর্যন্ত বলে একটু শ্বাস ছাড়লেন। একটু থেমে আবার বলে উঠলেন,
“আমি এইখানে অনাথ শিশুদের জন্য একটা স্বর্গ গড়তে চেষ্টা করেছি। এখন একজন মা দরকার এদের জন্য!”
কিশোর বয়স হতেই পিতৃহীনা আলোর মনে সব সময় শিশুদের জন্য আবেগ একটু বেশি। পথ চলতে ফুটপাতে শুয়ে থাকা অসহায় গরিব শিশুদের দিকে তাকালে ওদের জন্য কিছু করার খুব ইচ্ছে হয় ওর। কিন্তু, কারো সাহায্য ছাড়া একা কি করে সম্ভব! এইরকম একটি কাজের অফার পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করলো।
আলো জবাব দিলো, “এই পৃথিবীতে আপনজন বলতে আমি আর আমার অসুস্থ মা। আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে তাকে আমার কাছে এনে রাখতে চাই।“
তুষার আব্দুল্লাহ দ্বিমত করলেন না। রাজী হলেন। এরপর আলোকে বললেন, “চলুন আপনাকে আমার শিশু-স্বর্গ দেখিয়ে নিয়ে আসি।”
দৃশ্যপট-০৫
আলো শুয়ে আছে খোলা জানালার পাশে একটা সিঙ্গেল খাটের উপরে। বুকের কাছে বালিশ মুচরে রাখা। সামনে একটা ডায়রী। ওতে কিছু লিখছে ও। এই পোড়া পৃথিবীতে ওর কেউ নেই। বছর কয়েক আগে একমাত্র মাও গত হয়েছেন। এখন সকল না বলা কথা শুধু এই চৌকোন সবুজ ডায়রীকেই বলা যায়।
আলো কবিতা লিখতে খুব ভালোবাসতো। অনেকদিন পরে এই অভ্যেসটা আবার জেগে উঠেছে।
ও উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুজে লিখতে লাগলো,
‘পাতা ঝরে যায় ঝরুক
তবু গাছ তো বেঁচেই আছে
শুকনো হলেও তারি মাঝে পাবে
বাঁচার সে স্পন্দন।
শুকনো ডালেতে দু’হাত বাড়িয়ে
রয়েছে আকাশ পানে
সূর্য ওঠার শুভ লগ্নেরে
জানায় সে অভিনন্দন।।
পথ দূর্গম জানি হবে
তবু আমরা যে নির্ভীক
বিন্দুমাত্র হতাশা এনো না বক্ষে।
জেনে নিয়েছি যে পথ দূর্গম
হোকনা যতই বন্ধুর
এ পথে হাঁটলে নিশ্চয়ই যাবো লক্ষ্যে।।
মনের সকল জড়তা কাটাতে
নিতে হবে আজ দৃঢ়তা,
হতে হবে আজ নির্ভীক প্রাণদানে
শত্রু মেঘেরা ঠেঁকাতে পারে না
সূর্য ওঠার লগ্ন
বুকের রক্ত ঢেলে সূর্যকে
আনবো সসম্মানে’…
এই পর্যন্ত লিখে আলো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। দরজাটা ফাঁক হতে শুরু করেছে। কপাট খুলে বাচ্চার মিছিল ঢুকে পরে ওর ছোট্ট ঘরটায়। ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে যায়। সবগুলো বাচ্চা ঢুকে যাওয়ার পরে দরজায় উঁকি দেয় একটা বড় ফুলের তোড়া। আলো ভাবে, “ভাইয়া এসেছে!” ভাবতে ভাবতে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়।
ফুলের তোড়ার পেছন দিয়ে বেরিয়ে আসে একটা পরিচিত মুখ! তুষার ভাই! শিশু স্বর্গ প্রতিষ্ঠাতা! ওর আশ্রয়দাতা। ওর বর্তমান অভিভাবক হয়ে ওঠা একমাত্র ভাই!
মুখে ঝলমল হাসিতে বলে উঠেন তুষার ছোট্ট করে, “শুভ জন্মদিন, রায়হানা!”
বাচ্চারা সবাই মিলে জন্মদিনের গান গেয়ে উঠে সমস্বরে… হ্যাপি বার্থডে টু ইউ…
— সমাপ্ত —
৬টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি
অনাথ বাচ্চারা ভরসা পায় তূষরের মত মানুষ আছে বলে।সুন্দর গল্প।
হালিম নজরুল
মানুষেরা পাশে দাঁড়াক অন্য সকল মানুষের।
মোঃ মজিবর রহমান
মানুশ মানুষের পাশে থাকুক, ভালো লাগল।
হালিমা আক্তার
মানুষ মানুষের জন্য। সবাই না দাঁড়াক । কেউ না কেউ পাশে এসে দাঁড়াবে। তাই তো পৃথিবী আজও সুন্দর।
নার্গিস রশিদ
সুন্দর প্রকাশ ।
আলমগীর সরকার লিটন
হু লেখেছেন বটে ঠিক আগের মতো যূথী আপু কেমন আছেন দোয়া করি আরও ভাল থাকবেন সব সময়