আমি তোমার জন্য এসেছি (পর্ব – সতেরো)

-মা আপনি কেক পিঠা নেন নরম খেতে ভালো লাগবে। দেখ দেখি ছেলের কান্ড! এতক্ষন বললো কয়েক প্লেট পায়েস খাবে এখন দেখছি এখনো পায়েস মুখেই দেয়নি। শোন এটা শেষ করো ভিতরে আরো আছে আমি পরে নিয়ে আসছি, বলেই আরাফের দিকে নুডলস এগিয়ে দিল মিরা।

-আরে নাহ্! আন্টি এত খাওয়া সম্ভব না।
ফ্রিজে রেখে দিন, আমি পরে খাব। আরে তোমাদের বয়সে লোহা খেতে হজম করতে পারতাম! আর তোমরা এই বয়সে এসব কি বলো! সব খেতে হবে বলে দাদুমনি হাসলেন।
আরাফ,আজাদ সবার মুখে হাসি, মিরা হাসতে হাসতে প্রিয়াকে আনতে গেল।

আচ্ছা তোমরা গল্প করো আমি একটু বাজারের দিকে যাব। আরাফ তুমি আজ যেতে পারবে না,
কাল সকালে যাবে বলেই ওঠে দাঁড়াল আজাদ। আচ্ছা চল তোমাকে বাজারের লিস্টটা করে দেই বলেই মিরা আজাদের পিচু নিল।

প্রিয়া তখন থেকে চুপচাপ একবারও আরাফের দিকে ফিরে তাকাল না। দরকার ছাড়া কোন কথা বলছে না। তখন থেকে খেয়েই চলছে মনে হচ্ছে, সারাজীবন কিছুই খায়নি। আজ প্রথম খাচ্ছে রাক্ষস কোথাকার ভিড় ভিড় করে বললো আরাফ প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে।

মানে কি মিরা! সকালে এত বাজার করলাম বলে রাগারাগি, অভিমানের শেষ নেই আমি তো ভাবলাম আগামী ১বছর বাসায় কোন বাজার লাগবে না। আর বিকাল না হতেই তুমি বাজারের লিস্ট করতে বসেছো! আজাদের কথায় দাদুমনি প্রিয়া হাসতে শুরু করলো। আরাফ বোকার মতো সবার মুখ চেয়ে দেখছে কি বলবে সে বুঝে ওঠতে পাচ্ছিল না। তাই মিরা আন্টির দিকেই চেয়ে রইল কারন প্রশ্নটা তাকেই করা তিনিই জবাবাটা দিবেন।

বাজার তো লাগবেই অবাক হওয়ার কি আছে আমি তো বুঝলাম না। বাড়িতে এত বছর পর পরিবারের বড় ছেলে আসছে তার জন্য ভালো মন্দ রান্না করতে হবে না? মিরার কথায় বুঝতে পারল আরাফকে তারা পরিবারের একজন মনে করে মিরা আন্টি। খুশিতে তার মনটা ভরে গেল আরাফ শ্রদ্ধার চোখে মিরার দিকে চেয়ে রইল।
বউমা ঠিকই বলছে বাবা তুই যা, সকালে বাজার করলে তা আমাদের জন্য ঠিক আছে। কিন্তু আরাফ মেহমান তার জন্য আলাদা বাজার করতে হবে বলে আরাফের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন দাদুমনি।
আচ্চা তাহলে আমি ওঠলাম আর বলতে হবে না চল মিরা কাজে লেগে যাও, হুম প্রিয়া খাবার শেষ করে প্লেট গুলো কিচেনে নিয়ে এসো আমি গেলাম বলেই মিরা আজাদ রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

আরাফের মনে চিন্তা একটাই প্রিয়াকে তার মনে কথা জানানো আর সেই কারনেই ময়মনসিংহে আরাফের আগমন।

আরাফ তোমার বিয়ের কি খবর পছন্দ আছে নাকি আমাদের খোঁজতে হবে!বলেই মুচকি হাসলেন দাদুমনি।

মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! এমন কিছুই দাদুমনিকে বলতে চায় আরাফ। হঠাৎ আরাফের মোবাইলটা বেজে উঠে।-হ্যালো বলতেই শীলা

-আজ আমাকে তন্ময়ের বাবা মা রিং পড়িয়ে গেছে! আগামী শুক্রবার বিয়ে।গুড নিউজ। আর কিছু বলবো না বাকিটা তোমার দায়ীত্ব। অভিনন্দন দোস্ত।শীলা ধন্যবাদ! দিয়েই লাইন কেটে দিল

-বিয়ে বলে কথা মন তো এখন পাখির মতো ওড়বে।রঙিন স্বপ্ন দেখবে,নতুন মানুষ কাছে টানবে আরাফের সাথে কথা বলার সময় কই শীলার! সে তো হবু বরের সাথে কথা বলবে ভাবতে ভাবতে মিরা আজাদকে বাজারে পাঠিয়ে রুমে চলে আসলো।

প্রিয়ার আবদান দাদুমনির কাছে অনেকদিন গল্প শোনা হয় না আজ সে গল্প শোনবে। আরাফও প্রিয়ার সাথে যোগ দিল সেও গল্প শুনবে দাদুমনির বয়স হয়েছে এখন সবকিছু স্বরন থাকেনা। তোমরা আধুনিক মানুষ আমরা সেই পুরনো যুগের মানুষ কি গল্প বলি বলতো!

প্রিয়ার বয়সে আমরা স্বামী,সন্তান নিয়ে সুখের সংসার করতাম!আর তোমরা পড়াশোনা করো বলেই মুচকি হাসলেন দাদুমনি।

আরাফের কৌতুহল বাড়ল দাদুমনির আপনার ছোটবেলার গল্প বলুন শুনি,আচ্ছা মা আরাফ এত করে যখন বলছে!একটা গল্প বলেই ফেলেন।আমরাও শুনি বলেই প্রিয়ার পাশেই বসে পড়লেন মিরা।

শোন তাহলে! আরাফ একটু নড়ে চড়ে বসল গল্প শোনার জন্য। প্রিয়া আধ শুয়ে মায়ের কাঁধে মাথা রাখল,মিরাও মনযোগ দিল শ্বাশুড়ী মায়ের দিকে।আমার বাবা ছিলেন জমিদার ৫০০ বিঘা জমির মালিক একই গ্রামে আজাদের দাদার বাড়ি। দু-জনের খুব বন্ধুত্ব সেই বন্ধুত্বকে চিরস্থায়ী করতে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলে মেয়ের বিয়ে দিবেন।

সেখানে অবশ্য আমার মাযের অমত ছিলো কারন তখন আমার বয়স মাত্র ৭ বছর এই বয়সে তিনি মেয়ের বিয়ে দিবেন না যদিও ওই সময়ে ৭-১২ বছরের মেয়েদের অহরহ বিয়ে দেওয়া হতো সমাজে। বর্তমান সরকার এটাকে বাল্যবিবাহ্ বলে বন্ধ করেছে,কিন্তু সামাজিকতা মেনে এই বয়সে ধর্মের দোহাই দিয়ে তখন বিয়ে চলতো।

বাবা মায়ের নিষেধ না মেনেই ওই বয়সে মেয়ের বিয়ে দিলেন,শ্বশুড় হওয়ার লোভটা তাকে ঘিরে ধরলো! কয়েক দিনের কথায় বিয়ে ঠিক হলো। আচ্ছা দাদুমনি বিয়ের আগে তুমি দাদাকে দেখেছিলে বললো প্রিয়া, নাহ্! আমি ওনাকে দেখি নাই তবে ওনি আমাকে দেখে পছন্দ করেন।তারপর কয়েক গ্রামের লোক সেই বিয়েতে পেট ভরে খেল খুব ধুমদাম করে আমার বিয়ে হয়ে গেল।

আমি বিয়ের পর বাবার বাড়িতেই ছিলাম প্রায় ৪বছর সেই সময় আজাদের বাবা, দাদা, ফুটি,চাচারা আমাকে দেখতে যেতেন। আমিও শ্বশুড়বাড়ী আসতাম বাবার কোলে চড়ে বা কখনো শ্বশুড়ের কাঁধে চড়ে।সেখানে শ্বাশুড়ী মা মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন।

দাদুমনি! বলো কি? তুমি শ্বশুড়ের কাঁধে চড়তে? হ্যাঁ ছোট তো বুঝতাম না তারা সবাই খুব স্নেহ করতেন, তাই কোলে করেই নিতেন। চৈত্র মাসে আকাশের প্রকর রৌদ সবকিছু ছাড়-খার করে দিত জমিতে খড়া দেখা দিত। মাটি গরম হয়ে যেত বালিতে হাঁটলে আমার পায়ে ফোঁসকা পড়বে তাই বাবা কোল থেকে নামালে। মাটি স্পর্শ করার আগেই শ্বশুড় কাঁধে তুলে নিতেন, এভাবেই আমি নায়িওর যেতাম।

মা আপনি এখনো যা সুন্দর! না জানি তখন আরো কত সুন্দর ছিলেন! মিরার কথা শুনে শ্বাশুড়ী মা বললেন। তোমার শ্বশুড় বলতেন ৫ গ্রামে তখন আমার চেয়ে সুন্দরী কোন নারী বা মেয়েছিলো না।আমার গায়ের রং দুধে আলতা বর্নের ছিলো এখন তো বয়সের ছাপ পড়ছে আগের সুন্দর নেই বউমা।

দাদুমনি আপনি তো দাদার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট ছিলেন ভালোবাসা ছিলো বুঝতে পারছি, আপনারা কখনো ঝগড়া করতেন না?দাদুমনির হাসি যেন আর থামছিলো না, কিছুটা লজ্জাও পাচ্ছিলেন। শোন

তখন কার দিনের একটা ঘটনা তোমাদের বলি, বিয়ের পর শ্বশুড় বাড়িতে বেড়াতে আসলাম। আজাদের বাবা বললেন মিরাজ (আজাদের বাবা) যাও গাছ থেকে আম পেরে আন। তোমার মা কাঁচা,মরিচ,ধনিয়া পাতা দিয়ে ভর্তা করবে গরমে খেলে রোদ থেকে সস্তি পাওয়া যাবে শীররটা ঠান্ডা হবে।

মিরাজ বললো পোলাপাইন নিয়ে আমি যেতে পারব না, পরে দুষ্টুমি করলে আমার মেজাজ ঠিক থাকবে না! মাইর দিব। আমি শ্বশুড় বাবার কানের কাছে ভেন ভেন করতে থাকলাম আমিও আম কুড়াতে যাব।

শ্বশুড় বাবা জোর করেই মিরাজের সাথে আমাকে আম কুড়াতে পাঠালেন বলেন দাদামনি থামলেন। বাকিটা শোনার জন্য প্রিয়া আরাফের আগ্রহ বাড়ল বাকিটা বলো দাদুমনি দুজনেই একসাথে বললে আরাফ,প্রিয়া।

তারপর শোন কি হলো! তোমাদের দাদাভাই বাঁশের কঞ্চি দিয়ে আমের ঝোঁপে বারি দিচ্ছিলেন আর নিচে আম পড়ছিলো। আমার ননদী, দেবর সহ সবাই আম কুড়ালাম।

ননদী, দেবর ওরা আলাদা ঝুড়িতে আম রাখল আমিও আমার জামার  মধ্যে যা কুঁড়াচ্ছি সব গুজে নিলাম।

উপরে চেয়ে দেখি আজাদের বাবা আমার দিকে খেয়াল নেই, সে আম পাড়তে ব্যস্ত। আমি সব আম নিয়ে সোজা দিলাম দৌঁড় সেটা আজাদের বাবা কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখে ফেলে। সেও গাছ থেকে নেমে আমার পিচু নেয় তাকে দেখা মাত্র আমার দৌঁড়ের গতি বাড়লো।

থামলাম না সেও পিচনে ডাকতে শুরু করলো বউ দাঁড়াও! যেও না, ফিরে এসো আম ভর্তা করে আমরা সবাই খাবো। তুমি আম নিয়ে পালাচ্ছো কেন? এগুলো আমার আম বলে আবার দৌঁড় দিলাম। এসবে আমার কান নেই আমি যেগুলো কুঁড়িয়েছি তা সব আমার! সোজা বাপের বাড়িতে গিয়ে থামলাম।

আব্বা আমাকে দেখে তো ভিষন খুশি কে নিয়ে আসছে! আমি মায়ের সামনে চুরি করে আনা সব আম ঢেলে দিলাম। মা মরিচ,ধনিয়া পাতা দিয়া ভর্তা করো আমি খাব।

এদিকে শ্বশুড় বাড়িতে বউ,জামাই পাওয়া যাচ্ছে না। শ্বশুড় বাড়ি থেকে খোঁজতে বেরুলেন কারণ আমি আর তোমার দাদা যে পালিয়েছি তা কেউ খেয়াল করে নাই।

যাইহোক আমি বাড়ি আসতেই সাথে সাথে তোমার দাদাও এসে হাজির। আমি মাইরের ভয়ে মায়ের আঁচলে আশ্রয় নিলাম যদিও জানি মারবে না। তবু বার বার মনে হচ্ছিল ওই যে শ্বশুড় বাবার সামনে বলছিলো। ওরা দুষ্টুমি করলে মেজাজ খারাপ হবে পরে মাইর দিব।

আরে জামাই বাবা যে বাড়ির ভিতরে আস, কই তোমরা বাড়িতে জামাই আসছে দেখ বলেই আব্বা মিরাজকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।

মিরাজের মাথা গরম আম চুরি করছি বলে! আপনার মেয়ে একটা চোর! আমি বলছি আম ভর্তা করে দিব তবু আম কুঁড়িয়ে সব নিয়ে বাপের বাড়ি পালাল। আম্মু আঁচলে মুখঢেকে হাসলেন বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করেছ এবার বুঝ ঠেলা!

আমিও হাসছি মায়ের আঁচলে নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে।

বাবা এভাবে বলতে হয়না! মেয়েটা ছোট মানুষ ওর…

….চলবে।

 

৬২১জন ৫১৮জন
0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ