আমাদের সমাজে একজন তালাকপ্রাপ্ত নারীকে কতোখানি সামাজিক প্রতিকূলতা ও বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ আমি নিজেই। একজন নারী বা একজন পুরুষের জীবনে বিভিন্ন কারণে তালাক হতে পারে! প্রথমত পুরুষ যেমন তালাক দিতে পারে, তেমনি নারীও দিতে পারে। কিন্তু কথাটা হচ্ছে, তালাকপ্রাপ্তা নারী। কই, কেউ তো বলে না, তালাকপ্রাপ্ত পুরুষ!
সামাজিকভাবে এই অপবাদটা নারীর কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে তাকে দুশ্চরিত্রা বলে কোণঠাসা করে রাখার একটা প্রবণতা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।
একজন তালাকপ্রাপ্ত নারী বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে বাড়িওয়ালা যদি শুনতে পারে মেয়েটির স্বামী নেই, ব্যস শুরু হয়ে গেলো জেরা, স্বামী নেই ভাড়া কীভাবে পরিশোধ হবে, সাথে কে কে থাকবে, বাসায় কোনো পুরুষ আসবে কিনা, এরকম নানান প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে মেয়েটিকে প্রায় ‘বিবস্ত্র’ করে বাড়ি ভাড়া না দিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ডিভোর্সি নারীর এই সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর কোনো অধিকার নেই।
আরেকটা শ্রেণী আছে, যারা আমাদের মতো নারীদের চুলচেরা বিশ্লেষণে মশগুল থাকেন। আমার করুণা হয় সেইসব নারীদের জন্য, যারা ‘হাউজ ওয়াইফ’ নামধারী একেকজন শিক্ষিত বুয়া! এরা সমস্ত শিক্ষা আর আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিয়ে নিজেদের স্বামী সোহাগিনী ভেবে খুশিতে গদগদ হয়ে দিনশেষে শান্তির ঢেকুর তুলে ডিভোর্সি নারীর হাঁড়ির সন্ধান নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই শ্রেণীর পুরুষ ও নারীদের প্রধান কাজই হচ্ছে, নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো এবং এই মহৎ কাজটা তারা করে থাকেন খুব আনন্দের সাথে।
অন্যের হাঁড়ির খবর নিতে গিয়ে নিজেদের শাড়ী এবং লুঙ্গির গিঁট্টু যে কখন খুলে গেছে, সেই খবরটাও তারা বেমালুম ভুলে যায়। এদের ঘরে হাজারটা সমস্যা থাকলেও তারা অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক ডুবিয়ে দুর্গন্ধ খুঁজতে খুব ভালোবাসে।
এই শ্রেণীর মানুষের প্রধান কাজই হচ্ছে একলা থাকা নারীর হাঁড়ির খোঁজ নেয়া। আচ্ছা, এই যে নারীরা একলা থাকেন, তাদের কি কোনো ভাই, বন্ধু, মামা, চাচা, খালু থাকতে নেই? তারা কি খোঁজ নিতে আসতে পারে না তাদের মেয়েটির? কেউ একজন বাসায় এলেই কিছু মানুষ শকুনের মতো লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ইট, কাঠের দেয়াল ভেদ করে তাদের কাঙ্খিত কুরুচিপূর্ণ চিন্তার বীজ বপন করে। সম্ভব হলে আরো দুই জোড়া চোখ ধার করে নিয়ে আসে বাড়তি নজরদারির জন্য।
যেই সমাজ আমাকে খেতে, পরতে, পড়তে দেয় না, আমার ব্যথায় ব্যথিত হয় না, সেই সমাজের কিছু মানুষের অগ্নিদৃষ্টিতে ভস্মীভূত হয়ে প্রতিনিয়ত সততার প্রমাণ দিতে হয়। কেন?
যুগে যুগে সীতাদেরই কেন অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে তার সতীত্বের? আমার ঘরে কে এলো, কেন এলো, সেই খবর নেয়ার লোকের সংখ্যা অগনিত। দীর্ঘ বারোটা বছর এই আমি দুই মেয়ে আর বৃদ্ধা মাকে নিয়ে কতোটা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি, কত বেলা অর্ধাহারে, অনাহারে কাটিয়েছি তার খোঁজ কেউ রাখেনি কখনো, কোনদিন।
একজন একা মেয়ে যদি দরজা বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে, ইবাদাতরতও থাকে, তাও কিছু মানুষের মনে নোংরা চিন্তাই উঁকি মারে।
অথচ যে পুরুষ সন্তানসম্ভবা স্ত্রী রেখে অন্য নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়, স্ত্রী সন্তানের প্রতি সমস্ত দায়িত্ব ভুলে গিয়ে রঙ্গলীলা করে বেড়ায়, তবুও তারাই সৎ! ডজনখানেক মেয়ের সাথে শুয়েও পুরুষদের কোনো কলঙ্ক হয় না, কারণ তাদের তো সতিচ্ছদ নাই, তাই সতীত্ব হারোনোরও ব্যাপার নাই। যত দোষ সব নারীর!
আমরা নারীরা যে জন্মের সময় একখান সতিচ্ছেদ নিয়ে জন্মেছি, তাকে পাহারা দেয়ার দায়িত্বভার এই সমাজের কিছু নোংরা মানুষ স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়ে অবলীলায় মেয়েদের দুশ্চরিত্রা আখ্যা দিয়ে তাদের গৃহবন্দী করে রাখার কাজটা করে আসছে খুব সুচতুরভাবে। আমরা নারীরা কবে সমাজের এই নোংরা আর বিকৃত রুচির মানুষ নামধারী অমানুষগুলোর হাত থেকে রেহাই পাবো? কবে আমরা নারী থেকে মানুষে উত্তীর্ণ হবো? খুব কষ্ট আর ক্ষোভ থেকে কথাগুলো লিখলাম আজ।
২০টি মন্তব্য
ইঞ্জা
আপনার প্রতিটি কথা খুবই সত্য, আমরা এতোই খারাপ নারী সে নারী হওয়ার আগে যে একজ মানুষ তা ভুলে যায়, আমরা মুখে যায় বলিনা কেন, আমরা নারীদের এখনো সম্মান দিতে শিখিনি, যা খুবই দুঃখজনক।
এঞ্জেল সাঁকো
কথাটা অপ্রিয় হলেও সত্যি, আমারা নারীরাই আরেকজন নারীর সত্রু!
ইঞ্জা
জ্বি আপু
নীলাঞ্জনা নীলা
দেশ আর বিদেশ, আমাদের বাঙ্গালী নারীদের অবস্থান একই। এখানে দেখেছ যদিও বাড়ী ভাড়া নিয়ে সমস্যা হয়না। কিন্তু আলোচনা হয়। আমারই পরিচিত উনার স্বামী চরিত্রহীন, উনি আত্মসম্মান রক্ষার্থে ওই লোকটাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন। আর কিছু বলতে চাইনা।
“ডিভোর্সি” শব্দটাকে নিয়ে কতো যে হাস্যরসের তৈরী করে এরা, ঘেণ্ণা ধরে যায়।
এঞ্জেল সাঁকো
অনেকটা কাটখড় পুড়িয়ে আজ এই পর্যন্ত এসে পৌঁছাইছি ! নিন্দুকের কাজই হচ্ছে নিদা করা! তাইবলে থেমে থাকিনি, থেমে থাকবোনা।
সমস্ত বাধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে চলার নাম জীবন! দোয়া করবেন আমার জন্য।
এঞ্জেল সাঁকো
বাঙালি নারীদের কাজই হচ্ছে স্বামীর খেয়ে অন্যের ব্যাক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো। সে দেশেই হোক আর বিদে!! কয়লা ধুইলে ময়লা যায়না!
নীলাঞ্জনা নীলা
আপনাকে স্যাল্যুট।
মায়াবতী
অদ্ভুত লিখেছেন বোন * আপনি খুব সাহসি একজন নারী আপনি নিজের মনের গহীনের কথা গুলো অনায়াসে লিখে ফেলেছেন কিন্ত আমাদের সমাজে ক টা মেয়ে পারে শুধু কলম দিয়ে ই নিজের অধিকারের কথা টুকু অন্তত লিখতে বলেন * নিজেকে একদম একা ভাববেন না বোন , এমন সাহসি মনোভাব নিয়ে সামনে এগিয়া যেতে থাকেন ইনশাআল্লাহ্ আপনি অনেক অনেক ভাল থাকবেন আগামীতে । ভাল থাকুন সব সময় (3 -{@
এঞ্জেল সাঁকো
সময় করে আমার লেখাটা পড়ার জন্য অশংখ্য ধন্যবাদ 🙂
অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে কলম ধরতে না পারলেও অন্তত মৌখিক প্রতিবাদ করা উচিত!
কয়েকবার প্রতিবাদ করলেই একসময় প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। ভালো থাকবেন।
শুন্য শুন্যালয়
ডিভোর্সি মেয়েদের প্রতি আরেকজন নারীর ভাবনাচিন্তাই তো প্রকাশ করার মতো নয়, পুরুষের কথা আর কি বলবো। বাংলাদেশের মতো কনসারভেটিভ এবং মীন মাইন্ডে ভর্তি মানুষগুলোর মধ্যে থেকেও আপনি কিভাবে এগিয়ে যেতে পারছেন, সেটা দেখেই তো অবাক হচ্ছি। তাও আবার কারো সাপোর্ট ছাড়াই।
আপনি আসলেই সাহসী নারীর নিদর্শন। ইন্সপায়ারিং। ‘
এঞ্জেল সাঁকো
মুল্যবান মন্তব্যর জন্য অশংখ্য ধন্যবাদ 🙂
আসলে বাংলাদেশের সবাই কিন্তু খারাপ নয়! প্রতিটি দেশেই ভালো এবং খারাপ মানুষ আছে।
তবে আমার মনে হয় দুনিয়াতে ভালো মানুষের শংখ্যাই বেশি! ভালো মানুষেরা ধরাছোঁয়ারর বাইরে থাকে বলেই খারাপদের দাপোট বেশি।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
এ সমাজের বাস্তবতা খুবই কঠিন বিশেষ করে নারীর বেলায়। কিছুই বলার নেই শুধু লজ্জিত আমি পুরুষ বলে।আপনার মা সন্তানের ভাল থাকুক এই কামনা বোন।
এঞ্জেল সাঁকো
দোয়া করবেন। আর লজ্জিত হবার কিছু নেই। এই পৃথিবীতে কিছু ভালো মানুষ এখনো আছে বলেই পৃথিবীটা এখনো টিকে আছে!
জিসান শা ইকরাম
লেখার প্রতিটি কথাই সত্যি।
নারী তার স্বামীকে ডিভর্স দিলেও নারী হয় ডিভোর্সি, কেউ বলেনা ডিভোর্সি পুরুষ। শুরুতেই এমন গলদ সম্মোধনেই।
নারীর প্রতি এই দৃষ্টিভংগী আর পাল্টাবে বলে মনে হয়না, বরং দিদদিন পিরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে।
আপনাকে স্যালুট যে আপনি সমাজকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে একা চলতে পারছেন।
এঞ্জেল সাঁকো
একজন বিধবা নারীকে তাও কিছুটা সম্মান দেয় আমাদের এই সমাজ। কিন্তু ডিভোর্সিদের ক্ষেত্রে একেবারেই বিরুদ্ধাচরণ করে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ। “ভাইজান “লেখার প্রতিটা কথা আমার জীবনে ঘটেছে! এখনো আমাকে প্রতিনিয়ত সততার প্রমান দিতে হয়। আমার বাড়িতে পুরুষ আত্মীয়স্বজন আসলে কৌতূহলী লোকের আনাগোনা বেড়ে যায় বাসার সামনে 🙁
মোঃ মজিবর রহমান
এটা সমাজের সৃষ্টি লগ্ন থেকেই হয়ে আসছে। সহজে সমাজের নিয়ম কানুন বদলায় না, সব কিছুর দুইটি দিক আছে এক্টাই বেশি প্রচলিত হয়। যে ভাংতে পারে তাঁরা সমাজ পরিবর্তনের অগ্রনী ভুমিকা রাখে।
কথা বলার মানুষ আছে কিন্তু ব্যাথায় ব্যাথিত না হয়ে সুযোগ পেলে ফাল হয়ে ধিক্কার দেয়।
এঞ্জেল সাঁকো
নিন্দা করার মানুষ আছে, ব্যথায় ব্যথিত হওয়ার মানুষ খুব কমই আছে।
মোঃ মজিবর রহমান
(y)
মৌনতা রিতু
আমার প্রশ্ন সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে রেখে পুরুষটি তো সেই একটি নারীর সাথেই পরকিয়া নামক বস্তুটি করে বেড়াচ্ছে। আমি তো বলি নারীই নারীর শত্রু। তবে আপনি একজন যোদ্ধা আমি শুধু তাই বলব।
হুম, ডিভোর্সি শব্দটাতে আমার খুব আপত্তি। আমার কেনো যেনো মনে হয়, যারা সন্তানকে একটা ভালবাসার বন্ধনে বেড়ে উঠতে দিতে অক্ষম তাদের গুলি করে মেরে ফেলে দেই। দরকার কি তাইলে সন্তান ধারন করার? বা একটা পেটে তার ঐরশজাত সন্তান দেবার? আমার কাছে একটাই কথা, তুই যাই করিস না কেনো, ঘরে তোকে ফিরতে হবে। ছোবল মারতে না পারি ফোঁস করব ঠিকই। পালানোর কোনো রাস্তা নাই। থাকতে তোকে হবেই। সন্তান শুধু আমার একার না,তুই দিছিস কেনো। দায়িত্ব তো তোকে ব্যাটা নিতেই হবে।
একেকজনের একেক ভাবনা। এটাই সমাজ আসলে।
বালো থাকুন, সাহসি হোন আরো ফোঁস করার পাশাপাশি ছোবল মারুন দরকার হয়।
এঞ্জেল সাঁকো
আপনার কথায় যুক্তি আছে! আমিও সবসময় বলি একজন নারীই আরেকজন নারীর বড় শত্রু! এবং সে কিন্তু পরকিয়া করেছে আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবির সাথেই। সেইসময় সবাই আমাকে বলেছিলো ধৈর্য ধরো তোমার স্বামী তোমার কাছে ফিরে আসবে। এবং আমি ধৈর্যধারণ করে ছিলাম ও! কিন্তু তাকে ফেরানো যায়নি। একটা সময় সে অস্বীকার করতে শুরু করলো , মেয়ে তার না! এরপর আমার আর রুচিতে কুলায়নি সেই লোকের ফিরে আশার অপেক্ষায় থাকার! সে পুরুষ হয়ে জন্মেছে বলেই যা খুশি তাই করে ক্ষমা পেয়ে যাবে তা কিন্তু নয়! সে যদি আমাকে পরিত্যাগ করে অন্য নারীতে আসক্ত হতে পারে তাহলে আমি কেন তার ফিরে আশার অপেক্ষায় থাকবো? আল্লাহ্ আমাকে সুন্দর দুইটা হাত দিয়েছে কাজ করে খাওয়ার জন্য, সুন্দর দুইটা চোখ দিয়েছে ভালোমন্দ দেখে বিবেচনা করার, সর্বোপরি ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তান দিয়েছে যে সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে ওর মতো লম্পট স্বামীকে হাসতে হাসতে পরিত্যাগ করা যায়। এবং আমি তাই করেছি। আপনাদের দোয়ায় মেয়েকে নিয়ে অনেক অনেক ভালো আছি 🙂