
ভালোবাসার জন্যও বোধকরি পরিবেশ দরকার হয়। পাশের মানুষটা কতোটা প্রিয় এ মুহূর্তে সেটা আঁচ করা মুশকিল হয়ে পরেছে। তার হাসিমুখেও রোমান্টিক আবহ নেই।
বসে আছি দুপুর ৩.০০ টা থেকে। তিনি নাকি আসেন ৪ টায়। আমার সিরিয়াল আনলাকি ১৩।
দুজন সহকারী পাশে পাশে- এই সরেন; সরেন ম্যাডাম আসছে। ৫.৩০ এর পর তিনি এলেন।
সবার প্রতিক্ষিত মুখ উজ্জল মখমলি আভায় ভরে গেল। ডাক্তার আমাদের কতোটা প্রয়োজনীয় এবং পছন্দের অসুস্থতায় বোঝা যায়।
ল্যাব এইডে প্রচন্ড গরমে এসি ছাড়া শত মানুষের ভীড়। কেউ কেউ বলছে, সবকিছু তো ঠিকমতোই নেয় তাহলে এসি বন্ধ কেন? শরীর ঘেমে কোথাকার পানি কোথায় নামছে তার ঠিক নেই। এসময় ব্রেইনকে অন্যকাজে লাগিয়ে বিরক্তি কমানোর চেষ্টা করাই ভালো! তাই আমি চোখা নাকের কাট কাট চেহারার সহকারী অধ্যাপক এর বয়স ৪০ ছেড়ে গেছে কিনা সেটা নিয়ে বসে বসে গবেষণা করছি।
তিনি শুরু করলেন বায়োপসি স্যামপল কালেকশান দিয়ে। সেটা শেষ করে ৬.৩০ এর দিকে নতুন সিরিয়াল শুরু করলেন। তার সহকারীদের সাথে আবার কথা বলতে হয় নরম গলায় না হলে সিরিয়াল কেটে অন্যজায়গায় নিয়ে যেতে পারে। ডাঃ এর সহকারীর ঘুস লেনদেন নাকি এখন ৩০০ তে পৌঁছে গেছে। তো, সহকারীরা যাদের থেকে ঘুস নিয়েছে তারা অবশ্যই অগ্রাধিকারে আগে ঢুকবে।
সাতজনের বিরাট বড় দলটি সবার আগে ঢুকলো। আমার মাথায় কুলায় না, এতো লোক কেন এসেছে ?
মায়ের বয়স ৫৫ এর ঘরে তবে বেশ তাগরা চেহারা। মা ৭০ এ কোটায় আসতে আসতে ছেলেমেয়েরা আর কি দলবেঁধে মায়ের সাথে আসবে? বাবা- মা ৬০ পার হলেই বুড়ো হয়,আমরা তাদের মৃত্যুর অপেক্ষা করি।
কথায় কথায় বলি- সবাইকে তো যেতেই হবে! আমাদের বাবা- মাও মরে যাবে। তো দুঃখ করে আর লাভ কি?
আসলে ব্যাপার অন্য। বাবা- মা আর হালের গরু একই। সময়, মেধা, শ্রম, সম্পত্তি দিয়ে ছেলে- মেয়েদের দিয়ে বলদ হয়। তাদের বসায় খাওয়াবে কে? তখন তাদের প্রয়োজন শেষ করে আমরা নিজেদের সংসার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
আমি ডাক্তারের চোখা নাক আর বয়স ফেলে মাঠে নামলাম। যাই হোক,সহকারী আমার অতি অমায়িক আচরনে লাইনে দাঁড়িয়ে দিলেন। অবশেষে গায়ে ঘামের বোটকা গন্ধ নিয়ে চাঁদমুখের দেখা পেলাম।
মহিলা সহকারী ভীষণ বিরক্ত। আমাদের অসুস্থতা যেন মহা অপরাধ! কেন যে তাকে জ্বালাতে যাই? কমশিক্ষিত দূর্বল রোগীদের হেই,হুই করে কঠিন ধমক দিচ্ছেন। আমার পালা এলো। তিনি যেভাবে কাপড় টানাটানি করে বিবস্ত্র করলেন তাতে ঘামের লজ্জাও; লজ্জিত হল। যেন বহুল প্রতিক্ষিত পুরুষের নারী শরীর ভালোবাসা ছাড়াই পাবার একটা আগ্রাসী আচরণ।
অবশেষে তিনি বলেই ফেললেন – আপনারা যে কি! সময় বোঝেন না। এতো টাইট জিনিস কেউ পরে? ডাঃ দের সময়ের অনেক দাম। ঘন্টায় তাঁকে ২০/৩০ জন পেশেন্ট দেখতে হবে যে।
আমার কিনে দেয়া হ্যান্ড গ্লবস তখনও টেবিলে পড়ে রইল আর কিছু বলা- শোনার আগেই ২ মিনিটের মধ্যে তিনি পেশেন্ট অবজার্ভেশান শেষ করলেন। ১ ঘন্টা পর টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে এসে তাকে আর পাওয়া গেল না। অনেক দূর থেকে আসা ৭/৮ জন পেশেন্ট হা- হুতাশ, কান্না- কাটি করে ফেরত গেলেন। অথচ তারা সকাল ৭ টায় অনেক কষ্টে সিরিয়াল দিয়েছে। আমার পরে আর কোন পেশেন্ট তিনি দ্যাখেননি। আর তিনি ৭.৩০ এর পর থাকেনও না। আমরা লাকি পারসোনরা রিপোর্ট নিয়ে বসে রইলাম ৭.৩০- ১০.০০ পর্যন্ত। কোন প্রশ্ন করা যাবে না। আমাদের বসতে বলা হয়েছে। তাছাড়া আমাদের ফেরত যাবারও উপায় নাই কারণ ভিজিট নিয়ে রেখেছে।
অবশেষে তার হাফ এমবিবিএস কাম মহিলা সহকারী বের হয়ে আমাদের হ্যামিলিনের বাঁশিঅলার মতো হেঁটে হেঁটে ডাঃ এর বাসায় নিয়ে গেলেন। সেদিনের ৪১ ডিগ্রি তাপমাত্রায় অনেক বয়সী মানুষ ছিলেন যারা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাতে কারও কিছু যায় আসলো না।
সেখানেও কোন ফ্যান বা বসার জায়গা নেই। রাত ১১ টার পর রিপোর্ট দেখা শেষ করলেন।
আমাকে জানালেন, – আজ তো রাত হয়ে গিয়েছে, আজ পারলাম না। আপনি ফোন দিয়ে, সময় করে আসুন, বাকি পানিটুকু বের করে দিবো।
আবার সেই সিরিয়াল, সেই লাইন,সেই অপেক্ষা,সেই সময়,সেই কষ্ট। আজ তো সারারাতই আমার সময় ছিল, অফুরন্ত সময়! গভীর হতাশা, না খাওয়া, অবসন্ন ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে বাসে উঠে ঝাপসা জোনাকী পোকা উড়তে লাগলো। মাথা বাসের সিটে এলিয়ে দিতেই মনে হলো, কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছি। সামনে ভাসছে ডাঃ তথা জনসেবকের চোখা নাক, বয়স, ভাঙ্গা গাল, দুধে- আলতা মসৃন গায়ের কালার!!! আমি তলিয়ে যাচ্ছি দূর- বহুদুর,,,,।
ছবি- নেটের।
৩টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
সহকারীকে ৩০০/= ! আমি ১০০০/= টাকাও দাও মেরেছি ম্যাডাম। বেশ কয়েক বছর মানে মনে হই, ২০১৬ কিংবা ২০১৭তে দাঁড়িয়ে। আমি একজন ঘুষ প্রদানকারী , হা হা হা
হালিমা আক্তার
এ এক কঠিন বিড়ম্বনা। হাসপাতাল গুলোতে যেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়। শুভ কামনা রইলো।
নার্গিস রশিদ
হায়রে স্বাস্থ্য সেবা । অবশ্য সব যায়গাতেই অনিয়ম । কোনো সিস্টেম নাই। মানুষকে ভোগানোই সেবা দানকারীদের কাজ।