বেশ কয়েকদিন থেকে মনটা অস্থির ছিলো। প্রচন্ড বিরক্ত ছিলাম নিজের উপর এবং চারপাশের অনেকের উপর অনেক কিছুর উপর।
বাইরে বের হলে আমার বিরক্তিটা আরো বেড়ে যায়। ইদানিং বাইরে যাওয়াটাও কমে গেছে। সারাক্ষণই মনে হয় নিজের সাথে নিজেরই এক যুদ্ধ। নিজেকে বার বার গড়ি বার বার ভাঙ্গি। প্রতিবারই ফলাফল শূন্য। এ এক হাহাকার আমার।
মনে হয় সবকিছু ছেড়ে অচেনা কোনো দেশে চলে যাব। ইশ! কোনো এক অলৌকিক ক্ষমতার বলে তা সম্ভব হলে, জীবনটা অন্যরকম হত এ ভাবনা পেয়ে বসেছে ইদানিং।
বাইরের দেশে আমার এক বান্ধবী ও কয়েকজন পরিচিত আপুর ফেসবুক স্টাটাস দেখে মূলত তাদের জীবন যাপনের ব্যাপারটা দেখে মনে হয় এ দেশটা ছেড়ে চলে যাই। ওরা কতো শৃঙ্খলা বিধির সাথে জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছে।
চারিদিকের আরো অনেক অসংগতি দেখে আমি আসলে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে পড়েছি।
এতো সব অস্থিরতার জন্য আমার মনে হচ্ছিলো নিজেকে কাউন্সিলিং করার প্রয়োজন। আমার লাইব্রেরি রুমটাই আমার প্রচন্ড শান্তির একটা জায়গা। এখানে ঢুকলে টোটালে আমি ফোনটা বন্ধ রেখে দেই। সকল কোলাহলকে ঝেড়ে ফেলে চুপচাপ বসে থাকি। নিজের সাথে বই এর কতো কতো কথা বলে ফেলি। কখনও বিছানায় আর যাওয়া হয়না। মুগ্ধ হয়ে একটু একটু করে রাতের অন্ধকার সরিয়ে দিনের আলো ফুটে ওঠার মুহূর্তগুলো অসাধারণ লাগে আমার। এ ভালো লাগাগুলো আসলে অন্যরকম। একান্তই নিজের। মাঝে মাঝে হিসেব কষি কি হয় এতো এতো লিখে বা পড়ে! এসব অস্থিরতার মাঝে গতকাল হঠাৎ এক পুঁথিপাঠ শুনলাম। প্রচন্ড ভালো লাগায় মনটা ভরে উঠলো।
আমি এক বছর আগে পুঁথিপাঠ নিয়ে এক ধারাবাহিক লেখা শুরু করেছিলাম। এটা অবশ্য লোক কাহিনীর উপর।
যাহোক মূল কথায় আসি।
আমি এ দেশটা ছেড়ে পালাতে চাচ্ছিলাম। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কেনো এই ভীরুতা আর অকৃতজ্ঞের মতো চিন্তা ভাবনা আমার?
বিদেশ বিভূঁইএ আমার দেশের কিছুই নেই সেখানে। নেই মায়ের কড়া শাসন। নেই কারো স্নেহের পরশ। রাতে দেরি করে বাড়িতে ফিরলে বাবার শাসনের ভয়ে পিছনের দরজা দিয়ে চুপিচুপি ঘরে ফেরা নেই। ভাত নিয়ে চুপচাপ বসে থাকা বোনের সে স্নেহমাখা মুখটি নেই। কপালে হাত দিয়ে কেউ বলবে না, জ্বর এসছে শুয়ে থাকো। আমার পাশের কেউ আমাকে তার ভাষায় বকা দিয়ে বা ভালবেসে কোনো কথা বললে তা আমি বুঝব না। আমার উপলব্ধি ক্ষমতা সেখানে একেবারে শূন্য হয়ে থাকবে। এ যেনো এক পরগাছা আমি।
অথচ, এই যে যাদের প্রতি আমি এতো বিরক্ত রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় তাদের মধ্যেকার ঝগড়ার মধ্যেও আমি আমার ভাষাটা খুঁজে পাই। আমি কোনো পানের দোকানে গিয়ে বলতে পারব,”আমাকে একটি মিষ্টি পান দিন চমন বাহার দিয়ে।” আমার ভাষা বুঝে পান দোকানদার যখন বলবে, চুন দেই আপা, লাল মুখে আপনাকে দারুন মানাবে।” এ তার সরল ভালো লাগার প্রকাশ। এ ভাষার আদান প্রদানে আমাদের একে অপরের ভাল লাগার অনুভূতির প্রকাশ।
সন্তানকে প্রচন্ড শাসনের পর বুকের মধ্যে জড়িয়ে আদর করার এই অনুভূতির প্রকাশ শুধু আমার দেশেই আছে।
আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি, জাফর ইকবাল স্যারকে সবাই এলোমেলো অসংগতি কথা বলে। স্যারের কতো ধৈর্য আমি ওটাই শুধু চিন্তা করি।
তিনি ইচ্ছা করলে বিদেশের মাটিতে খুব সন্মানে সাথে আরো আরাম আয়েশে থাকতে পারতেন। সারাক্ষণ তাকে এই ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো না যে তারই দেশের কেউ কখন তাকে নির্মমভাবে মেরে ফেলে। তাকে কেউ সহজভাবে নিলো না এ দেশের কেউ। কোনো রাজনৈতিক দল না, না তার সেই প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা, নাতো তার সহকর্মীরা। কী এক যন্ত্রণা সহ্য করে সে এ দেশে পড়ে আছে। ক্ষমা করে দিয়ে বুকে টেনে নিচ্ছে তার সকল ছাত্রছাত্রীদের। তার এই ক্ষমা করা আর ত্যাগটিকে একটা গল্পের সাথে মিলাতে ইচ্ছা করে।
গল্পটা এরকম যে, কোনো এক যুদ্ধে এক সাহাবি তার একটি হাতে প্রচন্ড জখম হয়। হাতটি তার শরীরের সাথে কোনোরকম লেগে থাকে। সে তার জখম হওয়া হাতটি নিয়ে কিছুতেই সামনে আগাতে পারছিলেন না। আবার থামতেও পারছিলেন না। কারণ, তিনি একজন খুব ভালো যোদ্ধা ছিলেন। তিনি তার জখম হওয়া হাতটি পায়ের নিচে চেপে অন্য হাত দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলেন। সামনে এগিয়ে যান তিনি। কতোটা মনের শক্তি ও সহ্য ক্ষমতা থাকলে এ কাজটি করা সম্ভব! একবার ভেবে দেখলেই গা শিউরে ওঠে। আসলে তার জ্ঞানের চিন্তা এতোটা শক্তিশালী ও উঁচু যে তিনি খুব সহজে সবার এই অসংগতিটাকে ইগনোর করতে পারেন। জ্ঞানের স্তরটা যখন অনেক উঁচুতে চলে যায় একমাত্র তখনই মানুষ এসব ভাবতে পারে। যেমন- যখন আপনি প্লেনে করে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিবেন তখন প্লেন থেকে এ মহাসাগর টিকে আপনার মাথার এক সিঁথির মতো মনে হবে। এ মহাসাগরের বিশালতা আপনাকে তখন একটুকু বিচলিত করবে না। আপনি নির্ভয়ে তা পার হয়ে যাবেন।
দেশের জন্য আসলে একেকজন মানুষের একেকরকম ভালবাসা। আমার দৃষ্টিতে আমার উপলব্ধিতে তিনি একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক।
আমার দেশের আমার বাংলার সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরনো সমৃদ্ধশালী এক ইতিহাস।
আমার মাতৃভূমির সম্পদের জন্য যুগ যুগ ধরে অনেক অনেক লুটেরা শাসক এসেছে।
তাদের লিটের কথা তাদের অত্যাচারের কথা এখনও আমরা বিভিন্ন ছড়ার মাধ্যমে দেখতে পাই।
তার একটা ছড়া যেমন-
*খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কিসে?
ধান ফুরুল, পান ফুরুল
খাজনার উপায় কী?
আর কটা দিন সবুর কর
রসুন বুনেছি।*
এই যে ছড়ার মাঝে আমার দেশের মানুষ মারাঠা বর্গীদের অত্যাচারের কথা তুলে ধরেছে। এটা আমরা কতোজনই উপলব্ধি করতে পারি!
‘বর্গীর’ মারাঠা সৈন্যদের ওদেশের ভাষায় বলা হয় সৈন্য। সেই শিবাজী ওদেশেরই মানুষ। এই বর্গীরা একসময় এদেশে লুট করতে আসতো। খাজনা বা কর আদায় করতো। তারা লুট করে যাবার সময় বাঙ্গালীর খেটে খাওয়া মানুষের ঘরবাড়ি আগুন লাগিয়ে দিয়ে চলে যেতো। নারীদেরও ধরে ধরে নিয়ে যেতো।
নবাব আলীবর্দি খাঁ অনেক চেষ্টা করেছেন এদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করার। তিনি অবশ্য অনেকটা সফলও হয়েছিলেন।
আরো আসে বৃটিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ তাদের সংস্কৃতির সাথে যুদ্ধ করে এখনও টিকে আছে আমার মাতৃভাষা। আমার ঐতিহ্য। আমার সংস্কৃতি।
স্কুল কলেজগুলোতে এমন সব ছড়ার ইতিহাস পড়ানো উচিৎ। তাদের বাংলা মায়ের দুঃখ কষ্টের স্মৃতিটুকুর সাথে পরিচয় করানো উচিৎ।
এ আমার দেশ এ আমার মাতৃভূমি এ আমার মাতৃভাষা।
,,,রিতু,,,কুড়িগ্রাম।
২১টি মন্তব্য
মাহমুদ আল মেহেদী
কয়েকদিন ধরে মনটা অনেক অস্থির। লেখাটা পড়ে সত্যিই অনেক ভাল লাগল।ধন্যবাদ এরকম লেখা আরো চাই।
রিতু জাহান
কতো কি যে মনে চলে আসে আমার! ভাবছি এখন এই এলোমেলো ভাবনাই লিখব।
ভালো থাকুন সব সময় ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
কুন দ্যাশে যাইবার চান! ঠিকানা প্লিজ!
অলৌকিক তো কোন ব্যাপার না!
নদীর এপার ওপার কিন্তু একই পার!
স্থান পরিবর্তনকে যদি পালানো বলা হয় তাও এক ধরনের পলায়ন,
তবে নিজের কাছ থেকে নিজেকে পালিয়ে রাখা কঠিন।
আসলে একবার অনেক গুলো বিষয় তুলে এনেছেন, সব বিষয় নিয়েই কথা বলা যায়,
কিন্তু তাতে এর থেকেও বড় উত্তর তৈরি হয়ে যাবে, মানে বার হাত কাকুরের তের হাত বিচি।
আসলে দেশের প্রতি ভালোবাসা অনেক গুনি মানুষ অনেক বেশি দামে কিনেছেন,
ঠিক বা বেঠিক সে হিসেব টানতে চাচ্ছি না। সময় জানান দেবে সে ঠিক বা বেঠিকের।
নিজের কাউন্সেলর নিজেই, আবার নিজের লাইব্রেরি এতো বিশাল প্রাপ্তির মেল বন্ধন!
আর মাতৃভাষা! নো আপোষ এ প্রশ্নে।
রিতু জাহান
একেই বলে সেই এলোমেলো কথা। সহ্য করতে পারবেন কিনা এখনো ভেবে দেখুন। দেশটা আসলেই আমার।
ছাইরাছ হেলাল
পারমুতো!
রিতু জাহান
রাতে একটা দিছি গুরুজি
এলোমেলো পোস্ট।
জিসান শা ইকরাম
তোমার চিন্তার বহুমুখিতা সব সময়ই আমাকে মুগ্ধ করে,
এক লেখায় অনেক প্রসঙ্গ আনলে।
দেশের বাইরে চলে যাবার চিন্তা অনেক সময় আমারও হয়, আমাদের দেশের সিস্টেমই খারাপ, যে কারণে সব কিছুতে এলোমেলো অবস্থা। বিদেশে সব কিছু সিস্টেম অনুযায়ী চলে, যে কারণে কোনো এলোমেলো নাই।
এরপরেও আমরা যারা দেশে পরে আছি, এদেশের মাটি মানুষের টানেই আছি।
নিজের কাউন্সেলিং নিজে করতে পারা বিশাল এক অর্জন।
রিতু জাহান
নিজের সাথে নিজের এক যুদ্ধ ভাইয়া। এ বড় কঠিন।
আপনার লেখা পাচ্ছি না। 🙁 :@
জিসান শা ইকরাম
চোখের অসুস্থতায় ল্যাপির সামনেই বসিনি প্রায় দুই মাস। একটা অনভ্যস্ততা তৈরী হয়েছে সব কিছুতে।
নতুন লেখা আসছে না, আজ ভেবেছি কিছু একটা লিখবো, আসলো না 🙁
রিতু জাহান
তাড়াতাড়ি সুস্থ হোন ভাইয়া। অনেকদিন আপনার লেখা পড়ি না।
জিসান শা ইকরাম
চেষ্টা করছি লেখায় ফেরার। দু একদিনের মধ্যেই লেখা দেবো আশাকরি।
রিতু জাহান
অপেক্ষায় থাকলাম ভাইয়া।
মায়াবতী
মাঝে মাঝে অস্থির সময়ের অস্থিরতে আমাকে ও চেপে ধরে তখন কাউন্সিলিং খুঁজি চার পাশে তোমার মত ই । খুব সুন্দর একটা টপিক নিয়ে লিখেছো রিতু , আমার সোনার দেশের চারপাশের এতো সব প্রতিকুলতার মাঝে ও কি যেন আছে যা চুম্বকের মত আঁকড়ে রেখেছে আমাদের ! এ যেন মায়ের গন্ধ …. অনেক অনেক আদর তোমার জন্য রিতু ।
(3
রিতু জাহান
তোমার জন্যও ভালবাসা রইলো আপু। এত্তোগুলা আদর (3 -{@ তোমার মুহূর্তবোধ লেখাগুলো থেকেই আইডিয়া এলো। তুমি এটার পিডিএফ করে রেখো। দারুন লিখেছো তোমার এ ধারাবাহিক লেখাটা আপু।
পাশে থেকো এমন করে আপু।
মোঃ মজিবর রহমান
একটি ছোট্ট লেখায় অনেক বিষয়ের অবতাড়না। বিপদে, অস্থির সময়ে, খারাপ অবস্থার মাঝে যারা নিজেকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারে তারা বড় মাপের ব্যাক্তি। তারা দেশ সমাজকে দিতে পারে।
জাফর স্যারের তুলনা তিনি নিজেই।
রিতু জাহান
আপনাকে ধন্যবাদ মজিবর ভাই। আসলে জাফর ইকবাল স্যারকে পুরোটা কেউ জানলে এমন করে বলতে পারতো না।
ভালো থাকবেন ভাই।
তৌহিদ ইসলাম
আপু খুব সুন্দর গুছিয়ে লিখেছেন। এই অবস্থা আমারো হয়েছিলো একসময়। এখন মনে হয় দেশেই ভালো আছি। নিজেই নিজেকে বুঝাতে পেরেছেন জেনে ভালো লাগলো।
রিতু জাহান
অনেক ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকুন সব সময়। নিজের সাথে সবারই কথা বলা উচিৎ। এতে অনেক বিষয়ের জটলা খুলে যায়।
শুভকামনা রইলো।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু এইতো চাই।
আমি যেমন আমারই কাউন্সিলিং করি।
ভালো রেখো আপু।
রিতু জাহান
ভালবাসা নিও আপু। নিজের দিকে খেয়াল রেখো। সাবধানে মাছ খেও :p
নীলাঞ্জনা নীলা
:D)