আমার নিউইয়র্কের বাড়িতে বেড়াতে এলেন সমবয়সী এক কাজিন। ইউরোপে নিজের ব্যবসা, পরিবার নিয়ে বর্তমানে জীবন যুদ্ধে সফল একজন মানুষ সে। খাবার টেবিলে গল্প করছি আমরা। শৈশবের অনেক স্মৃতি আমাদের। বলল, ” জানিস, ছোটবেলায় গ্রাম থেকে শহরে তোদের বাসায় বেড়াতে এলে তোর আম্মা চুপিসারে হাতে টাকা গুঁজে দিতেন কিছু কিনে নেবার জন্য। কি যে খুশি লাগতো !” কথাগুলো বলার সময় তাঁর চোখে, মুখে ছেলেবেলার নিস্পাপ, সরল এক “অল্পতেই অসীম আনন্দ” খেলে গেলো যেন ।
আমি যখন ছোট, নানু মাঝে মাঝেই বেড়াতে আসতেন নানান রকম পিঠা, গাছের ফলমূল নিয়ে। ভীষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক মানুষ ছিলেন। দু’দিন পর ফিরে যাবার সময় আড়ালে নিয়ে “বাবা-মা’র কথা শুনবা… ঠিক মত লেখাপড়া করবা… ” টাইপের কিছু উপদেশ দিতেন। অতঃপর হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলতেন, “তোমার যা মন চায়, কিনে খাইয়ো”। নিতে চাইতাম না। তবুও দিতেন। জোর করেই দিতেন। ভেতরে অদ্ভুত এক আনন্দ খেলে যেতো। গোটা পৃথিবী হাতের মুঠোয় পেয়ে যাবার আনন্দ ! একটা সময় বিষয়টি এমন দাঁড়ালো যে, প্রতিবার নানু ফিরে যাবার সময় ভীষণ মনখারাপের মাঝেও গোপন অপেক্ষা ছিল, কখন আড়ালে ডেকে সকলের অগোচরে হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলবেন, ” তোমার যা মন চায়, কিনে খাইয়ো”। আর সেই টাকা হাতে আমি যেন বিরাট সম্পদের মালিক বনে গিয়ে পাড়ার খেলার সাথী দিনা’কে দেখাবো, বাহাদুরি করবো, গর্বে বীর দর্পে এমাথা-ওমাথা হেঁটে বেড়াবো।
আমরা বড় হয়েছি। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার প্রানান্তকর চেষ্টা শেষে যার যার অবস্থানে ভাল আছি। কিন্তু ছোটবেলার সেই ছোট ছোট পাওয়াগুলো জীবনের সকল পাওয়ার আনন্দকে ছাপিয়ে আজো সেরা পাওয়া হয়ে জ্বলজ্বল করছে স্মৃতিতে।
ভীষণ ব্যস্ত এই শহরটিতে যখন সন্ধ্যা নামে, মৃদু আলোয় একাকি পথ চলার সময় এখনো যেন শুনতে পাই, ধবধবে পরিচ্ছন্ন সাদা শাড়ি পরিহিতা ভীষণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এক নারীকণ্ঠ __ “তোমার যা মন চায়, কিনে খাইয়ো “।
আমার সমবয়সী কাজিনও হয়তো ব্যস্ততা শেষে ক্লান্ত শরীরে ইউরোপের কোন এক রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে হেঁটে যেতে যেতে শুনতে পায় আমার মায়ের কণ্ঠ __”কিছু কিনে নিও, তোমার যা মন চায়”।
এটি সম্ভবত আমাদের সকলেরই শৈশবের গল্প।
জীবনের অনেক উত্থান-পতন এর মাঝেও এমন কিছু সুখকর স্মৃতি নিয়েই আমরা বেঁচে থাকি। তবুও বেঁচে থাকি।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
১৯টি মন্তব্য
লীলাবতী
আপু স্মৃতি কাতর হয়ে গেলাম আপনার লেখা পড়ে। এমন স্মৃতি আমাদের অনেকেরই আছে। তবে এই আন্তরিকতা কমে যাচ্ছে দিন দিন। আর দু এক প্রজন্ম পরে এসব কথা অদ্ভুত মনে হতে পারে। এসব স্মৃতি আমাদের মনকে আনন্দে পূর্ন করে দেয়।
রিমি রুম্মান
আসলেই তাই। এই আন্তরিকতা কমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তবে আমি নিজে এখন ঠিক আমার মা কিংবা নানুর মতোই। প্রাচীন মানসিকতার।
ভাল থাকুন সবসময়।
ইনজা
যখন দেখি আমার মা আর শাশুড়ি বাচ্চাদের হাতে কিছু (টাকা) গুজে দিচ্ছে নিজেই নস্টালজিয়াই ভুগি, ছোটবেলা স্মৃতিগুলো বারবার মনকে নাড়া দেয়।
রিমি রুম্মান
কি অদ্ভুত সব দিন ছিল আমাদের !
আমাদের শিশুরা এমন অসাধারন সুন্দর শৈশব স্মৃতি নিয়ে বেড়ে উঠুক।
সালমা আক্তার মনি
সম্পর্ক গুলো দিন দিন একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে তবু সবার জীবনের এইসব স্মৃতি গুলো সোনার খনির
মতো আজও আঁকড়ে ধরে রাখতে ভাল লাগে।
রিমি রুম্মান
মাঝে মাঝে স্মৃতির বাক্সটি আপনা আপনিই খুলে যায় পরিবেশ পরিস্থিতিতে…
অদ্ভুত এক ভালোলাগা ছড়িয়ে দিয়ে যায়।
ব্লগার সজীব
‘ তোমার যা মন চায়, কিনে খাইয়ো “।
”কিছু কিনে নিও, তোমার যা মন চায়”।
*আপু আপনার লেখার গুনে এই কথা দুটি কানে বাঁজছে। কত মায়া নিয়ে বলা কথা। এমন আন্তরিকতা পুর্ন কথা মিস করি খুব।
রিমি রুম্মান
এমন আন্তরিকতা এখনো হারিয়ে যায়নি।
এমন সুখস্মৃতি নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি।
মেহেরী তাজ
আপু এমন কথা তো প্রায়ই শুনতাম এমন কি এখনও শুনি! কিন্তু এভাবে ভেবে দেখিনি কোন দিনই!
এখন তো সারাদিন শুধু এই কথাই কানে বাজবে! ;?
রিমি রুম্মান
যদি তাই হয়, তবে ধরে নিবো, আমার লেখাটি সার্থক । কারো অনুভূতিকে নাড়া দিতে পেরেছে। 🙂
দীপংকর চন্দ
আপনার একান্ত অনুভূতিগুলোর মানবিক মূল্য অনেক।
শুভকামনা অনিঃশেষ।
ভালো থাকবেন। সবসময়।
রিমি রুম্মান
অনেক শুভকামনা আপনার জন্যে।
ভাল থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
মৌনতা রিতু
এই একান্ত অনুভূতিগুলোই আমাদের বাঁচার প্রেরণা। ছোটবেলার কতো যে স্মৃতি। সেই তারা যখন কেউ অনেকদিন পর কাছে আসে স্মৃতিগুলো সত্যিই জীবন্ত হয়।
রিমি রুম্মান
আমার কাজিনটি ছোটবেলা থেকেই পিতৃহীন ছিল। তাঁদের এমন ভালোবেসে হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে ” কিছু কিনে নিও, তোমার যা মন চায়” বলার মতন কেউ ছিল না। আমার মা যখন তা করতো, তখন তাঁর পৃথিবী শুদ্ধ পেয়ে যাবার অনুভূতি হতো। এখন সে ইউরোপে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। অনেক অর্জন। কিন্তু সেই অনুভূতি আজো তেমনই আছে। সে ভুলে যায়নি কিছুই, জানালো আমায়। আমি ক্ষণিক নির্বাক চেয়ে রই আর ভাবি__ কত ছোট প্রাপ্তি, অথচ কত বড় অনুভূতি !
অয়োময় অবান্তর
শৈশব স্মৃতিগুচ্ছ আজ শুধুই স্মৃতিময়। লেখাটি পড়ার সময় বার বার চলে যাচ্ছিলাম ফ্ল্যাশব্যাকে। ঠোটের কোনে ফুটে উঠেছিল এক চিলতে হাসি। অতঃপর এক দীর্ঘশ্বাস।
ভাল থাকুন। 🙂
রিমি রুম্মান
এমন সুখ আর দুঃখগুলো নিয়েই তো আমাদের বেঁচে থাকা, তাই না ?
অনিকেত নন্দিনী
স্মৃতিকাতরতার ভাইরাস দিয়ে দিলেন আপু। ছোটবেলায় এমন করে টাকা পেতাম প্রচুর। বাড়ি থেকে বহুদূর থাকার সুবাদে দাদাজান-দাদীজান, নানু আর চাচা-মামারা খুব ঘটা করে আমাদের বাসায় বেড়াতে যেতেন। নানা অনেক আগেই ওপারে চলে না গেলে তিনিও নিশ্চয়ই যেতেন। তাঁরা ফিরে আসার পথে হাতে কড়কড়ে নোট ধরিয়ে দিয়ে আসতেন। সেই টাকা এত বেশি জমে গিয়েছিলো যে আমি সেই পিচ্চিবেলারেই ওইগুলি দিয়ে ব্যাংক একাউন্ট খুলেছিলাম।
রিমি রুম্মান
বাহ্ ! আমাদের অবশ্য এতো টাকা দিতো না। যা দিতো, আইসক্রিম, কটকটি আর চালতার আচার খেতেই শেষ হয়ে যেতো । 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু তুমি যা কিছু লেখো, প্রায় প্রত্যেকের জীবনের সাথে মিলে যায়। তাইতো এতো টানে তোমার লেখা।
ভালো রেখো। -{@