অনন্য সুভাষ (৬)

সাতকাহন ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪, বুধবার, ১০:৪০:২৭পূর্বাহ্ন সাহিত্য ১২ মন্তব্য

সুভাষের তেজদীপ্ত প্রতিবাদের পরে নেহেরু স্বাধীনতা দাবির সংশোধনী আনেন। এই নেহেরুই তার রাজনৈতিক জীবনে কতোবার যে নিজেকে কমিউনিস্ট ও বিপ্লবী বলে বিবৃতি দিয়েছেন তার হিসেব নেই। এবারও তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে সুভাষকে সমর্থন জানালেন। কিন্তু যখন ভোট গ্রহণ শুরু হলো তখন তিনি গান্ধীবাদী হয়ে গেলেন। ওই ভোটেই সুভাষ হেরে গেলেন ১৩৫০-৯৭৩ ভোটের ব্যবধানে। এই হার নীতিগত কারনে হয়নি, হয়েছিলো গান্ধীর কারনে। ভোট গ্রহণের পূর্বে একটি আশঙ্কার কথা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো প্রতিনিধিদের মধ্যে যে, ভোটে গান্ধী পরাজিত হলে নাকি কংগ্রেস ত্যাগ করে দূরে সরে যাবেন। ফলে উপস্থিত প্রতিনিধিগণ গান্ধীকে হারানোর ভয়ে যা করার তা-ই করলেন।

এই ভোটের পরেই সুভাষ তরুণদের আহ্বান জানিয়ে একটি তেজদীপ্ত ভাষণ দিলেন:

‘ভারতের যুবকেরা এখন হইতে আর প্রবীণ পক্বকেশ নেতাদের স্কন্ধে সব ভার নিক্ষেপ করিয়া জোড় হস্তে মূক মেষপালের মতো অনুগমন করিতে প্রস্তুত নহে। তাহারা বুঝিয়াছে স্বাধীন ও শক্তিমান ভারত তাহারাই গড়িবে। সেই দায়িত্ব তাহারা গ্রহণ করিয়াছে।

সবরমতী ভাবধারা তাহার প্রচারমুখে এই ধারণা জন্মাইবার চেষ্টা করিতেছে যে, আধুনিকতা খারাপ, কল-কারখানায় পর্যাপ্ত দ্রব্যজাত পণ্য তৈরি করা অন্যায়, অভাব বৃদ্ধি না করা অনুচিত, জীবনযাত্রার প্রয়োজন ও প্রাচুর্য বর্ধিত করা উচিত নহে। সর্ব প্রযত্নে গরুর গাড়ির যুগে ফিরিয়া যাওয়াই শ্রেয় এবং দৈহিক উন্নতি অথবা সামরিক শিক্ষাকে অগ্রাহ্য করিয়া কেবল আত্মার উন্নতি সাধনই লক্ষ্য হওয়া উচিত।

ভারতে আমরা আজ কর্মযজ্ঞের সন্ধান চাই। আমাদের বর্তমানে যুগের সহিত সামঞ্জস্য করিয়া বাঁচিতে হইবে। আমরা সর্বদ্বাররুদ্ধ জগতের কোণে বাস করিতে পারিবো না। তাই বলছি, গরুর গাড়ির দিন চলিয়া গিয়াছে। স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে ভারতমাতাকে সর্বদা অস্ত্রে-বর্মে সুসজ্জিত থাকতে হইবে।’[১৯]

সত্যরঞ্জন বক্সী ১৯২৯ সালের ২ জানুয়ারি ফরোয়ার্ড পত্রিকায় লেখেন:

‘গান্ধীর ডোমেনিয়ন স্ট্যাটাসের খসড়া তৈরি করার পরে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হিসেবে যখন গান্ধীজী সুভাষকে স্বাক্ষর করতে বললেন তখন সুভাষ তাতে রাজী হলেন না। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, আমার দাবী এই আধখানা স্বাধীনতা নয়, পূর্ণ স্বাধীনতা। এ ব্যাপারে কোনো রকম আপোষ করতে আমি রাজী নই।’[২০]

১৯২৮ সালের ওই অধিবেশন ছিলো বিপ্লবীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা ছিলো অহিংসবাদী ও আপোষকামী কংগ্রেস এবং সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের মিলিত একটি অধিবেশন। একসময় এই বিপরীতধর্মী স্রোতের মাঝে সেতুবন্ধন গড়ে তুলেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। তাঁর অবর্তমানে এগিয়ে এলেন তাঁরই রাজনৈতিক শিষ্য সুভাষ বসু। সুভাষের ডাকে অনুশীলন, যুগান্তর, আবদুল খালেক’র ফরিদপুরের সন্ত্রাসবাদী দল, পূর্ণ দাসের শান্তিসেনা, হেমচন্দ্র ঘোষের মুক্তিসংঘ, সূর্য সেন’র দল এবং উত্তর বঙ্গের দলগুলো, অনীল রায় ও লীলা রায়ের দীপালি সংঘসহ বাঙলার প্রায় সকল বিপ্লবী সংগঠনগুলো এই অধিবেশনে যোগ দেয়।

কংগ্রেস ওই অধিবেশন শেষে ভাবলো বিপ্লবীদের বাদ দিয়ে বাঙলার মন জয় করা সম্ভব নয়, বাঙলায় কংগ্রেসকে শক্তিশালী করাও সম্ভব নয়। বিপ্লবীরা মনে করলো কংগ্রেস সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান। এই প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ভারতের মুক্তিকামী জনগণকে বিপ্লবের উপযোগী করে গড়ে তোলা যতোটা সহজ, ততোটা কোনো আন্ডাগ্রাউন্ড পার্টির ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।

১৯২৯ সালের ১১ মে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেস ও যুব কংগ্রেস-এর যুব সম্মেলন উপলক্ষে সুভাষ চট্টগ্রাম যান। সেখানে অনন্ত সিং, গনেশ ঘোষ ও ত্রিপুরা সেনের সাথে কংগ্রেস এবং ভলান্টিয়ার্স বাহিনী নিয়ে আলোচনা করেন। সম্মেলনের পরে তিনি সেখানে একটি কর্মীসভা করেন। চট্টগ্রামে সেনগুপ্ত ও সুভাষ গ্রুপের সংঘর্ষে বিপ্লবী সুখেন্দু কলকাতার হাসপাতালে মারা গেলে সুভাষ খালি পায়ে কলকাতা শহরে শব মিছিলের নেতৃত্ব দেন।

এই বছরই তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। এই সময় নোয়াখালী জেলার এক যুব সম্মেলনে ভাষণ দেন। তাঁর বক্তব্যে লাহোর ষড়যন্ত্রের আসামী শহীদ বিপ্লবী যতীন দাস-এর কথা উল্লেখ করে সুভাষ বলেন:

‘…বাংলাদেশের যুব সমাজের ভিতর থেকে সহস্র সহস্র যতীন দাস আমরা চাই, যারা তার আত্মোৎস্বর্গের ভাবকে রূপায়িত করবে। তীব্র জাতীয় চেতনাসম্পন্ন নতুন একদল যুবক আমাদের অবশ্যই চাই। কারণ, তারাই ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষকে নির্মাণ করবে। যে ভারতবর্ষে কৃষক-শ্রমিক নির্বিশেষে সকল নর-নারী স্বাধীনতার আশীর্বাদ উপভোগ করবে।

আপনাদের আমি আহ্বান করছি অদূর ভবিষ্যতে কি কি গৌরবময় ভূমিকা আপনাদের গ্রহণ করতে হবে তা অনুভব করুন। তারপর আপনারা অগ্রসর হয়ে চলুন একটি মাত্র ভাবনা নিয়ে, মাতৃভূমির মুক্তিব্রতই আমার একমাত্র কর্তব্য।’[২১]

১৯২৯ সালে লাহোরে কংগ্রেসের অধিবেশন আহ্বান করা হলো। এই কংগ্রেসেই সুভাষের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব পাশ হয়। কলকাতা কংগ্রেসে না মানলেও এবারই প্রথম মহাত্মা গান্ধী নিজ থেকেই স্বাধীনতার প্রস্তাব পেশ করলেন। সেই সঙ্গে আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারকে এই দাবী মেনে নিতে হবে। দাবী না মানলে শুরু হবে লাগাতার আইন অমান্য আন্দোলন।

সুভাষ বসু এই এই অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধীর প্রস্তাবে সংশোধনী এনে ভাষণ দেন। সংশোধনীতে সুভাষ বলেন:

‘ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তার ভারতীয় অনুচরদের অপসারিত করে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশে এই কংগ্রেস ভারতবর্ষে একটি পাল্টা সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতার অনুকূলে অবিরাম প্রচার অভিযান চালানোর প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। …আমি চরমপন্থী, আমার নীতি হলো হয় সবটা চাই, নয়তো কিছুই চাই না।’[২২]

কিন্তু গোল বাঁধলো মহাত্মা গান্ধীর পরবর্তী একটি বক্তব্য নিয়ে। দেখা গেলো মহাত্মা গান্ধী মুখে পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বললেও, তিনি মনে-প্রাণে চাইছেন ডোমেনিয়ন স্ট্যাটাস।

তীব্র প্রতিবাদে ফেঁটে পড়লেন সুভাষ। মহাত্মা গান্ধীর সেই একঘেঁয়ে পুরনো কথা, সেই পুরনো দাবী! স্বাধীনতার প্রশ্নে শুধু সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। সুভাষের ভাষায়, ‘স্বাধীনতা শিশুর হাতের খেলনা নয়, চাইলেই তা পাওয়া যায় না। তার জন্য মূল্য দিতে হয়, সংগ্রাম করতে হয়। কোথায় তার প্রস্তুতি?’

তথ্যপঞ্জি:

১৯.    মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, রমেশচন্দ্র মজুমদার, আনন্দ পাবলিশার্স; কলকাতা ১৯৬৫
২০.    সত্যরঞ্জন বক্সী’র নিবন্ধ, ফরোয়ার্ড পত্রিকা; ২ জানুয়ারি ১৯২৯
২১.    ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস, সুপ্রকাশ রায়, দে’জ পাবলিশার্স; কলকাতা ১৯৮৭
২২.    মৃত্যুঞ্জয়ী, তথ্য-সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার; ভারত, মার্চ ১৯৮২

(……………………………………………………………………চলবে)

আগের পর্বগুলোর লিংক:

অনন্য সুভাষ (১) http://sonelablog.com/archives/24619

অনন্য সুভাষ (২) http://sonelablog.com/archives/24727

অনন্য সুভাষ (৩) http://sonelablog.com/archives/24827

অনন্য সুভাষ (৪) http://sonelablog.com/archives/24920

অনন্য সুভাষ (৫) http://sonelablog.com/archives/25039

১জন ১জন
0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ