১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে কোলকাতা কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেস উপলক্ষ করে সুভাষ সারা বাঙলার বিপ্লবীদের সংগঠিত করেন এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন, সুভাষ নিজেই এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর জিওসি’র দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এই বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত ছিলো পদাতিক বাহিনী, নারী বাহিনী, মোটরসাইকেল বাহিনী, এবং মেডিকেল কোর বাহিনী। ওই সময় ১৯২৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় এই বিষয়ে সম্পাদকীয়তে বলা হয়:
‘স্বেচ্ছাসেবকদিগের নিয়মানুবর্তিতা প্রশংসনীয়। শ্রীযুক্ত সুভাষ চন্দ্র বসু সর্বদা উপস্থিত থাকিয়া তাহাদিগকে জাতির সেবায় উদ্বুদ্ধ করিয়া তুলিতেছেন, এই জন্য শ্রীযুক্ত বসু ধন্যবাদার্হ্য। সায়াহ্নের সঙ্গে সঙ্গে কুচকাওয়াজের মাঠে ঢাক ও বিউগল বাজিয়া ওঠে, উহাতে আসন্ন যুদ্ধের একটা উৎসাহজনক ভাব লোকের মনে জাগিয়া ওঠে।’[১৪]
১৯২৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকা পুনরায় লিখলো:
‘প্রত্যহ হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক মার্চ করিতেছে এবং অশ্বারোহী দলকে শিক্ষিত করা হইতেছে। স্বেচ্ছাসেবিকাগণ জয়ঢাক ও বিউগল বাজাইয়া প্যারেড করিতেছে। দেশবন্ধু নগরের দিকে অবিরাম জনস্রোত বহিতেছে। সেখানে রীতিমতো উৎসবের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে।’[১৫]
কয়েক হাজার সদস্যের এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দ্বারা সামরিক কায়দায় সজ্জিত হয়ে সুশৃঙ্খলভাবে সুভাষ কংগ্রেস মণ্ডপ পরিদর্শন করেন। এই সময় সুভাষ কংগ্রেস সভাপতি মতিলাল নেহেরু’কে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। পরোক্ষভাবে এখানে তিনি একটি সামরিক বাহিনীর মহড়া প্রদর্শন করেন। এই বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সই তখনকার কংগ্রেসের ছায়া সামরিক বাহিনী হিসেবে কাজ করে। এই বাহিনীই পরবর্তীকালের আজাদ হিন্দ ফৌজ’র অঙ্কুর। ১৯২৮ সাল থেকেই এই বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বাহিনীই সারা বাঙলার বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকে।
সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের বক্তব্যের পর কংগ্রেসের সভাপতি মতিলাল নেহেরু তার ভাষণে বলেন:
‘স্বেচ্ছাসেবক দলের অপূর্ব বিধি-ব্যবস্থা, অশ্বারোহী ও পদাতিক দলের সুশৃঙ্খল নৈপুন্য, সর্বোত্র অধিবাসীদের স্বদেশপ্রেমের যে উদ্বেল লহরী নর্তণ লক্ষ্য করিয়াছি, তাহাতে স্বরাজ্য’র স্বপ্ন আমার মনে উদিত হইয়াছে।
আমি দেখিলাম, এখানকার প্রত্যেকেই এই অনুষ্ঠানটি সফল করিবার জন্য সাহায্য-সহযোগীতা করিতেছেন। আজ মনে হইতেছে আমরা সত্যিই বুঝি স্বাধীন, ভারতভূমি বুঝি সুখ ও সম্পদশালীনী হইয়াছেন। আপনারা আজ প্রমাণ করিয়াছেন যে, আপনারা সত্যিই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সম্পদের যোগ্য অধিকারী। সেই অধিকারের বলেই স্বরাজ নিশ্চই আপনাদের করতলগত হইবে।’[১৬]
বিভিন্ন রাজ্যের কংগ্রেস নেতারা সুভাষের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু খুশী হতে পারলেন না একজন। তিনি হলেন অহিংস নীতির প্রবক্তা স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এর সর্বাধিনায়কের বেশে সুভাষের ওই তেজদীপ্ত চেহারাটাকে এতোটুকুও প্রসন্ন দৃষ্টিতে দেখতে পারলেন না মহাত্মা গান্ধী। তাই প্রকাশ্য ভাষণে তিনি বললেন, ‘এতো পার্ক সার্কাসের সার্কাস’। কেউ কেউ একটু এগিয়ে গিয়ে গিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সাথে কণ্ঠ মিলালেন; ‘খোকা ভগবান’ বলে কটুক্তি করলেন সুভাষকে। আসলে ওরা কেউই চাননি বাঙালিদের মধ্য থেকে একজন নেতা উঠে আসুক।
বিপ্লবী ভূপেন্দ্র কিশোর রক্ষিত রায়’র ভাষায়:
‘কলিকাতা কংগ্রেস অধিবেশন বিপ্লবী ভারতের ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কংগ্রেসের এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীই হলো আজাদ হিন্দ ফৌজ’র মূল ধারা।’[১৭]
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বাহিনীর অগ্রভাগে ছিলেন, বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ, সত্যরঞ্জন বকশী, সত্যগুপ্ত, মাস্টারদা সূর্যসেন, পূর্ণ দাস, যতীন দাস, পঞ্চানন চক্রবর্তী, প্রতুল ভট্টাচার্য, জগদীশ চ্যাটার্জী, বিনোদ চক্রবর্তী, যতীশ জোয়ার্দার, বিনয় বসু, দীনেশ গুপ্ত, ননী চৌধুরী, সৌরভ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, গনেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, আবদুল খালেক প্রমুখ বিপ্লবীগণ এই বাহিনীর পুরোভাগে ছিলেন। নারীদের গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল লতিকা বসু।
এই অধিবেশনে মতিলাল নেহেরু যখন গান্ধী প্রণিত ডোমেনিয়ন স্ট্যাটাস লাভের জন্য প্রস্তাব রাখেন, সুভাষ তখন প্রতিবাদ করেন। বাঙলার পতিনিধি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন সুভাষ। সুভাষ দীপ্ত কণ্ঠে বললেন:
‘ওই আধখানা স্বাধীনতা আমি চাইনে, আমি চাই পূর্ণ স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতায় কেনো খাদ নেই, শর্ত নেই; আছে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেবার অধিকার।’[১৮]
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরে উল্লেখিত বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বাহিনীর অগ্রভাগে যাঁরা ছিলেন সেই টিমে আমার দাদা আবদুল খালেক’র নামও এসেছে খোদ বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বাহিনী’র নথিপত্র থেকে। আমি গর্বিত একজন মহান ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীর উত্তরসূরি হতে পেরে।)
তথ্যপঞ্জি:
১৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ ডিসেম্বর ১৯২৮
১৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৮
১৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৮
১৭. বাঙলায় বিপ্লববাদ, নলিনী কিশোর গুহ আনন্দ পাবলিশার্স; কলকাতা ১৯৭৬
১৮. আমি সুভাষ বলছি, শ্রী শৈলেশ দে, দে’জ পাবলিশার্স; কলকাতা ১৯৭৩
(…………………………………………………………………চলবে)
আগের পর্বগুলোর লিংক:
অনন্য সুভাষ (১) http://sonelablog.com/archives/24619
অনন্য সুভাষ (২) http://sonelablog.com/archives/24727
অনন্য সুভাষ (৩) http://sonelablog.com/archives/24827
অনন্য সুভাষ (৪) http://sonelablog.com/archives/24920
৬টি মন্তব্য
লীলাবতী
যত পড়ছি ততই শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পাচ্ছে নেতাজীর উপরে।
সাতকাহন
ধন্যবাদ লীলাবতী।
মিথুন
‘ওই আধখানা স্বাধীনতা আমি চাইনে, আমি চাই পূর্ণ স্বাধীনতা।’ এমন বলিষ্ঠ উচ্চারণ বলেই তিনি আমাদের নেতাজি।
সাতকাহন
ধন্যবাদ মিথুন।
স্বপ্ন
এমন নেতা আর আসবেন না।
সাতকাহন
ধন্যবাদ স্বপ্ন।