
নির্মলাকে বললাম,
আমার মাকে তুমি দেখেছো?
কতদিন হলো মা আমার সাথে কথা কয় না!
নির্মলা বলল,
দূর ! মাকে আমি দেখবো কেমনে !
মা তো এখন আকাশপানে,
স্বর্গের দেবীর আসনে।
হ ঠিক কইছো,
এই দেখো..এই দেখো-মাকে মনে পড়তেই মা আমার চোখের সামনে ভাসছে-
মায়ের সেই মধুর হাসি! সেই কণ্ঠস্বর ।মা যেনো আমার কাছে এক জীবন্ত ছবি।কিন্তু কথাতো কয় না ?
ডাকেও না- খোকা বলে আর !
নির্মলা কইলো,
কইবে কথা তোমার মা,
বুঝবে তোমার ভাষা-
মাকে তুমি দাও না
একখান চিঠি ।
আমি তাই করিলাম;
হঠাৎ বিদ্যুত চলে যাওয়ায় হারিকেনে আলো জ্বালালাম।জানালার পাশে ঝিঝি পোকাদের স্বাক্ষী রেখে লিখছি আমি মাকে চিঠি,,,
“মা তুমি কেমন আছো?
কথাটিও বলতে পারলাম না ওমনি কানে ভেসে আসে সেই চিরচেনা আপণ কন্ঠ!
‘খোকা তোর অফিস ফেরা হলো?
হ্যা মা এইতো এলাম।
আবারো চিঠি লেখার চেস্টা
“কতদিন হলো মা তোমাকে দেখি না”!
বলা শেষ না হতেই চোখের পর্দায় ভাসছে মধ্য রাতে খোকার অফিস ফেরার অপেক্ষায় ডাইনিং টেবিলে ভাত নিয়ে আধো ঘুম চোখে, জেগে আছে মা। মাকে যদি বলতাম-
এতো রাত করে কেনো জেগে থাকো মা ? আমি নিজেইতো খেতে পারতাম !
মা বলতো..
হয়েছে তোর খাওয়া,কি না কি খাছ কে জানে!
চোখ জলে ভরে গেলো।
আবারো চিঠি লেখার চেস্টা
আজ আমার তুমিও নেই বাবাও নেই।অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেলো বটবৃক্ষদের ছায়া এখন আর পাই না।নিজেকে বড় অসায় অসহায় লাগে।সেই যে বাবাকে শেষ বার দেখলাম।ইমিগ্রেসনে গ্লাসের ভেতর দিয়ে আমার দৃস্টি যত দূর গিয়েছিলো।তখনি মনে চিন করে ব্যথা উঠেছিলো-এটাই হয়তো বটবৃক্ষ বাবার সাথে আমার শেষ দেখা।
আর চিঠি লেখা হলো না।আবারো অতীত দৃস্টির দর্শন।
সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করা সদা হাস্যোজ্জল মুখের বাবার প্রতিচ্ছবি।বাবা আমাকে কখনোই হুকুম দেয়নি আর তুমি ছাড়া তুই করেও বলেনি।তোমাদের ছাড়া জীবন আমার কেমন চলছে একবার যদি দেখতে এসে ।
পাশেই নির্মলা বললো,
কে বললো তোমায় মা বাবা আমাদের দেখেন না।তাঁরা সব সময় সর্বোক্ষণ আমাদের মনের মাঝেই বিরাজমান। আমাদের জীবন চলার পথে তাঁরা আর্শীবাদ হয়ে থাকেন বিপদে আপদে সাফল্যে।
আমি বললাম,
তাইতো জীবন যুদ্ধে কখনো হেরে যাইনি।অঢেল ধনাঢ্য না হলেও তাদের আর্শীবাদে সততা , বিবেককে বিক্রি করিনি।
নির্মলা বলল,
আমি যাই তুমি লিখো।আমি থাকলে তোমার মা’র কাছে লেখা চিঠি আর শেষ হইবো না।
নির্মলাও চলে গেলো।আমার চোখেও একটু একটু করে তন্দ্রায় অস্তিমিত হল।
“কে জানি আমাকে পিছনের দিকে জোরে জোরে টানছে! আমার নিঃস্বাস চেপে ধরেছে যেনো মৃত্যু আমার নাকের ডগায়,আমি আপ্রান চেস্টা করছি দৌড়ে পালাবার কিন্তু আমার দূরত্বের কোন প্লাস পয়েন্ট হয় না,ফিরে আসছি একই স্থানে-আমি স্থির। এখনি মনে হয় জানটা যাবে কোন এক অশুরের হাতে,,।।
চিৎকারের শব্দে মা আমায় জড়িয়ে ধরে বলেন,
ভয় পাস কেন খোকা আমিতো আছি -ওটা তোর দুস্বপ্ন স্বপ্ন ছিলো ! তোরে বোবায় ধরছিলো!!
মা হাসেন আর বলেন।
পাগল ছেলে! মাঠের দূরন্তপনা একটু কমাইলেইতো পারিস !
এরকম অসংখ্য স্মৃতি মাকে নিয়ে যা লেখা শুরু করলে শেষ হবার নয়।যার মা নেই কেবল সেই বুঝে মা হারানোর কি যে ব্যাথা।বুঝতে পারলাম আমাকে ঘুমদেবী ভর করেছিলো।এখন ঘুমালে চিঠি লেখা আর হবে না।
আবার চিঠি লিখার চেস্টা,
তখনো আমরা মধ্য বিত্তের পরিবার।বাবার সামান্য আয়ে ছয় জনের সংসার চলে।সাধ্য ছিলো না বলে সাধ বলে কখনো আমার কিছুই ছিলো না।
এক বার মনে আছে মা ? তুমি নিজে না খেয়ে আমাদের মুখে সবগুলো খাবার তুলে দিয়েছিলে।আমরা বললে তুমি বলতে, ডেগে এখনো অনেক ভাত আছে-তোরা খেয়ে নে আমি পরে খাবো।
অথচ ডেগের তলায় কিছুই ছিলো না।আজ আমার ভাতের অভাব নেই কিন্তু স্মৃতি মন ভুলে না-ভুলতে দেয় না।সব কিছুই আছে এখন- শুধু তুমি নেই।
নির্মলা আবারো এলো।
কি হলো চিঠি লেখা হলো?
নির্মলা কাছে এসে উকিঁ দিয়ে লেখা দেখে বলে।
এইরে এতোক্ষণে মাত্র চার লাইন লিখেছো?
আমি বললাম।
কি করবো!
আমি লিখতে শুরু করলেই স্মৃতিরা আসে।
মানে ! এ আবার কোন স্মৃতির পালায় পড়লে ?
দূর! তুমি যা ভাবছো তা নয়- মানে অতীত সামনে আসে্।
ও তাই! মা আমার স্বপ্নেও আসেন, কত কথা কই আমরা।
আমি কহিলাম,
তুমি কত ভাগ্যবতী, তুমি স্বপ্নে মায়ের দেখা পাও।
আর আমি! জানো-একসময় আমিও স্বপন দেখতাম প্রচুর- এখন আর দেখি না।কোন স্বপ্নই কেনো ঘুমের ঘরে আসে না তা বুঝতে পারছিনা।
নির্মলা বলল,
এটা তোমার অতি শোকে কাতর বলে।
আমি বললাম হয়তো তাই।তুমি আবারো না হয় একটু ঘুরে আসো। আমি চিঠিটা লিখে শেষ করি।
“পরম শ্রদ্ধেয় মা
জানি না তুমি এখন কোথায় কেমন আছো তবে মন বলছে-তুমি স্বর্গীও মহলে ভালো আছো।জীবনের পড়ন্ত বেলায় কেবলি তোমার কথা মনে পড়ে-নিজের অজান্তে তোমাকে দুঃখ দেয়ার অনুশোচনাগুলো ভাবি ।নতুবা এমন কেনো হবে।
আজ প্রায় আটবছর হলো তোমার দেখা নাই।আবদার করতেই তোমার আচঁলে মুখ লুকানো আর হয়ে উঠেনা।দূরন্তপনায় পড়শীঁদের নালিশে তুমি বেত হাতে নিয়ে আমার পিছু আর দৌড়াও না।
জানো মা তুমি যখন রাগে ক্ষোভে বেত নিয়ে আমাকে তাড়া করে পিছে পিছে আমার সাথে তুমিও দৌড়াতে তখন আমি মিটমিটিয়ে হাসতাম আর দৌড়াতাম।বাবা সামনে পড়লে আত্ম রক্ষার্থে বাবার পিছনে বাবার পাঞ্জাবীটি ধরে মুখ লুকাতাম।
সে সময় এলাকায় টিভি ছিলো না।টিভি দেখতে হলে যেতে হতো কয়েক মাইল পথ হেটে।সে সময় ছোট্র মনে কৌতুহল বশতঃ টিভি দেখে যখন রাত করে বাড়ী ফিরতাম তখন তুমি জেগে থাকতে বাবার কাছে যেনো আমি ধরা না পরি।তখন তুমি ছিলে আমার প্রকৃত বন্ধু প্রকৃত সাপোর্টার।এখন আর সেই যুগটিও নেই আর আমরা যারা বাবা মা হয়েছি তাদের সন্তান ফেরার অপেক্ষায় রাত জাগিনা। শৈশবের সব কিছুই মনের কোণে এখন স্পস্ট যেনো ছবি হয়ে ভাসছে আর ভাবি সেই দিনগুলি গেলো কই!
যতটুকু জানি আপণ মানুষ গত হলে বাস্তবে না হলেও স্বপ্নে দেখা দেয়।তুমিওতো আমার বোন ভাইয়ের স্বপ্নে প্রতিনিয়ত ধরা দিচ্ছো- কথা বলছো-হাসছো কিন্তু আমার স্বপ্নে তুমি কেনো আসো না-ডাকো না কেনো- খোকা কই গেলি?
তাহলে আমি কি তোমার নিকট কোন অপরাধ করেছিলাম ? তেমনটিতো আমার মনে নেই।যদি বা মনের অজান্তে কোন অন্যায় কখনো করে থাকি তবে ক্ষমা করে দাও না।লোকে বলে- মা বাবার কাছে সন্তানের সাতখুন মাফ তাহলে আমার বেলায় কেনো নয় মা ! বলো কেন নয়?
ক্ষমা করো মাফ করো
জানা অজানা যত অপরাধ,
আমিতো তোমার নাড়ী মানি
তোমারি দেহের অংশ আমি।
ক্ষমা করো মাফ করো
ভুল যত আমার,
দুনিয়াবী তাড়নায় যদি অপরাধী হই
তাও তোমারি-তোমার আপণ আমি।
শৈশবের শত আবদারে করোনিতো রাগ
যৌবনের কতো শত বেমান তর্কে
করোনিতো কখনো মুখ কালো,
নিজ গুণে মাফ করে,
সন্তানের সব অপরাধে
তুলোনি অভিযোগ করেছো কেবলি বার বার ক্ষমা,
আজ তেমনি আর একটি বার করো না আমায় ক্ষমা
এসো আর একটি বার স্বপনে আমার।
কদমুছি নিবো তোমার
দেবো না হারাতে তোমায় আর,
আমি কাঙাল তোমার আদরের অপেক্ষায়।
ঠিক সেসময় মায়ের কণ্ঠ
খোকা কি করছো ?
আমি এদিকসেদিক তাকাই।কোথাও কেউ নেই।শুধু নির্মলার শক্ত খাটে ঘুমন্ত দেহটা ছটফট করছে।তবে যে মা ডাকলো আমায় ভাবনায় পড়ে গেলাম।আবারো মায়ের সেই মধুর কণ্ঠ৴
;খোকা বাহিরে আয়, আমিতো দূরদেশে চাদের বুড়ীর সাথে বসবাস করছি।
বাহিরের আকাশটা আজ আগুনঝরা জোৎস্নায় জলমল করছে।চাদটাও আজ কচি যৌবনায়।নীলাকাশে সাদা মেঘের সাথে চাদ দৌড়াচ্ছে।আমি ঘর হতে বাহির হলাম। জ্বলমল চাদে মা বসে আছেন দুহাত বারিয়ে৴যেনো আয় খোকা আয়। খোকাকে ডাকছেন।
চিঠিটা লিখেছিস খোকা ?
বিচলিত আমি।মা চিঠি চাচ্ছেন।আনন্দে আত্মহারা আমি।
হ মা লিখেছি৴এই যে,এই পুরো এক পৃষ্ঠা৴তোমার কাছে এটা পাঠাবো কি ভাবে মা? একটু জ্ঞান দাওনা।
কেন ভুলে গেছিস? ছোট বেলায় আমি যে তোকে খাতার পৃষ্ঠা ছিড়ে এ্যারোপ্লেন বানাতে শিখাইছিলাম,তা কি ভুলে গেছিস?
না মা ভুলিনি।
এ্যারোপ্লেন বানিয়ে আমার দিকে ছুড়ে মারলে আমি পেয়ে যাবো।
ঠিক আছে মা।
বলে মাটিতে হাটুগেরে বসলাম।কাগজটি মাটিতৈ রেখে মাথা নীচু করে কাগজের প্লেন বানাচ্ছি আর চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছি।বানানো শেষে এ্যারো্প্লেনটা ছুড়ে মারলাম আকাশপানে চাদের বুড়ীর কাছে।
—
নির্মলা ঘুম থেকে উঠে দেখলো আমি কাত হয়ে শুয়ে আছি।পাশেই ছিলো চিঠিটা হাতে নিলো।পড়া শেষে চিঠিটা লুকিয়ে ফেলে আমাকে জোরেসুরে ডাক দিলো।
চৈতন্য ফিরে নির্মলাকে বললাম।
মাকে চিঠি দিয়েছি৴৴
নির্মলা বলল.
হুম এতক্ষণে পড়ে ফেলেছেন৴
সুখবর৴ স্বপ্নেও এসেছেন।
১৬টি মন্তব্য
নিতাই বাবু
ভালো লিখেছেন, দাদা। আপনার লেখার ভাষায় আমিও বলছি, ক্ষমা করো মা আমায়”
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ দাদা।
সৌবর্ণ বাঁধন
মাকে নিয়ে লেখা গুলো সত্যিই বিশুদ্ধ অনুভূতির। শুভকামনা।
মনির হোসেন মমি
অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয়।
মোঃ মজিবর রহমান
মায়ের কছে ক্ষমা নয় মায়ের দেনা পরিশোধ করতে শিখি মনির ভাই। খুব সুন্দর উপস্থাপন।
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ ভাই।
নার্গিস রশিদ
ক্ষমা করে দাও সব মা। শুভ কামনা।
মনির হোসেন মমি
আমীন।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ক্ষমা কেন চাইবো বরং মা বেঁচে থাকতে তার যত্ন নেয়া দরজার। পাশে থাকা দরকার যা আমরা করিনা। চিঠি ভালো হয়েছে। শুভ কামনা 🌹
মনির হোসেন মমি
আপনার মন্তব্যই আমার চিঠির পরোক্ষ ভাব প্রকাশ।জীবিত থাকতে সন্তান মাকে কতটা খুশি করতে পেরেছিলেন তা সে নিজেও জানেন না। সন্দেহ ছিলো তার মায়ের সেবায় ত্রুটি ছিলো কিনা তাইতো পরিবারের সবায় মাকে স্বপ্নে দেখলেও সে কেন দেখেন না ? তার ভেতরে অনুশোচনা আফসোস কাজ করে তাই সে সন্দিহান হয়েই স্বর্গবাসী মায়ের সাথে কথা বলতে মরিয়া হয়ে উঠেন।ক্ষমা চাওয়াটা মায়ের প্রতি তার অগাধ ভালবাসার ফলস্বরূপ।
আর হ্যা অবশ্যই জীবিত থাকতে মায়ের কদর করতে হবে।নতুবা চিঠি দাতার মত মন ছটফল করবে।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
রেজওয়ানা কবির
কি লিখবো বুঝতেছি না, মা কে নিয়ে লেখা এমন চিঠি মা ওপারে থেকেও পেয়েছে। মায়েরা আসলে কখনোই হারিয়ে যায় না থেকে যায় অন্তরে সবসময়। আল্লাহ মা কে জান্নাত নসিব করুক আমিন।শুভকামনা ভাইয়া।
মনির হোসেন মমি
ছুম্মা আমীন।ধন্যবাদ আপু।
হালিমা আক্তার
মাকে নিয়ে লেখা চিঠি,আর কি মন্তব্য করতে পারি। সকল মায়েরা ভালো থাকুন। আল্লাহ সকল সন্তান কে মায়ের সেবা করার তৌফিক দান করুন। শুভ রাত্রি।
মনির হোসেন মমি
আমীন। ধন্যবাদ আপু।
সাবিনা ইয়াসমিন
মায়ের স্থান/অবদান সবকিছুর উর্ধ্বে। যতদিন বেঁচে থাকেন সন্তানকে আগলে রাখেন, যখন সবাই চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে শান্তির আশ্রয়ে চলে যায় তখনও মায়ের আত্মা তার সন্তানের জন্য ব্যকুল থাকে। সকল সন্তানই এক সময়ে মায়ের প্রয়োজন বুঝতে পারে। কেউ সময় থাকতে কেউ সময় শেষে। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল মমতাময়ী মা।
শুভ কামনা 🌹🌹
মনির হোসেন মমি
আমীন।সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আফা।