নার্গিস রসিদ
প্রবাসী হওয়ার পথটা সহজ না প্রবাসে। প্রবাসীদের দুঃখ কেউ বুঝে না। এই ব্যাপারটা দেশের স্বজনদের বোঝানোই যায় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অটোমেটিকভাবে প্রবাসীরা হিংসার পাত্র হয়ে যায়। হয়তো তারা অনেক কষ্টের টাকা দিয়ে প্লেনের টিকিট করে দেশে আসলো ছেড়ে যাওয়া জন্মভূমির সংস্পর্শ পাওয়ার জন্য বা নিজের স্বজনদের এক পলক দেখার জন্য। কিন্তু তা স্বজনদের বোধগম্যই হয় না। আসলে তারা বুঝতেই পারে না দেশ ফেলে অন্য দেশে থাকা কতখানি কষ্টের।
দেশে আসাটা প্রবাসীদের জন্য “ব্যাটারি রিচার্য “ এর মতো। চিরপরিচিত সমাজ, স্বজন, আবহাওয়া, গাছপালা, পাখ-পাখালি আর নিজ ভাষায় কথা বলতে পেরে তারা যে কতখানি সুখ পায় তা তারাই জানে। নিজ ভাষা ফেলে দিয়ে অপরিচিত মানুষের মধ্যে দিন পাড়ি দেয়া, শুধু পেটের ধান্দায় আর নিজ পরিবারে মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বিদেশে মানুষ কী কষ্ট করে তা কেমন করে বুঝবে দেশে থাকা মানুষরা?
অনেক প্রবাসীকে আপন পরিবারের লোক দ্বারা লাঞ্চনা গঞ্জনার সম্মুখীন হতে হয়। সম্পত্তি থেকে কীভাবে বঞ্চিত করা যায় তার পরিকল্পনা আঁটতে থাকে। প্রবাসীদের মধ্যে একটা আবেগ কাজ করতে থাকে ফেলে আসা পরিজনদের জন্য। আর সেটার সুযোগ নেয় পরিজনরা।
অনেক প্রবাসীকে পৈত্রিক সম্পত্তি তো দিতেই চায় না, এমনকি মাথার ঘাম পায়ে ফেলা অর্থ দ্বারা কেনা নিজ সম্পত্তি দখলে নিতে চায় দেশের মানুষেরা। অনেক প্রবাসীকে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়। নিজের করা বাড়িতে থাকতে দিয়ে আপন ভাইবোন বাড়ি দখল করে নেয় এরকম ঘটনা অনেক আছে।
বিদেশে থেকে বাবার সম্পত্তি চাওয়া যেন একটা বিরাট অপরাধ দেশের মানুষের কাছে। প্রবাসী মানে সে আর বাংলা দেশের নয়। ট্যাগ দিয়ে দেয় “প্রবাসী”। এটা কেন যে মনে করে তা আল্লাই জানে। একটা মানুষ যেখানেই থাকুক না কেন, মনে মনে সে নিজ দেশকেই ধারণ করে, এটা নিজ দেশের মানুষ বুঝতেই চায় না।
একজন প্রবাসী মন ভালো করার জন্য দেশে যেত, কিন্তু তার স্বামী যেতে পারত না ছুটি না থাকার জন্য। নিরাপত্তার জন্য একলা না থেকে বাবার পাঁচ তলার উপরে একটা ঘর করতে চেয়েছিল, যাতে কারো বোঝা হতে না হয়। সেটা হয়ে গেল তার বিরাট অপরাধ। আপন মা আর ভাই মিলে গঞ্জনার স্বীকার হতে হলো তাকে। অথচ ভাই সেখানে ঠিকই ফ্ল্যাট বানাতে পারবে । বাবা মারা যাওয়ার পর তো সেও কিন্তু ভাগীদার।
দেশে গেলে অনেক রকম কাজে সবসময় বাড়ি থেকে বাইরে যেতে হয়। দরজার কলিংবেল টিপলে বিরক্তি মুখ দেখতে হয়েছে তাকে। সে প্রবাসী ঝামেলা দিতে চায়নি। সে চেয়েছিল এক কপি চাবি যা দ্বারা সহজেই সে কাউকে ঝামেলা না দিয়ে বাইরে থেকে ভেতরে আসতে পারবে। এক ভাগীদার আর এক ভাগীদারকে চাবি দিলোই না কিছুতেই। এই হলো ভুক্তভোগী প্রবাসীর অভিজ্ঞতা নিজ ভাইবোনদের কাছ থেকে।
আমাদের দেশের দরিদ্র মেয়েরা পরিবারের মুখে হাসি ফোটানর জন্য আরব দেশ গুলোতে কাজ করতে গিয়ে নানা রকম অত্যাচারের সম্মুখীন হয়, হয় যৌন অত্যাচারের স্বীকার । কিন্তু সেই মেয়ে গুলো দেশে ফিরলে তার সেই আপন জন রা আর নিতে চায়না। কারন সে এখন খারাপ মেয়ে। বিপদে পড়লে সেই তথাকথিত আপন জন দের স্বার্থপর কদর্জ চেহারাটা সামনে আসে।
এক প্রবাসী দেশে গিয়ে ভেবেছিল আর বিদেশে যাবে না। কিন্তু এমন অবস্থার মধ্যে পড়তে হলো যে কিনা দুঃখে আত্মহত্যা করেছিল। নিজ ভাতিজা দ্বারা অপমানিত এবং বিতাড়িত হতে হয়েছিল তাকে।
প্রবাসী মানে দেশের মানুষকে টাকা দাও আর টাকা দাও। টাকা চাওয়ার শেষ নাই । সুটকেস ভরা উপহার নিতে হয় আর তা শুধু পকেটে ভরা পর্যন্ত । তার পরেই সব শেষ। তুমি আর কেউ না। “কেন আসো বারে বারে”, “কে তোমাকে দেখার জন্য বসে আছে?” বাক্যবানে জর্জরিত হয় । সে কী কষ্ট করে বিদেশের মাটিতে, কেমনভাবে দিন যায়, তা তারা বুঝতেই চায় না। তারা ভাবে, গাছে গাছে টাকা পয়সা ঝুলে থাকে। সেগুলো প্রবাসীরা পেড়ে নিয়ে চলে আসে ।
প্রবাসীর আর এক বিড়ম্বনা তাদের সন্তান নিয়ে বাজে মন্তব্য শোনা । দেশের মানুষের ধারণা বিদেশে বড়ো হওয়া মানে ঢালাওভাবে তারা দুশ্চরিত্র । ভালো ইউনিভার্সসিটিতে চান্স পেলেও সেটা কোনো ক্রেডিট নয়।
ডিভিশন করা বা বিভেদ সৃষ্টি করা আর এক বিড়ম্বনা প্রবাসীদের জন্য। কতখানি অন্য রকম হয়ে গেছে তা নিক্তি দিয়ে মাপতে থাকে দেশে থাকা স্বজনরা। আচার আচরণ কেন অন্য রকম? যেমন “ ধন্যবাদ” আর “দয়াকরে “ শব্দগুলো বেশি ব্যবহার করা, দিনে বেশি বেশি চা পান, বাজারে গিয়ে দামাদামি না করে জিনিস কেনা, যখন তখন বাড়ি থেকে বের হওয়া এগুলোর অভ্যাস হওয়াটা হলো সে আর দেশি নয়।
একটু বেশি কনফিডেন্স হওয়া, নিজের কাজ নিজে করা, চলা ফেরাতে স্বাবলম্বী এইসবিই দেশি না হওয়ার আর একটা লক্ষণ। ।
প্রবাসে গিয়ে বেশিভাগ মানুষকে প্রথম দিকে হাবুডুবু খেতে হয়। নানা রকম ডিফারেন্ট পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হয় । ভাষাগত সমস্যা, পেট চালানোর জন্য কাজের ব্যবস্থা, একটা বন্ধু সার্কেল গড়ে তোলা, কাউন্সসেলিং এর ব্যবস্থা, সেই দেশের কালচার জানা, সমাজটাকে জানা, নতুন দেশের নতুন নিয়ম-কানুন জানা এসব। প্রথমেই বিরাট জবের আশা করে যদি কেউ যায় তবে সেটা হবে বিরাট বোকামি।
আর যখনই প্রবাসী সারভাইভ করার জন্য যে কাজ পায় সেই কাজ করে তা শুনে দেশি মানুষেরা তাকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতে থাকে। এই মানসিকতা প্রবাসীদের জন্য আর এক বিড়ম্বনা। দেশে যারা দুর্নীতি করে টাকা কামায় করে, বা অন্যের সম্পত্তি বেদখল করে সেটা খারাপ নয়। অন্য দেশ থেকে আসা মানুষেরা বা সেই দেশেরেই নাগরিকরা ঠিকই এসব অবলীলাক্রমে এগুলো করে যায়। কিন্তু যত সমস্যা আমাদের দেশি মানুষের। কোথায় এটাকে বলা উচিত survibing skill অর্জন করেছ। যেটা কিনা বিদেশিরা নিজেদের সন্তানকে স্কুলে থাকাকালীন অবস্থাতেই ছুটিতে কাজ করতে পাঠায় হাত খরচার টাকা নিজে কামাই করা শেখার জন্য। আর আমদের মধ্যবিত্ত মানসিকতা হলো নাক সিটকানো।
প্রবাসীদের দেশে আর একটা বিড়ম্বনা হলো “বিদেশে থাকো, এখন আমাদেরকে কেন নিয়ে যাওনা?” নিয়ে যাওয়াটা যে তাদের হাতে নয় সেই দেশের নিয়ম-নীতির উপরে তা তারা বুঝতেই চায় না।আমেরিকায় প্রবাসী হলে অন্য নিকটজনকে নেওয়া যায়, কানাডাতে ছাত্র হয়ে গিয়ে দুই বছরের মধ্যেই P.R এর জন্য আবেদন করা যায়। আরব দেশগুলোতে ভিসা কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু মুশকিল হলো UK প্রবাসীদের জন্য। এখানে নিয়ম-নীতি দিনকে দিন কঠিন করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য প্রবাসী হওয়াকে নিরুৎসাহি করা। কিন্তু এখানে বসবাসকারী প্রবাসীদের দেশে থাকা স্বজনরা এটা বুঝতেই চায় না। তারা মনে করে ইচ্ছা করেই এটা করা হচ্ছে।
বেশিভাগ প্রবাসী আমাদের গরীব দেশের বড়ো পরিবার থেকে আসে। এসে পরিবারের হাল ধরতে হয়। মাটি কামড়ে পড়ে থাকে আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশে টাকা পাঠায়।
এমন অনেক প্রবাসী আছে বাবার টাকাতে যারা পড়া শেষ করেছে, কিন্তু ফ্যামিলি ব্যাকগ্রউন্ড শিক্ষিত না থাকার জন্য আর বিরাট পরিবারের সদস্য থাকার জন্য তাদের কথা হলো যে কাজ পারো করে পরিবারকে সাপোর্ট করতে হবে। নিজের মতামত সেখানে থাকে না। তারা পড়ে অনেক কষ্টের মধ্যে। সার্টিফিকেট পানিতে ফেলে দিয়ে odd কাজ করতে হয় আর দেশে থাকা বিরাট পরিবারকে সাপোর্ট দিতে হয়।
শুধু odd জবই নয় তাদের কে বিদেশে নিয়ে গিয়ে পড়াশুনার খরচ বহন ঘর ভাড়া সব দায়িত্ব তার উপর।
কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর দেখা যায় তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।কারন সে প্রবাসী। এই হল বিচার।
নিজেদের জীবন কে কঠিন বাস্তবের মধ্যে ফেলে দিয়ে অনেক পরিশ্রম,ঘাম,ত্যাগ – তিতিক্ষা চড়াই, উৎরাই পার করতে হয় তাদের। থাকতে হয় নিজেদের জীবন বাজী রেখে, উপস্থিত বুদ্ধি রেখে, সহনশীলতা আর সব পরিবেশকে মানিয়ে চলে কত প্রবাসীকেই নিজ জন্মভূমি পরিজন কে ফেলে কাজ করে যেতে হয়, পরিবার কে সাপোর্ট করে যেতে হয় কয়জন তার খোঁজ রাখে আর কয় জনেই বা তা বুঝতে পারে।
আর মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বিরাট সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেলী যাদের কঠোর পরিশ্রম করা টাকা দিয়ে বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ ফুলে ফেঁপে উঠছে তাদের
দেখাশোনা করছে কয় জনা? তাদেরকে discriminate হতে হয় এয়ারপোর্ট থেকেই। এই হলো আমাদের শ্রেণি বিন্যাস। কারণ তাদের চেহারাতে থাকে পরিশ্রমের ছাপ, বাক্স-পোটরাগুলোও ভিন্ন রকম। এয়ারপোর্টের কর্মচারীদের বুঝতে বাকি থাকে না চিনতে।
প্রবাসীদের কিছু কষ্টের কথা জানালাম মাত্র। কতজন খোঁজ রাখে তাদের কষ্টের কথা? কি ভাবে তারা পরিবারকে সাপোর্ট করে? নাটকে দেখানো হয় নিগেটিভ ভাবে। হাসি তামাসার বস্তু হিসাবে।
নিজ দেশে যখন প্রবাসীরা যায় তখন দরকার নাই টেবিল ভরে খাবার দেয়া। দরকার ভালোবাসা, তাদের অবস্থা অনুধাবন করা। তাদেরকে “প্রবাসী” বলে আলাদা না করা। নিজ দেশে যেয়ে দেশের আলো-বাতাস বুক ভরে নেওয়া আর আপন মানুষের
সাহচর্য তাদের জন্য কাজ করে অক্সিজেনের মতো। যা কিনা পরদেশে গিয়ে আবার কঠোর জীবন শুরু করতে সাহায্য করে।
দরকার তাদের পাঠানো টাকার সৎ ব্যবহারে সাহায্য করা, যাতে তারা নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারে। লাইফ ইনস্যুরেন্স এবং পেনশনের সুযোগ থাকা। বিভিন্ন NGO দের প্রচারের মাধ্যমে দরিদ্র মেয়ে গুলোকে শেখাতে হবে নিজের ভাবনা যেন তারা আগে ভাবে। কষ্টার্জিত টাকা যেন নিজ অ্যাকাউন্টে রাখে।
প্রবাসীরা চিৎকার করে যেন বলতে চায় বা তাদের মনের কথা “আমি তোমাদেরেই লোক, এই মোর পরিচয় হোক “ ।
তারা যেন বলতে চায় আমরা এই পৃথিবীরই লোক, পৃথিবী থেকে বের হয়ে অন্য গ্রহের বা অন্য গ্যালাক্সির নই। প্রবাসী মানে বিসর্জিত প্রতিমা নয়। বিসর্জন মানেই তাকে আর নেওয়া যাবে না।
সমাজ কর্মির ডাইরির ঝুলি থেকে
১০টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
কেউ হই নিজে দেশে পরবাসী আর কেউ হই পরদেশে পরবাসী। আর পরদেশে পরবাসী অপরিচয় বোবাকান্নার মতো। অনেক সময় সব থেকেও কিছুই নাই এর মতো অবস্থা।
নার্গিস রশিদ
সহমত, অনেক ধন্যবাদ এবং শুভকামনা ।
মোঃ মজিবর রহমান
আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম
নার্গিস রশিদ
কেমন করে নিজ দেশে পরবাসী হলেন কিছু না মনে করলে জানাবেন কি?
রোকসানা খন্দকার রুকু
প্রবাসে গিয়ে যে তারা কি করে এটা দেশের লোকজন জানেনা। ভাবে তারা অনেক সুখে থাকে, কষ্ট নেই তাই তাদের পাওনা দিতেই চায়না। বরং প্রতিবছরই তাদের কাছে আশা করে টাকার। ভালো থাকুক আমার প্রবাসী ভাই বোনেরা।।।
কৃতজ্ঞতা অশেষ আপনার লেখার জন্য।
নার্গিস রশিদ
আপনি যে তাদের কষ্ট অনুধাবন করতে পেরেছেন এই জন্য অনেক ধন্যবাদ। অনেক শুভ কামনা ভালো থাকবেন।
মনির হোসেন মমি
আমি নিজেও প্রবাসে ছিলাম প্রায় ছয় বছর।দেশ দেশের মানুষের অভাবটা হারেহারে টর পেয়েছি কষ্ট কী জানি।কায়িক মানষিক কষ্ট করার পরও ওরা ঠকে পরিবার থেকে।সঞ্চিত অর্থ অনেকে গচ্ছিত ঠিক মত পায় না।
সুন্দর উপস্থাপনা।
নার্গিস রশিদ
অনেক ধন্যবাদ বোঝার জন্য। প্রবাসে থাকার মানুষ গুলো এই কষ্ট গুলো বেশী বুঝতে পারবে।
শুভ কামনা।
হালিমা আক্তার
প্রবাসে যারা থাকে, একমাত্র তারাই বুঝে জীবন কত কষ্টের। তাদের কষ্টের অনুভূতি দেশে থাকা বেশির ভাগ প্রিয়জনরা বুঝতে পারেনা। কষ্টের নদী পার করেও পায় না কখনো কূলের দেখা। শুভ কামনা রইলো।
নার্গিস রশিদ
আপনি যে ব্যাপার টা অনুধাবন করতে পেরেছেন এই জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন ,শুভকামনা।