ছায়া থাকে….

বন্যা লিপি ২৩ আগস্ট ২০২১, সোমবার, ০৪:৪৫:৩৯অপরাহ্ন অণুগল্প ১১ মন্তব্য

কখনো বিপরীত লিঙ্গের দুটো মানুষের সাথে বন্ধুত্ব বড্ড দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। মুখে মুখে নিজেদের মতামত নিজেরাই নির্ধারন  করে অন্য মানুষের কাছে নিজের একটা আলাদা পরিচয় /পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর থাকি সর্বদা  আমরা। এটাও একটা খেলা। বড্ড মারাত্মক মস্তিষ্ক প্রসুত চতুর খেলা। মুখ ও মুখোশের মতো। যাবতীয় বন্ধুত্বের দাবিদার আমরা নিজেরাই নির্ধারন করি বন্ধুত্বের পরিসীমা। একসাথে চললাম বহুবার, বহু বেহিসেবি দিন রাত্রির অগণিত ভালোলাগা মুুহুর্ত। দিন শেষ হবার আগে দিনলিপি লিখতে গিয়ে কিছু অংশ বার বার ভাবি কোন শব্দে প্রকাশটা বসাবো সঠিক অক্ষর দিয়ে! আমার চারপাশ ভরে আছে সবুজের ক্যানভাসে। আমি বরং কংক্রিটের এপার থেকে দেখে যাই দেয়ালের ওইপারে উড়ছে ফড়িং, উড়ছে প্রজাপতি…..। হিসেবের খাতাটা আমি খুঁজে বের করতে পারিনা কখনো। ক্যাসেনটা, এ্যালজেব্রার হিসেব কষার গনিতজ্ঞ হতে হলে উল্টে যাবে ডায়রীর পাতা। ভরে যাবে অর্থের হিসেবে। ব্যাংক ব্যালেন্সের হিসেব নিয়ে ভাবতে বসলে পায়ের তলায় শিশির ভেজা ঘাসের স্পর্শ পাওয়া হবে না আমার কখনো। আমি ক্যালকুলেট করে তরিৎ হিসেবটা নামিয়ে নেই সময় বাঁচাতে। দিগন্ত তা নয়, পারফেকশনিস্ট হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে নিয়েছে অল্পসময়ে কপোরেট শাখায় হোক আর ব্যাক্তিজীবনেই হোক। দিগন্ত কলিগ হিসেবে সহ্য করার মত অন্তত বলাই যায়। দীর্ঘদিন ধরে একই কর্পরেট শাখায় আছি বলে সহকর্মি থেকে একটু ওপরে এগিয়েছে আমাদের এই সম্পর্ক। তাকে অন্তত আমি বন্ধুত্বের সম্বোধনে সংজ্ঞায়িত করিনা নিজ মন থেকে। কোনো সম্পর্কের নাম থাকতেই হবে এমন কেন হবে? না….. কোনো নাম নেই। বরং স্বাচ্ছন্দ্য থাকুক অফিস কলিগ পরিচয়ে। কতগুলো হলুদ অলকানন্দা ফুল জড়ো হয়েছে এই দশ তলা  অফিস ক্যান্টিনের থাই গ্লাসে ঢাকা জানালার ওইপারে। লাঞ্চটাইমে আজ দিগন্ত আমার জন্য খাবার অর্ডার করলো। নিষেধ করলেও শুনবে না জানি ভেবে দুবারের বেশি বারন করিনি। সামনের মাসেই আমার জন্মদিনে দিগন্তকে আমি ট্রিট দিয়ে শোধ করে দেব ভেবে নিয়ে আপাতত চুপ চাপ হলুদ অলকানন্দায় মনোনিবেশ করা যেতে পারে। খাওয়া শেষে দুজনার জন্য দুকাপ কোল্ডকফি নিয়ে এসে মুখোমুখি বসলো…..

: তুমি কি করে জানলে আমার এখন ঠাণ্ডা একমগ কফি খুব দরকার ছিলো! দিগন্ত শুধু ঠোঁট বিস্তৃত করে একটা স্নিগ্ধ হাসি ছুঁড়ে দিলো এক পশলা ভেজা হাওয়ার মত। ইদানীং দিগন্ত মাঝে মাঝেই চিন্তার দরজায় এসে কপাট আগলে দাঁড়ায়। মন এবং মস্তিষ্কে চিন্তার ব্যায়াম চলে কিছু সময়। তারপর আবার অন্য চিন্তা এসে দখল নেয় মন মস্তিষ্ক। দুটো চিন্তা নিয়ে একসাথে ব্যায়াম সম্ভব হয়না। কিছু যোগবিয়োগ জরুরী হয়ে পড়ে তখন। এক চিন্তা থেকে একটা নিয়ে, আরেক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তা বাদ দিয়ে যোগবিয়োগের এই ব্যায়ামিক কসরৎ আমি মনোজগতে একা একাই করি। আমার মুখাবয়বে ছায়া ফেলতে দিইনা। যে ছায়ায় দিগন্ত কোনো জানালা বা দরজার হদিস পেয়ে যেতে পারে।

মাঝে মাঝে চোখ চলে যায় দেয়ালে ঝুলতে থাকা ঘড়ির পেন্ডুলামের দিকে। আলস্যে হলেও ঝুলতে ঝুলতে ঠিক পৌঁছে যাচ্ছে সময়ের শেষ সীমায়। তবু আমার আলস্যি ছাড়েনা চিন্তায়।

 

– আমি জানি

: কি জানো?

– এই তোমাকে!

: কী জানো?

– বললাম তো! জানি….

: কিইইই জানো? সেটাই তো জানতে চাইছি

– এই যে! তুমি কেমন সেটাই….

: কেমন আমি?

– জানি…..তোমার অভ্যাসগুলো,তোমার স্বভাব তোমার পছন্দ এইসব

: হা হা হা হা হা……..

– হাসছো কেন?

: স্বভাব,অভ্যাস, পছন্দ এগুলো জানো বলেই আমাকে জানা হয়ে গেলো?

– আর কী লাগে একজনকে জানতে?

: আচ্ছা,,, তুমি আকাশ দেখো?

– হঠাৎ এ প্রশ্ন?

: আকাশ দেখো!

– ওইতো আকাশ! দেখব না কেন?

: কি দ্যাখো?

– কি আশ্চর্য!  আকাশের আবার কী দেখব?

: এটা হচ্ছো তুমি…..

– মানে?

: বুঝে দেখো!

– বুঝলাম নাতো!

: এবার তো বোঝা উচিত তোমার নাম আর ওই আকাশটার মধ্যে পার্থক্যটুকু  বোঝার মত সময় নাওনি কখনো সময়ের কাছ থেকে।

– হেয়ালি ভরা কথার মানে কে বুঝেছে কবে?

: আমি কি জানি জানো?

– বলো শুনি….

: যে  হেয়ালি শব্দটার মানে জানে! সে অবশ্যই হেয়ালি করতেও জানে। আমি বরং হেয়ালি শব্দটার সঠিক শব্দার্থ জানিনা। আমি যা/ যেভাবেই বলে প্রকাশ করি! আমার মনে হয় সেটুকুর কিছু অংশে আমি নিজে বাস করি…… সে জায়গাটাকে তোমার মত অনেকেই হেয়ালি বলে অবলিলায় নাম দিয়ে যায়

–  আমার নাম আর আকাশের ব্যাবধান নিয়ে কি যেন বললে?

: তোমার নাম কী?

– দিগন্ত!!

: এখনো বলে বোঝাতে হবে ব্যাবধান?

– আমি বুঝিনা….

: এটাই হচ্ছে জানা এবং বোঝার সাংঘর্ষিক পার্থক্য বুঝলে? তোমার নাম ধরে যে ডাকে! সে নিজেও জানেনা সে ডাকলো কেবল একজন ভূমি বা বনভূমির শেষপ্রান্ত কে। আর আকাশ ছড়িয়ে আছে পুরো পৃথিবীটা জুড়ে।

– তুমি কোন কথা থেকে কোন কথায় জাম্প মারলে তাইতো বুঝলাম না কিছু!

: জেনে রাখো, কখনো সব কথার মানে জানতে নেই,শুধু কিছু কথা  নিয়ে মন এবং মস্তিষ্কের ব্যায়াম করা যেতে পারে। ওতে নিত্য নতুন জানার জগতটায় জোনাক পোকার মত নীলচে আলো এসে অন্ধকার দূর করে আবছায়া কিছু আলো পাওয়া যেতে পারে।

– আজ তোমাকে অন্যরকম লাগছে, মনে হয় চিনি না তোমারে…

: কখনো তোমার মনে হয়েছিলো চেনো আমাকে?

–  তোমার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে এখন ভয় পাচ্ছি

: হা হা হা হা…… তাহলে ভয়টা কিসের তা তুমি একটু হলেও বুঝতে পারছো…..

– এটুকু বুঝতে পারছি,,,, জানা এবং বোঝার বিষয়টা কখনো এককথায় প্রকাশ্য নয়।

: আমি বুঝতে পারছি তোমার মন এবং মস্তিষ্ক ব্যায়াম করতে শুরু করে দিয়েছে। এটা শুভ লক্ষন।

– আর কখনো কাউকে বলব না” আমি তোমাকে/ আপনাকে জানি”

: এই কথাটা তুমি উচ্চারন না করলেও পারতে

– কেন? উচ্চারন করে কী ভুল করলাম?

: তুমি কি করবে বা না করবে সেটা নিজেকে নিজে আগে বিশ্বাস দিয়ে বলবে। কাউকে বলে করতে হবে কেন? মানুষ বলে এক করে আরেক…. এখানেই মানুষ নিজেদের কাছে নিজেরাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে যা নিজেরাও জানে না। অন্য মানুষের চোখে তখন সেই মানুষটা মূল্যবোধহীন এক অ-মানুষ রূপে পরিচিত হয়ে ওঠে। তুমি ভাবতে পারো তখন কেমন লাগবে নিজের কাছে নিজেকে? মানুষই একমাত্র প্রাণী  যে মিথ্যা বলতে পারে। গাছ, ফুল,পাখি,প্রজাপতি,মৌমাছি,ভ্রমর, আকাশ,চন্দ্র,সুর্য, নদী,জল,হাওয়া,ইট,পাথর,ধুলো,বালি এরা কেউ মিথ্যা বলে না। এরা এদের নিজ নিজ চরিত্রও বদলায় না;  পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে পৃথিবীর শেষ অব্দি এরা এদের চরিত্র কখনো বদলাবে না। এরা একই রকম থাকে/ থাকবে। এরা কখনো কাউকে বলেনা আজ থেকে এটা করব না ওটা করব না, তারপর আবার ভুলে গিয়ে স্বভাবে ফেরেনা পুনরায়। ভেবে দেখেছ কখনো দিগন্ত?

– তুমি কী নীলা?

: আমি নীলা…… আর নীলা সবার সয় না……

৭৯৭জন ৬৮৭জন
0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ