
সতেরই মে , এভারগ্লেডস , মিয়ামি , ইউ এস এ
ঝড় উঠেছিল।
জুন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। তার আগেই ভয়াল ভয়ঙ্কর ঝড়ের ভাবগতিক দেখলাম। প্রবল সামুদ্রিক এই ঝড় ক্যাটরিনার সমতুল। সাব-ট্রপিক্যাল সাইক্লোন।
ঠিকছিল গতকাল সকাল থেকেই আমরা কাজ শুরু করে দেব । কিন্তু সাত সকালেই আকাশের মুখ ছিল ভার । কালো মেঘে ছেয়ে গেছিল সমস্ত অরণ্যের কিনারায় সমুদ্রের উপরে সারা আকাশ জুড়ে কেউ যেন নিকষ কালো মেঘের আলোয়ান বিছিয়ে দিয়েছিল । বিদ্যুৎ চমক আর হটাৎ আলোর ঝলকানি লেগে চিত্ত চমৎকৃত নয় বরং আমাদের বেশ ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলছিল।
তবে আমেরিকার আবহাওয়া সম্পর্কে আমি একটু আধটু পরিচিত। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়ানোর সময়ে ও গবেষণার ফাঁকে ফাঁকে এই দেশটাকে দেখার জন্যে মাঝে মাঝে বাইরে বেরিয়ে কখনো কখনো প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার সাক্ষী হয়েছিলাম। তবে আজ ভোরবেলায় রেডিওতে আবহাওয়ার খবর পাওয়ার আগে আমার মনমোহন গেজেটে অশনিসংকেত পেয়েছিলাম। ঝড়টা উঠেছিল মাঝরাত্রে মাঝসমুদ্রে কিন্তু সকালবেলাতেই মূলভূখন্ডে তার প্রাবল্য যে এতখানি হবে তা বুঝতে পারিনি।
রেডিও নিউজে ঝড়ের সংবাদ পেয়ে রিচার্ড বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। এদিকের ঝড় যে বড় সাংঘাতিক তা আমি জানি। কিন্তু রিচার্ডের ভয়ার্ত মুখ দেখে আমি আরো বেশি চিন্তায় পড়েছিলাম। আসলে রিচার্ড বেশ ডাকাবুকো ধরনের সাহসী লোক হলেও আদতে হনলুলুর বাসিন্দা । হনলুলু আমেরিকার দ্বিতীয় নিরাপদ শহর এবং তাও প্রশান্তমহাসাগরের কিনারায়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে এর অবস্থান হলেও হ্যারিকেন-এর ঝঞ্ঝাট সেখানে নেই বললেই চলে। উপরন্তু হনলুলুতে টর্নেডো বা বড় ঝড় পনের-ষোলো বছরে এক-দু’বার দেখা যায়। তাই ঝড় বা তার প্রাবল্য নিয়ে রিচার্ডের নিজস্ব অভিজ্ঞতা যে আহামরি নয় তা বোধহয় বলা বাহুল্য হবেনা ।
সে যাইহোক না কেন রিচার্ডই আমাকে নতুন করে মনে করলো, “অতলান্তিক মহাসাগরের এই সব সামুদ্রিক ঘূর্ণাবতকে বলে হ্যারিকেন। ডাঙায় সেটাই কখনো কখনো টর্নেডো বা টুইস্টারে পরিণত হয়।”
টুইস্টার – শব্দটা আমার কানে বাজলো। মনে পড়লো বেশ কয়েক দশক আগে এই নামেই হলিউডের এক বিখ্যাত সিনেমা তৈরী হয়েছিল। খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল বেন ও জো নামে দুই স্বামী-স্ত্রী ও একদল আবহবিদ-বিজ্ঞানীর ঝড় তাড়া করে বেড়ানোর কাহিনী।ওদের বলা হত ‘স্টর্ম চেজার’ । তিনজন এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পৃথিবী খ্যাত অস্কারজয়ী স্টিভেন স্পিলবার্গ ।
সিনেমায় যেমনটি দেখেছি ঠিক সেই রকম না হলেও আগুয়ান ঝড়টি কোন অংশে কম ছিল না। এই সব এলাকায় ঘূর্ণি ঝড় উঠলে তা বেশ কিছুদিন ঘুরপাক খেতে থাকে। ট্রপিক্যাল বা নিরক্ষীয় অঞ্চলের বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা এবং ভৌগলিক অবস্থান এই ঝড়কে দুর্মর ও মারাত্ত্বক করে তোলে।
আমি জানি ,ফ্লোরিডার এই অঞ্চলের বার্ষিক বৃষ্টিপাতের শতকরা সত্তর ভাগ হয় বর্ষায়। খুব সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রবল সেই বর্ষণ। ঝড়ের পর আমরা সেই প্রবল বৃষ্টিপাতের নমুনা দেখলাম।আমাদের বাংলার ডাউরি লাগা বর্ষা বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই যেন।
এভারগ্লেডস ন্যাশনাল পার্কের এই গেস্ট হাউসের বাইরে বেরোনোর কোনো উপায় ছিল না। ভাগ্যিস আমাদের গেস্ট হাউসের চারপাশে প্রায় পঞ্চাশ ফুট ব্যাসার্ধের একটা ক্লিয়ারেন্স আছে। নইলে প্রবল ঝড় যখন ছোট-বড় গাছের ডালপালা ইত্যাদিকে প্রবল ঝাঁকুনি দিচ্ছিল কিংবা লোফালুফি খেলা চলছিল তাতে বেশ কিছু বড় বড় গাছ দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে পড়ছিল। ওই রকম মূর্তিমান বৃক্ষের ভার সামলানো কংক্রিটের গেস্ট হাউসের পক্ষেও সম্ভব নয়। ঝড় প্রবল থেকে প্রবল হলে পর্যটকদের সুবিধার জন্যে আন্ডার গ্রাউন্ড ট্যানেল তৈরী আছে এখানে। আমরা ভাবছিলাম তেমন একটা ট্যানেলে আশ্রয় নেব কিনা কিন্তু দেখলাম ঝড়ের গতি ধীরে ধীরে কমে গেল কিংবা এদিক থেকে সরে গেল। ঝড়ের তীব্রতা কমে গেলেও বৃষ্টির ধারাপাতে বিরতি পড়েনি। তার মাঝেই আমরা এমন ঝড় বাদল নিয়ে আলোচনায় মাতলাম। শুরুটা অবশ্য রিচার্ড-ই করেছিল।
রিচার্ড বলল ,” এই জঙ্গলের উত্তরদিকে লেক ওকিচবি। আমেরিকার ঝড়ের ইতিহাসে এই লেকের নাম জড়িয়ে আছে। ”
আমি বললাম ,”তুমি কি নাইনটিন টুয়েন্টি এইটের ওকিচবি হ্যারিকেনের কথা বলছো যা কিনা পুয়ের্তো রিকোর সমুদ্রে ঘনীভূত হয়ে ক্রমে মূলভূখন্ডের দিকে এগিয়ে এসেছিল এবং যার ল্যান্ডফল ছিল বা ভূমি আঘাতের কেন্দ্র ছিল ফ্লোরিডার ওয়েস্টার্ন সমুদ্র সৈকত ?”
রিচার্ড আমার কথায় সায় দিয়ে বলল ,”রাইট ডক্টর বক্সী , তবে এটাকে অনেকে সান ফিলিপ সেগুনডো হ্যারিকেন ও বলে থাকে। বিশেষজ্ঞগণ আরো বলেন যে এটাই এখনো পর্যন্ত এই দেশের কিংবা উত্তর আটলান্টিকের ভয়ঙ্করতম ঝড়। অন্তত লিখিত ইতিহাসে তা চিহ্নিত।”
তারপর একটু চুপ করে গিয়ে গলা নামিয়ে সে বলল ,” প্রবলতম এই ঝড়ে কমপক্ষে চার হাজার একশো বারো জন মানুষ মারা গিয়েছিল। প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে বন্যায় ডুবে মারা গিয়েছিল প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। শুধুমাত্র পুয়ের্তো রিকোয় প্রায় পঁচিশ হাজার বাড়ি ঝড়ের প্রকোপে উড়ে গিয়েছিল। একলাখ বিরানব্বই হাজার ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছিল। পাঁচ লক্ষ নরনারী গৃহহীন হয়েছিলেন।
তাছাড়া এই ফ্লোরিডায় ওয়েস্ট পাম বিচে ঘণ্টায় প্রায় একশো পয়ঁতাল্লিশ মাইল বা ঘণ্টায় দুইশো তেত্রিশ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়েছিল। শহরের সতেরোশো বাড়ি চুরমার হয়ে গিয়েছিল। ক্রমে ঝড়ের একটু গতি কমলেও সেই ঝড় প্রবল বিক্রমে লেকের জলে ঝাঁপিয়ে পরে যার ফলে প্রবল চাপে লেকের জল দক্ষিণ দিকে উপছে পড়ে এবং প্রায় কুড়িফুট উচ্চতার জলপ্রবাহে শ’য়ে শ’য়ে বাড়িঘর বন্যার জলে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
স্বাভাবিক ভাবেই বিপদ কখনো একা আসেনি। ঝড় বৃষ্টি বন্যা। ”
আমি বললাম ,”বুঝেছি , প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর দুর্যোগ। এর একটা ব্যাখ্যা আছে কিন্তু বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যের কি ব্যাখ্যা দেবে ?”
রিচার্ড চুপ করে রইল। চোখের ভাষা দেখে বুঝলাম সেও সন্দিহান। সঠিক কারন জানতে সেও আমারই মত উদগ্রীব।
আমি বললাম, ” রিচার্ড ,মাঝ সমুদ্রে এই রকম ঝড়ের পাল্লায় পড়লে জাহাজ ,নৌকো,ইয়াট ,প্লেন ইত্যাদির কি হতে পারো ভেবেছো ?”
রিচার্ড বলল ,”ভাবিনি তা নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে যে যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে সেই সবগুলির ঘটনাস্থলের ঠিক ওই সময়ের আবহাওয়ার সঠিক রিপোর্ট সবসময় পাওয়া গেছে তা কিন্তু নয়। ”
(ক্ৰমশঃ )
Photo Courtesy: Google
৬টি মন্তব্য
আরজু মুক্তা
টুইস্টার কথাটা প্রথম জানলাম। গল্প এগিয়ে যাক।
শুভ কামনা
নবকুমার দাস
ধন্যবাদ দিদিভাই। রহস্যের কারনগুলি খোঁজার চেষ্টা করেছি এবং হয়ত সম্ভাব্য কারনগুলি সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারব। সঙ্গে থাকার জন্যে অনেক ধন্যবাদ জানাই।
রোকসানা খন্দকার রুকু
গল্প এগিয়ে যাক। পরের পর্ব্রের অপেক্ষায়।
নবকুমার দাস
ধন্যবাদ দিদিভাই। পরের পর্ব প্রকাশিত হয়েছে। পড়ার আমন্ত্রণ জানাই। । সঙ্গে থাকার জন্যে অনেক ধন্যবাদ জানাই।
মনির হোসেন মমি
গল্পটি শুরু থেকে পড়া হয়নি।এ পর্ব পড়ে মনে হল বড় মিস করে ফেলেছি।যাই হোক টুইস্টার ছবিটা আমি বহু বার দেখেছি কিন্তু বাস্তবে সেরকম দৃশ্য দেখা হয়নি।সাইন্সফিকসন গল্প এগিয়ে যাক।পারলে প্রতি পর্বের সাথে পূর্ব প্রকাশিত পর্বের লিংক যোগ করে দিতে তাতে আমার মত ফাকিবাজ পাঠক সহজেই পড়তে পারবে।ধন্যবাদ।
নবকুমার দাস
অসংখ্য ধন্যবাদ। সঙ্গে থাকুন। অনুসরণে সুবিধার জন্য পূর্ববর্তী অনুভাগগুলির লিংক দেখতে পারেন। আপনার প্রস্তাবের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।