এমনিতে জানুয়ারী মাস। তার উপর শীতের রাত। সে বছর প্রচন্ড শীত পড়েছিল। তাই রাতে ভ্রমন না করে ভোরের বাসে সাতছড়ি রওনা হলাম। দুপুর দেড়টায় হবিগঞ্জের সাতছড়ি পৌছালাম। বনের ভিতর বন বিভাগের ডোরমেটরীতে উঠে রুমে ব্যাগ রেখে হাত মুখ ধুঁয়ে বনের ভিতর রওনা হলাম। বনের প্রবেশদ্বারে হাতের বাঁদিকে যে ছড়া নেমে গেছে তার সঙ্গে লাগোয়া বড় একটি সেগুন গাছের মগডালে পখিগুলি বসে ছিল। জীবনের প্রথম দেখা পাখির ছবি তোলার জন্য উত্তেজিত হয়ে গেলাম। বেশ খানিকটা দূরে থাকায় ছবি তোলার তেমন সুবিধা করতে পারছিলাম না। তাই কিছুটা আগ পিছ করতে করতে হঠাৎ পাখিগুলি উড়ে গেল। এমন একটি পাখির ছবি তুলতে না পারায় মনটা বিষন্নতায় ভরে গেল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে যা হবার তাই হলো। তাই এটা নিয়ে আফসোস না করে টাওয়ারের দিকে রওনা হলাম। আশায় ছিলাম যদি টাওয়ারের আশে পাশে কোন উঁচু গাছে বসে তাহলে মনের মতন ছবি নিতে পারবো। শেষ পর্যন্ত সে আশায় গুড়ে বালি হলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো। টাওয়ার থেকে নেমে পড়লাম। পাখিটির আর দেখা পেলাম না।
জানুয়ারী মাসের শেষের দিকে টাওয়ার সংলগ্ন মান্দার গাছে ফুল ফোঁটে। ভোরে হরেক প্রজাতির পাখি সেই ফুলের মধু খাওয়ার লোভে পুরো গাছে ঝেঁকে বসে। খুব ভোরে উঠতে হবে। তাই রাত ৯ টার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করে ঘুমাতে গেলাম। ভোর ৫ টায় ঘুম থেকে উঠে সতীর্থকে সঙ্গে করে টাওয়ারের দিকে রওনা হলাম। তখনও ভোরের আলো ফোঁটেনি। আমরা ভোর পৌণে ৬ টায় টাওয়ারে উঠে যার যার মতন ক্যামেরা সেটিংস করে বসে রইলাম। এরই মধ্যে ভীমরাজ, কাক্কু স্রাইক. ময়না, কাঠশালিক সহ নানা প্রজাতির পাখির কলতানে মান্দার গাছ মুখরিত।
আমি পাখির উড়াউড়ির দৃশ্য দেখছিলাম। খুব ভাল করে খেয়াল করলাম কাঠশালিকের উপস্থিতিতে অন্য পাখিগুলি মান্দার ফুলে মধুর জন্য বসে না। ঠিক এমন সময় ক্যাঁ… ক্যাঁ… ক্যাঁ… শব্দে বেশ কয়েক প্রজাতির টিয়া এসে মান্দার গাছে বসলো। অন্যান্য টিয়া পাখির সঙ্গে আমার গতকালের না তোলা টিয়া পাখিটিও ছিল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে পাখিটিকে ক্যামেরা বন্দী করলাম। আমি কখনই ভাবতে পারিনি ভোরে মান্দার গাছের ফুলে Blossom-headed parakeet বা কইরিদি টিয়া বা ফুলটুসী বা ফরিয়াদি বা টুইনামের পাখির ছবি তুলতে পারবো।
কইরিদি টিয়া অনেকটা হীরামন টিয়ার মতন দেখতে। এরা সিটাকুলা রোসিয়েটা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ৩০-৩৬সেঃমিঃ দৈর্ঘ্য ও ৮০-৮৫ গ্রাম ওজনের মধ্যমাকারের পাখি। স্ত্রী পুরুষের পালকের রঙে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষে মাথা বাদে পুরা দেহ সবুজ পালকে আবৃত। মাথা ফ্যাকাশে বেগুনী লাল যা ঘাড়-গলায় গিয়ে কালো চিকন হয়ে মিশেছে। স্ত্রী পাখির ধূসর মাথাবাদে বাকি দেহের পালক সবুজ। মেয়ে ও পুরুষ পাখির চোখ হলুদ। উভয়ের উপরে চঞ্চু হলুদ ও নীচের অংশ কালো। পা ও পায়ের পাতা সবুজাভ ধূসর। লেজ ও লেজের আগা নীলাভ-সবুজ। লেজের অগ্রভাদ হালকা হলদে বর্ণের হয়। উভয়ের কাঁধে রয়েছে লাল রেখা। হীরামন পাখির মধ্যে এদের মধ্যে মূল প্রার্থক্য হচ্ছে এদের লেজের অগ্রভাগ হলুদ ও মাথা কম লাল।
জানুয়ারী থেকে এপ্রিল মাস এদেরে প্রজনন মৌসুম। প্রজননকালে গাছের খোঁড়লে বাসা বানায়। কাঠঠোকরা, বসন্ত বৌরি বা অন্যান্য খোঁড়লিবাসা পাখিদের খোঁড়ল দখল করে নিজেদের মতন বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়ে পাখি ৪-৫ টি সাদা বর্ণের ডিম পাড়ে। বাসা বানানো থেকে শুরু করে ডিমে তা দেয়া পর্যন্ত সবকিছুই মেয়েপাখিটি একাই করে থাকে। পুরুষ পাখি বাসা পাহাড়া দেয় ও ডিমে তা দেয়া অবস্থায় মেয়েপাখিটির খাবারের জোগাড় করে তা খাইয়ে দেয়। ২০-২২ দিনে ডিম ফুঁটে ছানা বের হয়। এদেরে আয়ুস্কাল ৭-৮ বছর। গুই সাপ ও সাপ ও গিরগিটি এদের ডিম খেয়ে ফেলে। তাই এরা হুমকির মুখে থাকে।
কইরিদি টিয়া আমাদের দেশীয় পাখি। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের সবুজ বন ও খুলনার সুন্দরবনে প্রচুর দেখা যায়। এরা সবুজ বনের পাখি। লোকালয়ে আসে না। তাই আমরা সচারচর দেখি না। গাছের ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে এরা খাবার খায়। পানির চাহিদা মুলত ফুলের মধু থেকে মিটায়। ইহা ছাড়াও বনের হরেক প্রজাতির রসালো ফলও এদেরে প্রধান খাবার। এক সঙ্গে ঝাঁকে থাকতে পছন্দ করে।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত,নেপাল,শ্রীলংকা,পাকিস্তান,চীন,ইন্দোনেশিয়া সহ সারা বিশ্বে এরা বিস্তৃত রয়েছে। বাংলাদেশের বন্য আইনে এরা সংরক্ষিত।
জ্বী কামাল ভাই। ১০জনের বেশী উঠা নিষেধ। কিন্তু পর্যটকরা সেটা মানতে চায় না। যে কোন সময় দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। বেশী দর্শনার্থী হলে আমি টাওয়ার থেকে নেমে পড়ি।
শুভ কামনা রইলো।
ধন্যবাদ ভাইয়া। আমিতো পাখির প্রেমে মজেই থাকি আর আপনার কল্যাণে তাদের জীবনযাত্রা, নাম, ধাম সব জানতে পারছি খুব সুন্দর করে। নিরন্তর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো
১৯টি মন্তব্য
তৌহিদ
আমারতো মনে হচ্ছে এদেশের টিয়াদের মধ্যে এটিই সবচেয়ে সুন্দর দেখতে। যদিও আমার যা ক্ষুদ্র পাখিজ্ঞান তা আপনার পোষ্ট থেকেই প্রাপ্ত।
ভালো থাকুন ভাইজান।
শামীম চৌধুরী
হুম! সত্যিই বলেছো। টিয়া প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এই টিয়া ও হীরামন টিয়া।
আরজু মুক্তা
কতো অজানারে জানলাম।
ধন্যবাদ আপনাকে
শামীম চৌধুরী
অসংখ্য ধন্যবাদ আপু।
কামাল উদ্দিন
সাতছড়ির টাওয়ারটায় উঠলে আমার ভয় লাগে কয়েকজন উঠলেই ওটা কাঁপে উঠে, এমনকি সিড়ির ধাপে পা ফেলে উঠতে গেলেও ওটা কেপে কেপে উঠে…….এমন চমৎকার রাঙা মাথার ফুলটুসী টিয়া কখনো দেখিনি, ভালোলাগা জানিয়ে গেলাম ভাইজান।
শামীম চৌধুরী
জ্বী কামাল ভাই। ১০জনের বেশী উঠা নিষেধ। কিন্তু পর্যটকরা সেটা মানতে চায় না। যে কোন সময় দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। বেশী দর্শনার্থী হলে আমি টাওয়ার থেকে নেমে পড়ি।
শুভ কামনা রইলো।
কামাল উদ্দিন
তবে কোন এক জানুয়ারির সকালে এই চমৎকার টিয়া পাখিদের খুঁজতে আমি টাওয়ারে উঠে অপেক্ষায় থাকবো।
শামীম চৌধুরী
আপনি ঠিক জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে বা ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে গেলেই দেখা পাবেন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
হীরামনের প্রেমে পড়ে গেলাম। খুব সুন্দর পাখিটা। আহ্ কত রকমের টিয়ার দেখা পেলাম , জানলাম আপনার জন্য। অফুরন্ত ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ভাইয়া। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন শুভ কামনা রইলো। শুভ সকাল
শামীম চৌধুরী
দিদিভাই,
আমি আশাবাদী আপনাকে আরো অনেক প্রজাতি পাখির প্রেমে জড়াবো।
শুভ কামনা রইলো।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ ভাইয়া। আমিতো পাখির প্রেমে মজেই থাকি আর আপনার কল্যাণে তাদের জীবনযাত্রা, নাম, ধাম সব জানতে পারছি খুব সুন্দর করে। নিরন্তর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো
রোকসানা খন্দকার রুকু
ফুলটুসি হা হা হা হা। কি সুন্দর নাম। মাথার উপর আলাদা রং হওয়ায় বেশ লাগছে।
শুভ কামনা রইলো ভাইয়া। শুভ সকাল।
শামীম চৌধুরী
পুরুষ পাখির মাথার উপর লাল রংটাই সৌন্দর্য বয়ে আনে।
শুভ কামনা রইলো।
আলমগীর সরকার লিটন
খুব সুন্দর এই টিয়া নিয়ে গান আছে কিন্তু মনে করতে পারছিনা শামীম দা
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ কবি দা।
প্রদীপ চক্রবর্তী
আজকের সকালবেলা টিয়াপাখির ডাকে ঘুম ভেঙেছে।
আমাদের বাড়ির উত্তর পাশের কয়েকটা গাছে ভর হলে টিয়েপাখি আসে।
আপনার লেখা পড়ে ভালো লাগলো,দাদা।
শামীম চৌধুরী
শুভ কামনা দাদাভাই।
জিসান শা ইকরাম
পাখির ছবি তোলাও তে দেখছি এক একটি অভিযানের মত। ভোর রাতে উঠে প্রস্তুতি নিয়ে বের হতে হয়।
টিয়া যে এত প্রজাতির হয় আপনি না জানালে তা আর জানা হতো না।
শুভ কামনা ভাই।
শামীম চৌধুরী
আমি প্রায়ই বলে থাকি আমার একেকটি ছবি একেকটি গল্প।
আপনিও ভাল থাকবেন।