অভাবে উড়ন্ত পোঁকাও খায়।

শামীম চৌধুরী ৫ নভেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ০৯:১২:৩২অপরাহ্ন পরিবেশ ১৬ মন্তব্য
আমার কাজিন এম ইঞ্জা ভাইয়ের আবদার ছিলো আমি যেন এই পাখিটি নিয়ে ব্লগে লিখি। তিনি আমার বার্ড ফটোগ্রাফীর একজন ভক্ত। তার উৎসাহ ও অনুপ্রেরনামূলক মন্তব্য ও উপদেশ আমাকে পাখি নিয়ে আরো বেশী কাজ করার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। তাই আজকের লেখাটা এম ইঞ্জা ভাইকে উৎস্বর্গ করিলাম।
 
অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ। স্বভাবতঃ এই সময়ে আমাদের দেশে শীতের আগাম বার্তা বয়ে আনে। দিনে তেমনটা গরম লাগলেও রাতে বেশ ঠান্ডার আমেজ পাওয়া যায়। আর সেই রাত যদি কাটানো যায় গহীন বনের ভিতরে কোন বাংলোয়। ভোরে কচি ঘাসে শিশিরের বিন্দু যেন রূপার এক আল্পনা বিছিয়ে রাখে। খালি পায়ে সেই শিশিরের উপর হেঁটে বেড়ানোর আনন্দটা অপূর্ব। ঠিক এমনই সময়ে আমরা তিনজন সাতছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
 
ভোরে সাতছড়ি পৌছে বনের এক কিলোমিটার পথ হেঁটে টাওয়ারে উঠলাম। তখনও সূর্য্যের আলো ফোঁটেনি। পাখির কলতানে পুরো বন মুখরিত। হরেক প্রজাতি পাখির উড়া-উড়ির দৃশ্য নিজ চোখে অবলোকন না করলে লেখায় বুঝানো কষ্টকর। টাওয়ারের চারিদিকে সবুজের অরণ্য। এরই মাঝে ধীরে ধীরে সূর্য্য উঁকি দিচ্ছে। সকালের ঠান্ডার আমেজটা কেটে যাচ্ছে। আমরা তিনজন পাখিদের খাবার খোঁজার দৃশ্য দেখছি। ওদের মাঝে খাবার নিয়ে নেই কোন আহাজারী। নেই কোন মারামারি। নিজ নিজ খাবার নিজেরাই জোগাড়ে ব্যাস্ত। এরই মধ্যে বেশ কয়েক প্রজাতির হরিয়ালের ছবি তুললাম।
 
টাওয়ারের উত্তর পার্শ্বে এসে দাঁড়ালাম। টাওয়ার থেতে ১০ ফুট দূরে একটি জংলী ফুলের গাছ। হঠাৎ নজরে পড়লো পাতা নড়ছে। গাছের পাতা নড়লেই বুঝতে পারি সেখানে কোন পাখির উপস্থিতি। ভাল করে দেখার চেষ্টা করলাম। দেখলাম খয়েরী কাঁঠবিড়ালি ফুল ছিঁড়ে খাচ্ছে। এমন সময় আমার পাশে থাকা ছোট ভাই জ্যোতির্ময় বললো-
ভাই ছোট এই পাখিটির নাম কি?
কখনোই দেখিনি।
আমি পাখিটিকে দেখার জন্য ভাল করে খেয়াল করলাম। তখনও আমার নজরে পড়েনি। হঠাৎ দেখি আমার চোখের সামনে পাখিটি ফুলে মধু খাচ্ছে। যাকে আমি দীর্ঘ ৬ বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি। অবশেষে পাখিটির ছবি তুলে নতুন আরেকটি পাখি ঝুলিতে যোগ করলাম। পরে জ্যোতিকে বললাম এটা Scarlet-backed flowerpecker বা লাল-পিঠ ফুলঝুরি।
লাল-পিঠ ফুলঝুরি Dicaeidae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত লাল কোমর ও বাদামী চোখের ৯ সেঃমিঃ দৈর্ঘ্যের এবং ৭.৫ গ্রাম ওজনের অতি ছোট পাখি। এদের প্রসারিত ডানা ৪.৮ সেঃমিঃ, পা ১.৩ সেঃমিঃ ও লেজ ২.৬ সেঃমিঃ হয়ে থাকে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে এদের পরিমাপের পরিবর্তন হতে পারে। যেমন বেশী পুষ্টিকর খাবার ও বেশী কায়িক পরিশ্রমের কারনে মাপের হেরফের হতে পারে। মেয়ে ও ছেলে পাখির চেহেরায় প্রার্থক্যে আছে। ছেলেপাখির মাথার চাঁদি, ঘাড়ের পিছনের অংশ, দেহের পিছনের ভাগ ও কোমর উজ্বল লাল বর্ণের হয়। কানের আচ্ছাদন ও মাথার পাশ কালো। লেজ নীল- কালো। বুকের পাশ ধূসর।
 
মেয়েপাখির পিঠ জলপাই-বাদামি। ডানা কালচে বাদামি। লেজ কালচে ও কোমর ও লেজের উপরি ভাগ উজ্জল লাল বর্ণের। এদের উভয়ের ঠোঁট সরু ও পায়ের পাতা কালো। অপ্রাপ্ত বয়স্কের পাখিগুলি দেখতে অনেকটা মেয়েপাখির মতন। সারা বিশ্বে ৭টি উপপ্রজাতির অস্তিত্ব আছে। এরই মধ্যে আমাদের দেশে Dicaeum cruentatum উপপ্রজাতির দেখা পাওয়া যায়।
 
লাল-পিঠ ফুলঝুরি প্রশস্ত পাতার চির সবুজ বন, গড়ান বন, মুক্ত বন,ঘেরা বুনো ফলের বাগান ও ফুল বাগানে বিচরন করে। এরা একা থাকতে পছন্দ করে। মাঝে মাঝে জোড়ায় থাকে। গাছের মগডালে বিশেষ করে ফুলের গুচ্ছে বা অন্যান্য পরজীবি উদ্ভিদে খাবার খোঁজে। খাদ্য তালিকায় রয়েছে পোকা-মাকড়,মাকড়সা, রসালো ফল ও ফুলের মধু। খাদ্যাভাবে মাঝে মাঝে উড়ন্ত পোকাও শিকার করে।
এপ্রিল-আগষ্ট মাস এদের প্রজননকাল। প্রজননকালে ছোট গাছে ঘন পত্রগুচ্ছে ঘাস, শিকড় ও মাকড়সার জাল দিয়ে বেঁধে ডিম্বাকার থলের মতন ঝোলানো বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়েপাখি ২-৩টা সাদা বর্ণের ডিম পাড়ে। ছেলে ও মেয়ে পাখি উভয়ে ডিমে তা দেয়। ১২ দিনে ডিম থেকে বাচ্চা ফুঁটে বের হয়। বাবা মা দুজনেই সংসারে কাজ করে ও ছানাদের পরিচর্যা করে।
 
ফুলঝুরি বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি। ঢাকা, খুলনা ও সিলেটের সবুজ বনে দেখা পাওয়া যায়। ইহা ছাড়াও ভারত,নেপাল,চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃত রয়েছে। এরা বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশে বণ্যপ্রানী আইনে এই প্রজাতি সংরক্ষিত।
বাংলা নামঃ লাল-পিঠ ফুলঝুরি
ইংরেজী নামঃ Scarlet-backed flowerpecker
বৈজ্ঞানিক নামঃ Dicaeum cruentatum
 
ছবিগুলি কাপ্তাই বড়ছড়া ও সাতছড়ি বন থেকে তোলা।
৮৪৬জন ৭৪৯জন
0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ