
আমাদের দেশে ৭ প্রজাতির টিয়া পাখি দেখা যায়। সবই আমাদের দেশীয় পাখি। এরা আমাদের আবাসিক পাখি হিসেবে গণ্য ও আমাদের দেশেই প্রজননের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করে। আমি ধারাবাহিক ভাবে সবগুলি টিয়া পাখির পরিচয় ও বিস্তারিত তুলে ধরছি। গত লেখায় ছিল চন্দনা টিয়া। পাঠক বন্ধুদের নিকট অনুরোধ রইলো তারা যেন সবগুলি টিয়া সম্পর্কে সম্যক ধরানা নেয়।
ছোটবেলা থেকেই নতুনত্বের প্রতি আগ্রহ ছিল বেশি। তাই সবসময় নতুন কিছু পাওয়ার জন্য অনেকটাই মোহগ্রস্ত হয়ে পড়তাম। বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রশিল্পী আদনান আজাদ আসিফের হাত ধরে প্রথম সাতছড়ির সবুজ বনে যাই। ভোর ৬টায় আমরা সাতছড়ি পৌঁছলাম। নতুন বন ও বনের রাস্তা দেখে ভালো লাগল। সবুজে ঘেরা বনে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেলাম। প্রায় ৮৯টি সিঁড়ি বেয়ে ওয়াচ টাওয়ারের গোড়ায় পৌঁছলাম। বেশ খানিকটা পথচলা ও সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার পর অনেকটা ক্লান্ত অনুভব হলো। তাই ওয়াচ টাওয়ারের নিচে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।
যাত্রা পথে আদনানের কাছে বনের গল্প শুনে বেশ উত্তেজিত ছিলাম। হরেক প্রজাতির পাখি এই বনে বিচরণ করে। যা দেখবো আর ছবি তুলবো সবই আমার কাছে একেবারে নতুন। টাওয়ারে উঠার পর ভোরের আলো ফুঁটে উঠলো। ওয়াচ টাওয়ারের পাশেই কাঁটাযুক্ত মান্দার গাছে হরেক প্রজাতির পাখি ফুলের মধু খাচ্ছে। বেশ কিছু প্রজাতির পাখির ছবি তুললাম। হঠাৎ করে মান্দারের ফুলে এক দল পাখি বসলো। পাখিগুলো দেখে উত্তেজনা বেড়ে গেলো। তাদের ফ্রেম বন্দী করলাম। পরে আদনানের কাছে পাখিগুলোর পরিচয় জানলাম এরা লটকনটিয়া বা লেজকাটা টিয়া।
লেজকাটা টিয়া ১৪ সে.মি. দৈর্ঘ্যের Psittaculidae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত Loriculus শ্রেণির ছোট আকারের গোলগাল দেহের একটি টিয়া পাখি। এদের ঠোঁট লাল এবং আগা হলুদ। দেহ সবুজ। কোমর লাল রঙের। চোখ বাদামি-পীতাভ ও মাঝখানটা কালো। পা ও পায়ের পাতা ফিকে-কমলা। নখ কালচে-বাদামি। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারায় ভিন্নতা আছে। মেয়ে পাখির গলার নীলকান্তমণি পট্টির সাহায্যে সহজে পুরুষ পাখি থেকে আলাদা করা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির চোখ বাদামি ও কোমর লাল। লেজের উপরি ভাগের ঢাকনা লাল-সবুজে মেশানো। দুই ডানা যখন আবৃত থাকে তখন লেজের উপরিভাগে লাল রং স্পষ্ট দেখা যায়। এদের লেজ খাটো বা ছোট বলে ‘লেজকাটা টিয়া’ পাখি বলেও পরিচিত।
লটকনটিয়া আদ্র পাতাঝরা ও প্রশস্ত পাতাওয়ালা চিরসবুজ বনে বিচরণ করে। গাছের মগডালে এদের বেশি দেখা যায়। সমুদ্রসমতল থেকে ১৮০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত এদের দেখা যায়। সচরাচর পারিবারিক দলে কিংবা সর্বাধিক পঞ্চাশটি পাখি ঝাঁক বেধে থাকতে দেখা যায়। বনের ফলজ গাছে এরা ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁজে বেড়ায়। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে বন্য ডুমুরের নরম ফলত্বক, রসালো ফল, বাঁশ বীজ ও ফুলের মিষ্টি রস। ঝুলে থাকতে এরা পছন্দ করে; গাছের ডালে উল্টো করে ঝুলে বিচরণ করে, খাবার খায়। বাদুড়ের মত উল্টো ঝুলে বিশ্রাম নেয়। অনেক সময় খাবারও উল্টো ঝুলে খায়। ওড়ার সময় চিটচিট শব্দে ক্রমাগত ডেকে যায়।
সাধারণত জানুয়ারি থেকে জুন লটকনটিয়ার প্রধান প্রজনন ঋতু। স্থানভেদে প্রজনন মৌসুমে ভিন্নতা দেখা যায়। এসময় মরা গাছের গর্তে এরা বাসা বানায়। বাসায় সবুজ পাতার পত্রফলক বিছিয়ে বসবাস করে। নিজেদের বানানো বাসায় এরা ৩-৪টি সাদা রঙের ডিম দেয়। পুরুষ ও মেয়েপাখি মিলে ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়।
বাংলা নাম: লটকনটিয়া বা লেজকাটা টিয়া
ইংরেজি নাম: Loriculus vernalis.
বৈজ্ঞানিক নাম: Vernal hanging parrot
ছবিগুলো সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে তোলা
১৮টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
দাদাভাই অনেক অনেক ধন্যবাদ। ফুল আর পাখি মিলে একাকার হয়ে গেছে। এতো সুন্দর করে ছবিগুলো তুলেছেন যে চোখ জুড়িয়ে গেল। লেজ কাটা টিয়াকে দেখে দারুণ লাগলো। টিয়ার ও সাত প্রজাতি তাও আমাদের দেশীয়!! কিন্তু আমরা দুর্ভাগা, এমন দেশে আছি যেখানে মানুষ ই মানুষ মেরে ফেলে সেখানে এসব তো ওদের কাছে ফেলনা। তাইতো প্রকৃতি হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য, সম্পদ। ধন্যবাদ ভাইয়া। শুভ কামনা রইলো
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ দিদিভাই।
আপনাদের কাছে আমার যে কোন ছবি ও লেখা ভাল লাগাই আমার স্বার্থকতা।
শুভ কামনা রইলো।
সুপায়ন বড়ুয়া
ফুল আর পাখি মিলে অপরূপ দৃষ্টি নন্দন হলো।
এতো সুন্দর ছবিগুলো দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল।
শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
অনেক অনেক কৃতার্থ রইলাম।
আপনার জন্যও রইলো শুভ কামনা।
জিসান শা ইকরাম
এই টিয়া আমি দেখেছি। লেজ নেই বলে ভাবতাম কোন কারনে হয়ত লেজ পরে গিয়েছে। উল্টো ভাবে ঝুলে খাবার খেতে দেখেছি এদের।
পাখির ছবি তুলতে কত যে পরিশ্রম করেন, তা আপনার বিভিন্ন লেখা পড়ে জেনেছি।
এমন পোস্ট দেয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে ভাই।
শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
চির সবুজবনে বা বনভূমিতে দেখে থাকতে পারেন। তবে এরা কোনসময়ই লোকালয়ে আসে না। শুভ কামনা রইলো।
আরজু মুক্তা
ফুল পাখি আপনি। সব মিলেই অসাধারণ, চমৎকার।
আমরাও বিমোহিত
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ ও কৃতার্থ মুক্তা আপু।
প্রদীপ চক্রবর্তী
ফুল আর পাখির ঠোঁটের রঙ একি।
লাল ঠোঁটি টিয়া আমার খুবি পছন্দের একটা পাখি।
যখন ক্লাস নাইনে পড়তাম তখন ৯০০ টাকা দিয়ে এমন একটা টিয়ে পাখি কিনেছিলাম। তবে ওটার লেজ ছিল লম্বা।
কয়েকমাস পর মরে যায়।
.
সব মিলিয়ে এক অনবদ্য উপহার দিলেন, দাদা।
শামীম চৌধুরী
আসলে সত্যিটা হলো যে, বনের পাখি খাঁচায় বেশী দিন বাঁচার কথা না।
উর্বশী
প্রথম দেখায় ছবিগুলো মনে হবে তুলি দিয়ে আঁকা।এবং আঁকিয়ে
খুব মনযোগী, মানে যিনি এঁকেছেন। আজ এই পাখি দেখে আমার ছোট কাকিমার কথা মনে পড়েছে।তিনি কিছুদিন আগে মারা গিয়েছেন,চিটাগং থাকতেন,কাকার চাকরির সুবাদে।যখন তিনি গ্রামে থাকা শুরু করলেন,তখন আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম।তিনি বলতেন” কে কে টিয়ার ঠোঁট বানাবে আসতে পারো ” পান বানিয়ে খাওয়াতেন,দেখতেন কার ঠোঁট কত লাল হয়। আজ আপনার লেখা,ছবি স্মৃতির ডাইরিতে ফিরিয়ে নিল।আপনার তথ্যবহুল লেখা অনেক ভাল যা একবারেই জানতে পারি। প্রথম পাখি সম্পর্কে আমি জানা শুরু করি রাজস্থানের একজন টিচার। আপনার মত নেশা, এটি নাকি তার সখ। মজার ব্যাপার তার পরিবার বিরক্ত।কোথাও বেড়াতে গেলে সাথে থাকা সদস্যদের কথা ভুলে যান যদি পাখিদের দেখা পান।
আজকের ফুল,পাখি আর আপনার উপস্থাপন অপরুপ শোভা বাড়িয়েছে। ভাল থাকুন,শুভ কামনা সব সময়।
শামীম চৌধুরী
আসলেই সত্যিটা তিনি বলেছেন। আমারও পরিবার থেকে বাঁধা আসে। তারপরও শখের নেশার জন্য সব উপেক্ষা করে বের হই। পাখি যখন পাই তখন আসলেও কারো কথা মনে পড়ে না।
ভালো থাকবেন।
শুভ কামনা রইলো।
আলমগীর সরকার লিটন
খুব সুন্দর শামীম দা
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ কবি দা।
তৌহিদ
এই পাখি আমি দেখেছি কিন্তু এটা যে টিয়া তা জানতামনা। আজই জানলাম আপনার লেখা থেকে। ছবিগুলি অসাধারণ হয়েছে।
ভালো থাকুন ভাইজান।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ ভাই।
রোকসানা খন্দকার রুকু
টিয়া পাখিও লেজ ছাড়া হয় এটা জেনে খুব অবাক হলাম। ফুল পাখি সবমিলিয়ে দারুন।
আপনার এমন অভিযান চলতে থাকুক।
শুভ কামনা রইলো ভাইয়া।
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ আপু।