
বয়স তখন আমার সবে তিন-চার। নব্বইয়ের দশক। পঁচাশি-ছিয়াশি সাল হবে। বাবা তখন একটি গান প্রায়ই গাইতেন। গানটি ছিল, “ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইবো না আর বেশিদিন তোদের মাজারে।“ বাবার কণ্ঠে গানটি শুনতে শুনতে একসময় মুখস্তই করে ফেললাম। প্রথম প্রথম ভাঙা ভাঙা বললেও পরে ঠিকভাবেই রপ্ত করেছিলাম। গানটি হয়তো ছিল আমার জীবনে শোনা প্রথম গান। প্রথম যেকোনো কিছুই একটা আলাদা গুরুত্ব বহন করে। গানটিও তাই।
সেসময় বাংলা সিনেমার খুব চাহিদা ছিল। বিনোদনের উপকরণ বলতে তখন টেপ রেকর্ডার আর কাঠের বাক্সে বন্দি সাদাকালো টেলিভিশন। টেপ রেকর্ডার এর রেডিওতে তখন সিনেমার বিজ্ঞাপন হত আর সাথে চলতো গান। বিভিন্ন শিল্পীর বিভিন্ন গান শোনানো হত। শুনতাম। সেইসময়ে এন্ড্রু কিশোর সিনেমাতে প্লে-ব্যাক করছেন হরদম। “নয়নের আলো” এবং “ভাই বন্ধু” ছায়াছবির গানগুলো তখন ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। “আমার সারাদেহ খেয়োগো মাটি”, “আমার বাবার মুখে”, “আমার বুকের মধ্যখানে”, “ভেঙ্গেছে পিঞ্জর” এমন আরও অনেক গান তখন মানুষের মুখে মুখে। বাদ যাইনি আমিও। “ভাই বন্ধু” যে বছর মুক্তি পায় সে বছর সর্বমোট ৬৭টি ছায়াছবি মুক্তি পেয়েছিল। আর এবছরই বেশ কয়েকটি ছায়াছবিতে এন্ড্র কিশোর এর গান ছিল। গান শুনতে শুনতে তাঁর গানের প্রতি আমার একটা আলাদা ভালোলাগা তৈরি হল।
এরপর আস্তে আস্তে যত বড় হতে থাকলাম, গান পছন্দ এবং নির্বাচনের রুপান্তর ঘটতে থাকলো। ব্যান্ড এর গানও তখন ধীরেধীরে সমান তালে চলতে থাকলো। বিটিভিতে মাঝেমাঝেই ব্যান্ড শো হত। দেখতাম। ধীরেধীরে রক-মেটাল গানের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। কিন্তু দিন শেষে গুনগুন করে “হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস”।
জীবনে বহু গান শুনেছি। বহু গান মনে রেখেছি। কিন্তু এন্ড্রু কিশোর এর বেশ কিছু গান হৃদয়ে লালন করে রেখেছি। মনের অজান্তে এখনও গেয়ে উঠি “আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান, সেদিন থেকে গানই জীবন গানই আমার প্রাণ”। যদিও আমি কিংবা বাবা কেউই গায়ক নই, কিন্তু তাঁর বেশ কিছু গান এতোটাই শিহরণ জাগায় যে, তাঁর গাওয়া গানগুলো গুনগুন করে গাইতে আমাকে বাধ্য করে।
ব্যক্তি হিসেবে এন্ড্র কিশোর এর একটি মহৎ গুন আমি খেয়াল করেছি। গানের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে বিচারকের ভূমিকায় থাকাকালীন কোনও প্রতিযোগীর প্রতি আপত্তিজনক কোনও আচরণ করতে দেখিনি। খুব সাবলীল এবং বিচক্ষণতার সাথে বিচারকের ভূমিকা পালন করতেন।
গতকাল আকস্মিক তাঁর মহাপ্রয়াণের খবরটি শুনে কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভূত হল। মনে হল কি যেন হারালাম। হ্যাঁ আমরা আরও একজন কিংবদন্তি হারালাম।
ওপারে ভালো থাকুক গানের পাখি।
২০টি মন্তব্য
ফয়জুল মহী
যুগ যুগ বেঁচে থাকবে গানের পাখির নাম।
রুমন আশরাফ
সত্যিই তাই।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
তার অভাব কখনোই পূরণ হবে না। যার কন্ঠ যেকোন অভিনেতার সাথেই মিলে যেত, এমন কন্ঠের কারুকাজ খুব কমই পাওয়া যায়। গত পঞ্চাশ দশক ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প কে একাই কন্ঠ দিয়ে ধরে রেখেছে। এমন কন্ঠশিল্পী বাংলাদেশে আর নেই , হবেওনা। খুব ভালো লিখেছেন।
রুমন আশরাফ
তাঁর অভাব পূরণ হবার নয়।
আলমগীর সরকার লিটন
অনেক বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই————
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
মৃত্যুর পর মানুষের ভালো গুণগুলো আমাদেরকে অভিভুত এবং নিজেকে সংশোধনের পথ করে দেয় —” ব্যক্তি হিসেবে এন্ড্র কিশোর এর একটি মহৎ গুন আমি খেয়াল করেছি। গানের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে বিচারকের ভূমিকায় থাকাকালীন কোনও প্রতিযোগীর প্রতি আপত্তিজনক কোনও আচরণ করতে দেখিনি। খুব সাবলীল এবং বিচক্ষণতার সাথে বিচারকের ভূমিকা পালন করতেন”।
ধন্যবাদ।
রুমন আশরাফ
সত্যিই উনি মানুষ হিসেবে চমৎকার ছিলেন।
সুপায়ন বড়ুয়া
“হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস”।
ভাবান্তরে মানুষ হারায় একটি সুরের মাঝে
কখন যে পৌছালেন তিনি মানুষের হৃদয় মন্দিরে।
হ্যাঁ আমরা আরও একজন কিংবদন্তি হারালাম।
বিনম্র শ্রদ্ধা শিল্পীর প্রতি। ভাল থাকুন পরপারে।
রুমন আশরাফ
উনার বিকল্প উনি নিজেই।
প্রদীপ চক্রবর্তী
সত্যিই আমরা একে একে গুণীজন হারাতে বসেছি।
অপারে ভালো থেকো গুণীজন।
বিনম্র শ্রদ্ধা।
রুমন আশরাফ
অনেকদিন পর মন্তব্যের প্রত্যুত্তর দিচ্ছি। দুঃখিত। উক্ত প্রত্যুত্তর দেবার আগেই আরও একজন গুণী হারালাম। ওস্তাদ আলাউদ্দিন আলীকে আমরা হারালাম।
আরজু মুক্তা
ওনার গানের ভক্ত সবাই। আর কণ্ঠও ভরাট
রুমন আশরাফ
আমিও খুব পছন্দ করি।
জিসান শা ইকরাম
গতরাতে ফেসবুকে থাকাবস্থায় তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনি। খুবই খারাপ লাগায় ফেসবুক থেকে তখনই বের হয়ে আসি।
এমন ভড়াট কন্ঠের গান আমি আর কারো গলায়ই শুনি নি। যে গানগুলো পোস্টে উল্লেখ করেছেন, প্রতিটি গানই খুবই জনপ্রিয় গান ছিল।
আমরা একজন গুনি গায়ককে হারালাম। যার শূন্য স্থান পুরন হবে না।
তার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলী।
পোস্টের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
শুভ কামনা।
রুমন আশরাফ
এতো সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনার আদেশ এবং অনুরোধ রক্ষার্থেই উক্ত লেখাটি লেখা। সর্বোপরি আপনার অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়েই এই লেখাটি লিখেছি। শুভ কামনা রইলো ভাই।
মাহবুবুল আলম
এন্ডু কিশোর তার গানের মাধ্য লক্ষ লক্ষ ভক্তের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন চিরকাল। এর প্রার্থনাই করি।
রুমন আশরাফ
সত্যিই তিনি এভাবেই বেঁচে থাকবেন।
তৌহিদ
এন্ড্রু কিশোর একজন গুনি মানুষ ছিলেন। অমায়িক ভদ্রলোক তিনি। এমন গুনী মানুষের মৃত্যুতে দেশের সংগীত জগতে এক শুন্যতা নেমে আসবে।
তাঁকে নিয়ে চমৎকার এই লেখাটির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ভাই।
রুমন আশরাফ
আজ বহুদিন ব্লগে ঢুকলাম। বিলম্বের জন্য এই অধম ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাই।