
প্রিয় ঝিনুক,
কেমন আছো তুমি?
আমি ভাল নেই। চোখে ঘুম নেই। মুখে হাসি নেই। হাসতেও ভুলে গেছি আমি। তুমি জানো যে, পৃথিবীর আজ কঠিন অসুখ হয়েছে। শরীর কেঁপে কেঁপে জ্বর, আর খুব মাথা ব্যাথা। সেই সাথে নাকি প্রচুর ঠান্ডা আর গলা ব্যাথাও। শ্বাস নিতেও নাকি কষ্ট হচ্ছে প্রচুর। মারাত্মক ছোঁয়াচে এ অসুখটির নাম নাকি নভেল করোনা?
নভেল করোনা প্রথম যেদিন এই পৃথিবীকে আঘাত করেছিল সেদিন নাকি চীন দেশে হাজার হাজার মানুষ মরে ছিল। সেদিন নাকি চীনের উহান শহড় এক মুহুর্তেই মৃত্যুপুরী হয়ে গেছিল। সেদিন ওদের মৃত্যুতে আমি শুধু কষ্টই পেয়েছিলাম। কিন্তু জানো তখনও আমি এ রোগের ভয়াবহতা, নির্মমতা হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি।
মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে দেশ জুড়ে করোনা নিয়ে নানা আতংক, আলোচনা, আর সমালোচনা ছাপিয়ে আজ সেই করোনা আমাদেরই দেশে।
শুনেছি, আমাদের দেশের বড় বড় উর্ধতন ব্যক্তিরা বলেছিল, করোনা নিয়ন্ত্রণে আমাদের দেশ সবরকম ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছে। আমি সত্যিই জানিনা কি সেই ব্যবস্থা। কতটুকু সেই ব্যবস্থা।
শুধু এতটুকুই জানি ‘করোনা’ এখন আমার ঘরের দুয়ারে। মৃত্যুর মিছিলে আমাকে স্বাগত জানাতে আমারই জন্য গভীরভাবে অপেক্ষা করছে।
ভাবতেই গা শিওরে উঠছে।
এখন নাকি মানুষের হাতে হাতে এই করোনা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুযোগ পেলে আমাকেও জাপটে ধরবে। তাই এখন থেকে আর কাউকে ছোঁয়া যাবে না। কারো পাশে বসা যাবে না। সবার সংস্পর্শ থেকে নাকি অনেক অনেক দূরে দূরে থাকতে হবে।
তোমার সাথে আমার প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ হতো। যদিও এই ঝগড়া আমিই শুরু করতাম এবং আমিই তা কন্টিনিউ চালিয়ে যেতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোমার অসীম ধৈর্য্য আর আমার প্রতি তোমার সীমাহীন ভালোবাসার কাছে এই ঝগড়া-বিবাদের ইতি ঘটত। আর আমিও আবার তোমার সেই লক্ষ্মী- সোনা হয়ে যেতাম। সেদিন আমি তোমায় প্রমিজ করেছিলাম আমি বদলে যাব। তোমার যোগ্য হয়ে উঠব। মন দিয়ে পড়াশোনা করব। মানুষের মত মানুষ হবো। আর সেই সাথে প্রচুর কাজ করব। তারপর দুদিন চেষ্টাও করেছিলাম অনেক। তোমার দেয়া কথা রাখতে নিজেকে বদলানোর লড়াইটা মাত্র শুরু করেছিলাম।
অথচ, দেখো কোথা থেকে কি হয়ে গেলো।
কেন এমনটা হলো?
আমাদের তিলে তিলে গড়া স্বপ্ন, সম্পর্ক সব কি তাহলে হঠাৎ আসা এই করোনার কাছে হেড়ে যাবে?
সাজানো বাগান করোনা ঝড়ে ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যাবে?
জানো! আমার এই মনের ক্যানভাসে অনেক স্বপ্ন আঁকা ছিল। তোমার সাথে ট্রেনে করে একবার কলকাতা যাব। সেখানে গিয়ে আমি প্রচুর জামা-কাপর কিনব। যা ইচ্ছে কিনে খাব।
আর তুমি তখন আমার হাসি মুখ দেখে হেসে হেসে বলবে, “আমার পাগলী”
“আমার ময়না”
আর আমি তোমার এসব কথায় পাত্তা না দিয়ে মনোযোগ দিয়ে বিরিয়ানি খাব। আর তুমি আমার খাওয়ার দৃশ্য দেখতে মন দিয়ে।
সেদিন ১৭ই মার্চ জাতির পিতা শেখ মুজিবের জন্মদিনে তুমি আমায় কাচ্চি বিরিয়ানি কিনে দিয়ে ছিলে আর বলে ছিলে, “খাও। আজ তোমার বাপের জন্মদিন”
ফেরার পথে আমি তোমার হাত ছাড়তে চাচ্ছিলাম না। এক রকম জোর করেই সেদিন আমাদের হাত ছেড়ে বিদায় নিতে হয়েছিল।
জানিনা সেদিনই কি আমাদের জীবনের শেষ দেখা ছিল কি না!
জানিনা সেদিনই কি আমাদের শেষ স্পর্শ ছিল কি না!
ঝিনুক বলনা আমায়, সত্যিই কি পৃথিবীর অসুখ একদিন ভাল হয়ে যাবে?
আবার কি কোন এক সুন্দর সকালে আমরা পরষ্পর মিলিত হবো পাহাড়ে কিংবা সমুদ্রে?
আবার কি কখনো পরষ্পর পরষ্পরকে স্পর্শ করব খুব গভীরভাবে?
জানো ঝিনুক! আমার বুক ফেটে এখন শুধু কান্নাই পায়। এখন আর আমি ভাল কিছু ভাবতে পারছি না।
এখন শুধু আমি দিন-রাত কাঁদি। কাঁদতে কাঁদতে আমার কানে শুধু একটা কথাই ভেসে বেড়ায়, আমার জন্যে তোমার গাওয়া সেই গানটি যা তুমি প্রায় প্রায়ই আমাকে গেয়ে শোনাতে —-
আমি সাগর জলে ভেসে আসা একটি ঝিনুক
আমি সাগর জলে ভেসে আসা একটি ঝিনুক
কেন এলাম
বিকিয়ে গেলাম
কোন বিলাসীর পসরা হয়ে
তুমি তো চেনো আমায়
কেউ না জানুক
কেউ না চিনুক ………
বুকে আমার মুক্তো ছিল
বুকে আমার মুক্তো ছিল
আমি তাই নিলাম দরে বিকিয়ে গেলাম অন্য হাতে
পেলাম না ঠাঁই তোমার ঘরে
আমি যে তোমার
শুধু তোমার
অন্য জনে যতই কিনুক
আমি সাগর জলে ভেসে আসা একটি ঝিনুক
আমি সাগর জলে ভেসে আসা একটি ঝিনুক …….
ইতি
তোমার ভালোবাসার মানুষ মুক্তা
২৪ মার্চ, ২০২০, রাত ৩টা ৪৮ মিনিট
করোনা- ডায়েরি-(০১)
১৭টি মন্তব্য
নৃ মাসুদ রানা
বাহ! বেশ ভালো লাগলো।
মুক্তা মৃণালিনী
ধন্যবাদ ভাইয়া। ভালো থেকো।
তৌহিদ
করোনা আমাদের বর্তমানকে যে ভীতিকর অবস্থায় ফেলেছে তার থেকে উত্তরণের জন্য সবারই সচেতনতা জরুরী। ভয়ে আছি এমন দিন যেন দেখতে না হয় যেদিন মনে হবে অনেক কিছুই অতীত স্মৃতি হয়ে গিয়েছে!!
অনেকদিন পরে এলেন কিন্তু। এখন বাসায় থাকুন আর নিয়মিত ব্লগে আসুন। লেখা পড়ে চমৎকৃত হলাম।
মুক্তা মৃণালিনী
ধন্যবাদ তৌহিদ ভাইয়া। করোনা সত্যিই ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে ভাইয়া। আমি একদম মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছি। জানিনা সত্যিই আমাদের সাথে কি ঘটতে চলেছে। নিজে সচেতন আছি। তবে আমরা সম্মিলিতভাবে এখনও সচেতন হইনি। সেই আশংকাতেই আরও ভয় পাচ্ছি।
ফয়জুল মহী
হে দুনিয়ার মালিক তুমি ক্ষমা করো। বাঁচতে দাও সবাইকে তোমার সুন্দর পৃথিবীতে।
মুক্তা মৃণালিনী
সাবধানে থাকবেন ভাইয়া।
সুপায়ন বড়ুয়া
এটাই বাস্তবতা।
হাল ছেড়োনা বন্ধু সবে
হাল ছেড়োনা সবে
করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে এসো
জিততে হবে তবে।
শুভ কামনা।
মুক্তা মৃণালিনী
ধন্যবাদ দাদা। আপনার জন্যেও অনেক অনেক শুভকামনা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
চমৎকার লিখেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো
মুক্তা মৃণালিনী
অনেক অনেক ধন্যবাদ দিদি। আপনিও ভাল থাকবেন, আর সাবধানে নিরাপদে থাকবেন।
জিসান শা ইকরাম
করোনা আমাদের দৈনন্দিন জীবন স্তব্দ করে দিয়েছে,
থমকে গিয়েছে প্রেম ভালোবাসাবাসি।
সুন্দর লিখেছ ছোট আপু।
মুক্তা মৃণালিনী
ধন্যবাদ দাদা।
এস.জেড বাবু
ঝিনুক বলনা আমায়, সত্যিই কি পৃথিবীর অসুখ একদিন ভাল হয়ে যাবে?
আবার কি কোন এক সুন্দর সকালে আমরা পরষ্পর মিলিত হবো পাহাড়ে কিংবা সমুদ্রে?
প্রশ্ন দুটির উত্তর হ্যাঁ হউক।
আবার পৃথীবি ফিরে আসুক সেই সকালের সোনালী সূর্য আর গুধূলির স্বপ্নীল রং নিয়ে- জোনাকিরা আসুক আগের মতো মিটিমিটি আলো নিয়ে।
বিধাতা তেমন করে কবুল করুক পৃথীবির অসহায় মূহুর্তে পরম চাওয়া।
চমৎকার লিখেছেন।
মুক্তা মৃণালিনী
ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার কথাই যেন সত্যি হয় ভাইয়া। পৃথিবী আবার ফিরে আসুক সকালের সোনালী সূর্য আর গোধূলীর স্বপ্নীল রং নিয়ে জোনাকীরা আসুক আগের মত মিটিমিটি আলো নিয়ে। ভাল থাকুন ভাইয়া।
এস.জেড বাবু
আপনিও ভালো থাকবেন আপু। শুভেচ্ছা রইলো।
হালিম নজরুল
গা শিউরে উঠল। অসাধারণ লিখেছো।
মুক্তা মৃণালিনী
অশেষ ধন্যবাদ ভাইয়া।