
এক সময় পাঠ্য বইয়ে পড়েছিলাম কেওকারাডাং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়া। ভ্রমণ সংগঠন “ভ্রমণ বাংলাদেশ”এর সাথে কেওকারাডাং জয় করে মনে হয়েছিল যেন বিশ্ব জয় করা হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই জানা হয়ে গেল যে আমাদের সর্বোচ্চ চুড়া আসলে সাকা হাফং বা ত্লাংময়। তল্যাং ময় বম শব্দ অর্থ সুন্দর পাহাড়। আর সাকা হাফং ত্রিপুরা বা টিপরা অর্থ পুবের পাহাড়। সাকাহাফং এর উচ্চতা প্রায় ৩৪৭৫ ফুট। মিয়ানমার সিমান্ত ঘেষা এই চুড়ায় ২০০৫ সালে সর্বপ্রথম আরোহন করেন ইংরেজ পর্বতারোহী জিং ফুলেন।
তো ফুলেন সাহেবের আবিস্কৃত নতুন পর্বত চুড়া সাকা হাফং বা তলাংময় সামিট করার চিন্তাটা মাথায় ঢুকে গেল। কিছু একটা মাথায় ঢুকলে কোন না কোন ভাবে আমার সেই আশা অবশ্যই পূরণ হয়ে যায়। ভ্রমণ বাংলাদেশের আমরা আট জন রওয়ানা দিয়েছিলাম সাকা হাফং এর উদ্দেশ্যে, বান্দরবান যাওয়ার পর অন্য একটা চার জনের টিম আমাদের সাথে যোগ দেওয়ায় আমরা হয়ে যাই বার জনের টিম। আর ঐ টিমের মাঝে কখনো পাহাড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নাই এমন পাবলিকও ছিলো। যার কারণে আমাদের ব্যাপক ভোগান্তি হয়েছিল।
আমাদের রুট ছিল রুমা – বগালেক – দার্জিলিং পাড়া – কেওকারাডাং – পাসিংপাড়া – বাকলাইপাড়া – সিম্পত্লাম্পি পাড়া – থানদুই পাড়া – নয়াচরন পাড়া – হানজরাইপাড়া – নেফিউপাড়া। দীর্ঘ এই পথের শেষ গ্রাম নেফিউ পাড়াটাকে বলা যায় সাকাহাফং এর বেসক্যাম্প। এই নেফিউপাড়া থেকে বিপদ জনক বাঁশের ট্রেইল ধরে চূড়ায় উঠতে হয়। বাঁশের জঙ্গল পাড় করলেই সাকা হাফং এর চুড়া। চুড়ায় পৌছার পর সকলের শরীর দিয়ে ঘাম গড়িয়ে নামছে,জোঁকের কামড়ে রক্ত ঝড়ছে অনেকের পা থেকে। শরীর ভেঙ্গে যেতে চাইছে, কিন্তু প্রত্যেকেরই মুখে অমলিন হাসি আর অবয়বে তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট। আর এই তৃপ্তির ও যথেষ্ট কারণ হলো আমাদের ১২ জনের টিমের কেউই আগে বাংলাদেশের ছাদে উঠিনি।
আমি ভালো লেখক নই, মূলত ছবি দিয়েই পোষ্ট শেষ করতে আমি ভালোবাসি। কিন্তু এতো কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার সময় ছবি তোলার সুযোগ থাকে খুবই কম। যাদের পাহাড় ট্রাক করার অভিজ্ঞতা আছে তারা ভালোই জানেন, একপাশটা আকাশ ছোয়া পাহাড়ের দেয়াল আর অন্য পাশটা হাজার ফুট নেমে যাওয়া মৃত্যুখাদ, সেই সাথে পাহাড় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠা ঝুরঝুরে কিংবা পিচ্ছিল মাটিতে যেখানে পা রেখে চলাই দায় সেখানে ক্যামেরা হাতে নেওয়ার সুযোগ কোথায়? তবু যেটুকু ছবি তুলেছি তা দিয়েই আজকের পোষ্ট সাজানোর চেষ্টা করলাম।
(২) আগে কাইক্ষাং ঝিরি থেকে রুমা বাজার পর্যন্ত সাঙ্গু নদীর উজানে ট্রলারে যাইতে হতো, কিছুদিন আগে নতুন ব্রীজ উদ্বোধন হওয়াতে রুমা বাজারে হইতে তিন কিলোমিটার দুর পর্যন্ত চান্দের গাড়িতেই যাওয়া যায়। কিন্তু কিছু রাস্তায় এখনো এমনভাবেই চলে চান্দের গাড়ি।
(৩) পথের ক্লান্তি দূর করার জন্য ঝিরি থেকে বাঁসের গ্লাস দিয়ে পানি খাওয়ার সময় আপনি সত্যিই রোমাঞ্চিত হবেন। পাহাড়িরা পানি খাওয়ার পর এখানেই এটা রেখে যায় অন্য কেউ যাতে পানি খেতে পারে।
(৪) বগালেক আর কেওকারাডাং এর মাঝের গ্রাম দার্জিলিং পাড়া এটা।
(৫) সাকা হাফং এর পথে কেওকারাডাং চুড়া। ওখানে ওঠে কিছু ক্লিকবাজী না করলে কি হয়? তবে এবারের কেওকারাডাং চুড়া ছিলো অন্য রকম সাজে, কারণ কয়েকদিন আগে মাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওখানে গিয়েছিলেন।
(৬) মেঘের উপর বাড়ি নিয়া আমার একটা পোষ্ট আছে। এটা সেই পাসিংপাড়ার ছবি।
(৭) পাসিং পাড়া থেকে নিচের দিকে নেমে জাদিপাই পাড়ার পাশ কেটে এগিয়ে চললাম বাকলাই পাড়ার দিকে। বাকলাই পাড়া যাওয়ার আগে কিছুটা রাস্তা এমন সাবলীল।
(৮) এমন কিছু ফুল প্রজাপতি দেখলে ক্লান্তি কিছুটা হলেও কমে।
(৯) কোন কোন সময় খুবই পানি সংকট দেখা দেয়, তখন কার্নিস বেয়ে এমন ফোটা ফোটা পানিও হয়ে উঠে ট্র্যাকারদের জন্য আশির্বাদ স্বরুপ।
(১০) সাকা হাফং এর পথে আমাদের এক রাত্রির আবাস বাকলাই পাড়া।
(১১/১২) পথমধ্যে আমাদের জন্য শুভ কামনার ডালা নিয়ে অপেক্ষারত নীল আকাশ আর বুনো ফুলেরা।
(১৩) একটা নিঃসঙ্গ জুমঘর।
(১৪) কুয়াশা মাখা ভোরেই আদিবাসিরা বেড়িয়ে পড়ে নিজ নিজ কাজে।
(১৪) আমাদের গন্তব্য তো পুবের পাহাড় বা সাকাহাফং
(১৬) এটা সিম্পত্লাম্পি পাড়া, পেছনের চুড়াটাই তাজিংডং যা বাংলাদেশের বই পত্রে এখনো সর্বোচ্চ চুড়া হিসাবে ভুল ভাবে পড়ানো হচ্ছে। আসলে এটা বাংলাদেশের ১৮/১৯ তম পর্বত চুড়া।
(১৭) কিছু যায়গায় এমন পিচ্ছিল পাথর ভরা ঝিরি পথে যেতে যায় যা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
(১৮) পথ ভুল করে ঘন্টাখানেকের পথ এগিয়ে গিয়েছিলাম, পরে সেখানেই এমন চমৎকার একটা জলধারা পেয়ে ভুলের ক্লান্তি দূর করতে ঝাপিয়ে পড়ি সবাই।
(১৯) সংশোধিত পথে ফিরে চলা……..
(২০) এটাই সেই নেফিউপাড়া। যা সাকাহাফং এর পাদদেশে অবস্থিত সর্বশেষ গ্রাম।
(২১) যতোগুলি গ্রাম পাড়ি দিয়েছি এটাকেই সব থেকে আদিম গ্রাম মনে হয়েছে আমাদের কাছে। একজন মহিলা কাঁচা বাঁশের ভেতর কিছু একটা রান্না করছে। এই গ্রামে ছিলো আমাদের এক রাত্রির আবাস। দুইজন বয়স্ক লোক ছাড়া কেউই আমাদের কথা বুঝেনা, আমরা ওদের কথা বুঝিনা, সত্যিই বেশ জটিল ছিল বিষয়টা।
(২২) পরের দিন খুব ভোরে রওয়ানা দিয়ে বেলা ১২টার মধ্যেই আমরা পৌছে যাই সাকা হাফং চুড়ায়। যার আশেপাশে সভ্যতার কোন চিহ্নই নাই।
(২৩) আমাদের জিপিএস রিডিং বলছে এই চুড়ার উচ্চতা ১০৫৩ মিটার বা ৩৪৫৪ ফিট।
(২৪) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্থানে দাঁড়িয়ে তোলা মায়ানমারের আকাশের মেঘের নদী।
(২৫) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্থানে পৌছার পরও বুঝি আমাদের মন ভরেনি, তাই তো সকল বন্ধুরা মিলে আকাশ ছোয়ার প্রচেষ্টা….
২৩টি মন্তব্য
তৌহিদ
কেওকারাডাং সম্পর্কে জানতাম কিন্তু সাকা হাফং যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া তা জানলাম আপনার লেখার মাধ্যমে। সবগুলো ছবি কিন্তু অসাধারণ লাগছে।
ধন্যবাদ এমন পোষ্ট এর জন্য ভাই।
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ তৌহিদ ভাই, আজো সরকারি ভাবে এর স্বিকৃতি মিলে নাই। সরকার এখনো বলে তাজিংডং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া। অথচ ওটা ১৮ বা ১৯ তম চূড়া। কেওকারাডাং আছে এখন ৫ম স্থানে।
তৌহিদ
তথ্য জানানোর জন্য ধন্যবাদ ভাই।
কামাল উদ্দিন
আপনাকেও ধন্যবাদ ভাই
সুপায়ন বড়ুয়া
আপনার ভ্রমন কাহিনীর মাধ্যমে
অনেক কিছু জানা যায়
ধন্যবাদ শুভ কামনা।
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ দাদা, ঘুরে ফিরে পুরো পৃথিবী দেখার ইচ্ছে আমার। কিন্তু জানি সেটা কখনো সম্ভব নয়……..শুভ সকাল।
নৃ মাসুদ রানা
আপনার কাছে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে…
কামাল উদ্দিন
আপনার সাথে ঘুরতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবো মাসুদ ভাই……..শুভ কামনা জানবেন।
ইকবাল কবীর
পাহাড় ভ্রমন বরাবরের মতই আমাকে আকর্ষন করে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে “জোক”। মানে জোকের একটু ভিতি আছে আমার। আর সব ঠিক আছে।
কামাল উদ্দিন
পাহাড়ে গেলে জোঁক হলো একটা কমন জিনিস, এটাকে ভয় পেলে কি আর চলবে ভাই?
ছাইরাছ হেলাল
ছাদে ওঠা কেউ আমাদের মাঝে আছে ভাবতে ভাল লাগছে।
আচ্ছা জোঁকের জন্য নানান কিছু প্রতিরোধক থাকে, কেরোসিন/ তামাক পাতার গুড়া…………
তারপর ও কেন এই আক্রমন! আমার খুব জোঁকের ভয়।
কামাল উদ্দিন
আমি সাধারণত দেখেছি ছোট ট্যুরগুলোতে অনেকে গুল বা লবনও নিয়ে যায়। এগুলো আসলে কোন জোঁক প্রতিরোধক নয়। জোঁকে ধরার পর তাকে মারার জন্য ব্যবহৃত হয়। এসব হাতে পায়ে মেখে নিলেও পাহাড়ে চলার সময় তা আর থাকে না। এক সময় জোঁককে খুবই ভয় পেতাম এখন আর অতোটা ভয় লাগে ন…………..শুভেচ্ছা জানবেন ভাই।
ফয়জুল মহী
জানার কোন শেষ নাই, শিক্ষার কোন বয়স নাই।l
কামাল উদ্দিন
হুমম, কথা সত্য মহী ভাই।
জিসান শা ইকরাম
সাকা হাফং সম্পর্কে কিছুই জানতাম না,
বিস্তারিত জানানোর জন্য ধন্যবাদ।
চাঁদের গাড়িচলাচলের যে রাস্তার অংশ দেখালেন, তা দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছি 🙂
ভ্রমন+ ছবি ব্লগ ভালো হয়েছে,
শুভ কামনা।
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ ইকরাম ভাই, ভালো থাকুন সব সময়।
পর্তুলিকা
ছবি গুলা অনেক সুন্দর। কোন জায়গার ছবি এগুলা?
কামাল উদ্দিন
সবগুলোই বান্দরবানের ছবি ভাপু (ভাই্আপু)
পর্তুলিকা
আমাকে পুর্তলিকা ডাকলেই বেশি খুশি হবো বন্ধু।
কামাল উদ্দিন
কিন্তু মনের মাঝে খচখচানি তো থেকেই যাবে
পর্তুলিকা
খচখচানি কেন থাকবে বন্ধু? ফুলের নামে নাম রেখেছি। আমি কি বালক হইতে পারি বলুন?
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ আপু, ভালো থাকুন সব সময়।
সুরাইয়া পারভীন
কেওকারাডাং সম্পর্কে জানতাম কিন্তু সাকা হাফং যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া তা জানলাম আপনার লেখার মাধ্যমে। সবগুলো ছবি কিন্তু অসাধারণ লাগছে।
লাস্ট ছবি দারুণ আর সব গুলো ছবিই সুন্দর।