যাপিত জীবন।

রিতু জাহান ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ০৯:৫৮:২৮পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৬ মন্তব্য

জীবন পরিক্রমায় এখন বয়সের শেষ প্রান্তে চলে এসছি। একমগ কফি হাতে বসে ভাবছি অনেক স্মৃতি। আসলে ভাবছি না, স্মৃতিগুলো ভেসে ভেসে উঠছে। প্রতিটা মানুষেরই শৈশব খুব প্রিয় হয়। আমারও শৈশব খুব আনন্দময় ছিল। বাবার চাকরিসূত্রে গ্রামের বাড়ি থেকে অল্প দূরত্বে হসপিটালের কোয়ার্টারেই থাকা হতো। কিন্তু বেশিরভাগ সময় আমি নানবাড়িতেই থাকতাম। দাদার বাড়িতেও থাকতাম, কিন্তু তা একেবারেই কম। দাদারবাড়ি একটু কড়াকড়ি ছিল। মেয়েদের প্রচন্ড শাষণের ভিতরেই থাকতে হতো। কিন্তু আমাকে শাষনে বেঁধে রাখে কার সাধ্যি! আমাদের ঐ বাড়িতে পুকুরও ছিল ভাগ করা। মসজিদের পুকুরে ভুল করেও কোনো মেয়ে নামতে পারবে না। কিন্তু আমি ঠিকই নেমে পড়তাম। ছিঁড়া দাদা লাঠি হাতে পুকুর পাড়ে চিল্লাতে থাকতো। তবে, সত্যি আমাকে মারেনি কখনো কেউ। আব্বাা ছিল সবার ছোট। তাই আদরটা ওখান থেকেই বরাদ্দ থাকতো। আব্বাকে মনি বলেই ডাকতো সবাই। আব্বা মেয়েদের শাষনের ব্যাপারে উদার ছিল। সে কখনো কোনোকিছু চাপিয়ে দিত না। ঘোর বিরোধী ছিল এসব আজাইরা নিয়মে। তবে মা ছিল প্রচন্ড কড়া। সে চাইতো আমিও অন্যান্য বোনদের মতো ভদ্র হই😝 মানে নরম সরম মেয়েদের মতো আচরন করি। আমি আর মেয়েলি আচরন! অসম্ভব ছিল তা আমার জন্য। আর বড় ভাইবোনদের আল্লাদে আরো বেশি ছিল দুষ্টমির পরিমান। কারণ ও বাড়ির সব বড় ভাইবোনদের দশ বারো বছরের ছোট ছিলাম আমি। দাদারা তখন খুলনায় পড়াশুনা করে। ও বাড়িতে বেশি আদর করতো বেনজিরদা এবং তার মা মানে আমার ফুফু।
এমন কোনো গাছ ছিল না যে আমি উঠিনি। এমন কোনো পুকুর নেই যে আমি নামিনি। তবে শুধু বড় পুকুরে কখনোই নামিনি। লোক কথামতে ও পুকুরে ছিল বিশাল বড় এক গজাল মাছ। গ্রামের মানুষের কাছে ওটা নাকি একটা ধান ভানা ঢেঁকির সমান। আমার সব সময় সব বিষয়ে খুব কৌতুহল কাজ করতো। কতোদিন যে পুকুর পাড়ে বসে থেকেছি ওটাকে দেখার জন্য তার ইয়ত্বা নেই। কিন্তু সে গজালের দেখা আর পাইনি।
ওটাকে নিয়ে আছে এখনো নানান ভৌতিক কাহিনী।
আমদের একটা ভিটা ছিল, ফকির ভিটা নামে। এই ফকির ভিটায় নাকি, স্বয়ং আমার বাবাই ভুত দেখেছে!র নদীর পাড়ে গাবগাছটা নিয়ে যে কতো ভৌতিক কাহিনী জড়িত তার লেজমাথা নেই। অথচ আমি যে কতো ও গাছে উঠেছি তার শেষ নেই। ভুত আমার কাছে কখনো আসেনি। মজার ব্যাপার অনেকবারই গাছ থেকে পড়েছি, একবারও হাতপা ভাঙেনি। তবে কেটেছে কতো যায়গা তা আর হিসেব করে শেষ হবে না।
আমি ডান্ডাগুলি খেলতাম খুব ভাল। মাটিতে গর্তখুঁড়ে খেজুর দিয়ে কি যেন খেলতাম এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। আমি বেশিরভাগ বাসায় থাকলে কি হবে, গ্রামের বাড়ির কেউ আমার সাথে খেলায় পারতো না। মনে আছে, আমার চাচাতো ভাই আমার দুই তিনমাসের ছোট, ও কখনোই জিততো না। কি যেন খেলায় ও ওর সব মারবেল হেরে যেতো আমার কাছে। তাই একবার হেরে গিয়ে শক্ত এক মাটির ঢেলা ছুঁড়ে দিয়েছিল আমার মাথায়। ব্যাস, চিৎপটাং আমি। জ্ঞান ছিল না অনেকক্ষণ। চাচিই মাথায় পানি দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলো। জ্ঞান ফিরে আগে ওকে মেরেছিলাম চাচির সামনেই। ওর মুখে খামচির দাগটা মনে হয় এখনো আছে। আমার দাদাকে আমরা কোনো ভাইবোনই দেখিনি। আব্বা যখন ক্লাস এইটে তখন তিনি মারা যান। দাদীর মুখটা মনে আছে খুব কম। প্রচন্ড সুন্দরী ছিলেন তিনি। আমি শুধু বলতাম, তোমার গায়ের রংটা আমায় দাও।” হাসতো দাদী। শর্ত দিত, তাঁর হাত ধরে তাঁর ভাইর বাড়ি নিয়ে গেলে রংটা দিবে। আমি হাত ধরে সাবধানে নিয়ে যেতাম। আমি দাদীর অনেক কাজ করে দিলেও দাদী আমার ছোটটা মুক্তাকে খুব ভালবাসতো। নুমির মা বলতো ওকে। মুক্তা দাদীর পান ছিঁচে দিত হামান দিস্তায় খুব যত্ন করে। আর আমাদের মুন্সিবাড়ির সব খবরে ও ছিল বিবিসি। পুটপুট করে দাদীর সাথে সব গল্প করতো। দাদী মারা যাবার পর আর দাদাবাড়ি তেমন যাওয়া হয় নাই। দাদীর কবর দেখতেই শুধু কয়েকবার যাওয়া হইছে।
ছোটবেলায় আমার সব থেকে মজা হতো নানাবাড়ি ও ফকিরহাট আমার ফুফু বাড়িতে। নানা তো ডাকতো সাদাঘোড়া বলে। গেট দিয়ে ঢুকলেই বলে উঠতো,”আমার সাদা ঘোড়া এসে গেছে।” খুব সৌখিন এক সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন তিনি। বংশপরম্পরায় ধর্মীয় রীতিনীতি মানার পাশাপাশি অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলিতেও লোকজন নিয়ে আনন্দে মেতে থাকতেন। নৌকাবাইচ, ঘোড়দৌড় এর ব্যবস্থা করতেন প্রতিবছর। পরবাশি ধান কাটা শ্রমিকদের বিদায় বেলাতে রাতে পালাগান, পিঠাপায়েসের ব্যবস্থা করতেন।
আমার নামটা রেখেছিলেন তিনিই। সে বলতো তার পৃথিবীর সম্রাজ্ঞী নাকি আমি। নানা মারা গেলে মোংলা থেকে কাফনের কাপড়টা আমিই বয়ে নিয়ে গেছিলাম। যখন গেট দিয়ে ঢুকি, শুনতে পোলাম নানা যেন বলে উঠলো,”সাদা ঘোড়া।” সোজা গেলাম খাল পাড়ে। যেখানে নানাকে গোসল করানোর জন্য নিয়ে গেছে। পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। মনে হচ্ছিল খেজুর কাটা এনে পায়ে গুতা দেই এখুনি উহ করে উঠবে। চোখ বন্ধ করে বসে থাকতো আমার সামনে। বুগো বলতো আমায় যখন তার কোনো আবদার থাকতো। ছোটবেলায় সবখানে নিয়ে যেতো আমায়। কতো যে হাঁট করতে গেছি নানার সাথে।
নানার মৃত্যুটা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল ভিতর থেকে। অনেক বেশি শান্ত হয়ে যাই সেখান থেকে। কথাও কম বলতাম সবার সাথে।
আমার বিয়ে হলো পরের বছরই। বিয়ের পরে নিজেকেই যেন আমি চিনি না। কতো যে খুঁজতাম নিজেকে! বাড়ির বড় বউ হিসেবে দায়িত্বের চাপে চাপা পড়ে রইলাম যেন। আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। এই জীবনটা যেন একেবারেই অচেনা এক জীবন আমার কাছে। বড় বেশি শাষণ, বড় বেশি নিয়ম। যা আমার চরিত্রের একেবারেই বাইরে। তুমুল ভাবে প্রান নিয়ে বাঁচার সেই দিনই যেন খাঁচায় আটকা রইলো। এতোগুলো মানুষের মাঝে কোথা থেকে দিনের শুরু ও শেষ হতো বুঝতেই পারতাম না। তবু দিন তার নিয়ম মতোই চলে। আমিও চলেছি।
আজ এতো বছর জীবন পার করে আসার পরে মনে হয় সবকিছু বড় যান্ত্রিক। এ জীবনে এসে দেখছি শুধু স্বার্থের ভাগ। সম্পর্কগুলোর ভিতরে টাকা সম্পত্তির গন্ধ। বারে বারে শব্দ দূষণ।প্রতিটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই বৈশিষ্ট অনুযায়ী তার সাথে ব্যবহার করা উচিৎ। এতে করে অন্তত সম্পর্কটা ভাল থাকে। সন্মানটা দু’পক্ষকেই সমানভাবে দেখানো উচিৎ। সব সম্পর্কের একটা মান থাকে। প্রতিটা সম্পর্কের ক্ষেত্রও আলাদা, ভালবাসাও আলাদা। কারো সাথেই কারো ভালবাসা মেলে না। কারো সামনেই কাউকে ছোট করে দেখানো উচিৎ না। এতে অভিমান বাড়ে আর এই অভিমান ধিরে ধিরে পাথরের মতো ভারি হয়ে যায়। প্রথমে তা যদিও বরফের মতো থাকে একটু স্নেহ মায়া মমতার স্পর্শেই তা গলতে শুরু করে।
ভাল থাকুক সবাই।

৫০৬জন ৫০৬জন
0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ