ইসলামিয়া কলেজের কাছেই সুরেন ব্যানার্জি রোড, তারপরেই ধর্মতলা ও ওয়েলিংটন স্কয়ারের জংশন। এখানে সকলেই প্রায় হিন্দু বাসিন্দা। আমাদের কাছে খবর এল, ওয়েলিংটন স্কয়ারের মসজিদে আক্রমণ হয়েছে। ইসলামিয়া কলেজের দিকে হিন্দুরা এগিয়ে আসছে। কয়েকজন ছাত্রকে ছাত্রীদের কাছে রেখে, আমরা চল্লিশ পঞ্চাশজন প্রায় খালি হাতেই ধর্মতলার মোড় পর্যন্ত গেলাম। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা কাকে বলে এ ধারণাও আমার ভাল ছিল না। দেখি শত শত হিন্দু সম্প্রদায়ের লওওকে মসজিদ আক্রমণ করছে। মৌলভী সাহেব পালিয়ে আসছেন আমাদের দিকে। তাঁর পিছে ছুটে আসছে একদল লোক লাঠি ও তলোয়ার হাতে। পাশেই মুসলমানদের একটা দোকান ছিল। কয়েকজন লোক কিছু লাঠি নিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়াল। আমাদের মধ্য থেকে কয়েকজন ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ দিতে শুরু করল। দেখতে দেখতে অনেক লোক জমা হয়ে গেল। হিন্দুরা আমাদের সামনা সামনি এসে পড়েছে। বাধা দেওয়া ছাড়া উপায় নাই। ইট পাটকেল যে যা পেল তাই নিয়ে আক্রমণের মোকাবেলা করে গেল। আমরা সব মিলে দেড়শত লোকের বেশি হব না। কে যেন পিছন থেকে এসে আত্মরক্ষার জন্য আমাদের কয়েকখানা লাঠি দিল। এর পূর্বে শুধু ইট দিয়ে মারামারি চলছিল। এর মধ্যে একটা বিরাট শোভাযাত্রা এসে পৌঁছাল। এদের কয়েক জায়গায় বাধা দিয়েছে, রুখতে পারে নাই। তাদের সকলের হাতেই লাঠি। এরা এসে আমাদের সাথে যোগদান করল। কয়েক মিনিটের মধ্যে হিন্দুরা ফিরে গেল, আমরাও ফিরে এলাম। পুলিশ কয়েকবার এসে এর মধ্যে কাঁদানে গ্যাস ছেড়ে চলে গেছে। পুলিশ টহল দিচ্ছে। এখন সমস্ত কলকাতায় হাতাহাতি মারামারি চলছে। মুসলমানরা মোটেই দাঙ্গার জন্য প্রস্তত ছিল না, একথা আমি বলতে পারি।
আমরা রওয়ানা করলাম গড়ের মাঠের দিকে। এমনিই আমাদের দেরি হয়ে গেছে। লাখ লাখ লোক সভায় উপস্থিত। কালীঘাট, ভবানীপুর, হ্যারিসন রোড, বড়বাজার সকল জায়গায় শোভাযাত্রার উপর আক্রমণ হয়েছে। শহীদ সাহেব বক্তৃতা করলেন এবং তাড়াতাড়ি সকলকে বাড়ি ফিরে যেতে হুকুম দিলেন। কিন্তু যাদের বাড়ি বা মহল্লা হিন্দু এরিয়ার মধ্যে তারা কথায় যাবে? মুসলিম লীগ অফিস লোকে লোকারণ্য। কলকাতা সিটি মুসলিম লীগ অফিসেরও একই অবস্থা। বহু লোক জাকারিয়া স্ট্রীটে চলে গেল। ওয়েলেসলী, পার্ক সার্কাস, বেনিয়া পুকুর এরিয়া মুসলমানদের এরিয়া বলা চলে। বহু জখম হওয়া লোক এসেছে; তাদের পাঠাতে হয়েছে মেডিকেল কলেজ, ক্যাম্বেল ও ইসলামিক হসপিটালে। মিনিটে মিনিটে ফোন আসছে, শুধু একই কথা, ‘আমাদের বাঁচাও, আমরা আটকা পড়ে আছি। রাতেই আমরা ছেলেমেয়ে নিয়ে শেষ হয়ে যাব।’ কয়েকজন ফোনের কাছে বসে আছে, শুধু টেলিফোন নম্বর ও ঠিকানা লিখে রাখবার জন্য।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং-৬৪-৬৫)
৭টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
সাম্প্রদায়ীক দাংগার বীজ ভারত ভাগের সময়ই প্রবল ভাবে আমাদের মাঝে বপিত হয়েছে। এ থেকে আমরা কবে যে মুক্তি পাব জানিনা।
আপনি এই পোস্ট দিচ্ছেন না, মনে হচ্ছে কি যেন অভাব বোধ করছিলাম।
শুভ কামনা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ ৫০তম পর্ব প্রকাশ শেষ হয়েছে। বছরে ৫০টি পর্বই সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছি, তাই সাময়িক বিরতি।
ধন্যবাদ।
শুন্য শুন্যালয়
অনিয়মিত হবার কারণে অনেক পর্ব বাদ পড়ে গেছে। ভেবেছিলাম হয়তো একটা না পড়লে আরেকটা বুঝতে পারবোনা। তবে পর্ব টা আলাদাই ছিলো।
জানিনা ধর্ম সত্যিই শান্তির জন্য কিনা, যদি তাই হয় তাহলে বুঝতে হবে আদোতে ধার্মিক লোক হাতে গোনা কএকজন।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
যৌক্তিক একটা পয়েন্ট আউট করেছেন, যদি শান্তির ধর্মের নাম ইসলাম হয় তবে হাতে গুনা কয়েকজনই ধার্মিক। খুব খারাপ লাগে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি দেখলে।
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রকৃত ধর্মকে খুঁজে পেলাম না, কিন্তু ভন্ড ধার্মিকে ভরে আছে বাজার।
ধন্যবাদ রুবা’পু আবার শুরু করার জন্য।
নতূন বছরের শুভেচ্ছা। ভালো থেকো। -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
শুভেচ্ছা তোমাকেও। বকধার্মিকে বাজার সয়লাব।
নীলাঞ্জনা নীলা
🙂 -{@