আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ছিল। বাতাসে হাত-পা অবশ হতে চলেছে। আর কিছু সময় চললে আর উপায় নাই।কিছুক্ষণ পরেই ট্রেন থেমে গেল। আমরা নেমে পড়লাম। ‘আনোয়ার’ ‘ আনোয়ার’ বলে ডাকতে শুরু করলাম। মধ্যম শ্রেনীতে আনোয়ার ছিল, ওর কাছেই আমার বিছানা। আমাদের জন্য আনোয়ার খুব উদ্বিগ্ন ছিল। জানালা দিয়ে কোনক্রমে ট্রেনের ভিতরে উঠলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। পরের দিন সন্ধ্যায় আমরা হাওড়া স্টেশনে পৌঁছালাম। সকলের সকল কিছুই আছে, আমার সুটকেসটা হারিয়ে গেছে। শুধু বিছানাটা নিয়ে কলকাতা ফিরে এলাম।
এরপর ভাবলাম কিছুদিন লেখাপড়া করব। মাহিনা বাকি পড়েছিল, টাকা পয়সার অভাবে। এত টাকা বাড়ি না গেলে আব্বার কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। এক বৎসর মাহিনা দেই নাই। কাপড় জামাও নতুন বানাতে হবে। প্রায় সকল কাপড়ই চুরি হয়ে গেছে। বাড়িতে এসে রেণুর কাছে আমার অবস্থা প্রথমে জানালাম। দিল্লি ও আগ্রা থেকে রেণুকে চিঠিও দিয়েছিলাম। আব্বাকে বলতেই হবে। আব্বাকে বললে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন মনে হল। কিছুই বললেন না। পরে বলেছিলেন, “বিদেশ যখন যাও বেশি কাপড় নেওয়া উচিত নয় এবং সাবধানে থাকতে হয়।” টাকা দিয়ে আব্বা বললেন, “কোনো কিছুই শুনতে চাই না। বিএ পাশ ভালভাবে করতে হবে। অনেক সময় নষ্ট করেছ, ‘পাকিস্তান আন্দোলন’ বলে কিছুই বলি নাই। এখন কিছুদিন লেখাপড়া কর।” আব্বা, মা, ভাইবোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুজল’ বোধহয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, “একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এস।”
কলকাতা এসে মাহিনা পরিশোধ করে যে বইপত্রগুলি বন্ধুবান্ধবরা পড়তে নিয়েছিল, তার কিছু কিছু চেয়ে নিলাম। কলেজে যখন ক্লাস করতে যেতাম প্রফেসর সাহেবরা জানতেন, আর দু’একজন বলতেনও, “কি সময় পেয়েছ কলেজে আসতে।” আমি কোনো উত্তর না দিয়ে নিজেই হাসতাম, সহপাঠীরাও হাসত। পড়তে চাইলেই কি আর পড়ালেখা করা যায়! ক্যাবিনেট মিশন তখন ভারতবরষে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তাদের দাবি নিয়ে আলোচনা করছে ক্যাবিনেট মিশনের সাথে। আমরাও পাকিস্তান না মানলে, কোনোকিছু মানব না। মুসলিম লীগ ও মিল্লাত অফিসে রোজ চায়ের কাপে ঝড় উঠত। মাঝে মাঝে মিটিং হয়, বক্তৃতাও করি। এই সময় ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ গ্রহণ করবে। তাতে দেশ রক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে এবং বাকি সব বিষয়ই প্রদেশের হাতে দেওয়া হয়েছিল। পরে কংগ্রেস চুক্তি ভঙ্গ করে, যার ফলে ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান পরিত্যক্ত হয়। এমনভাবে ক্যাবিনেট মিশন আলোচনা করছিল, আমাদের মনে হচ্ছিল ইংরেজ সরকার কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা দিয়ে চলে যেতে পারলে বাঁচে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস ও ব্রিটিশ সরকারকে ভালভাবে জানতেন ও বুঝতেন, তাই তাকে ফাঁকি দেওয়া সোজা ছিল না।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং-৬১)
★ পর্ব-৫০ প্রকাশের পর ধারাবাহিক প্রকাশ কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকবে।
১৩টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
রুবা’পু ও মা কেন বন্ধ থাকবে? মন খারাপ করিয়ে দিলে। 🙁
মারজানা ফেরদৌস রুবা
নীলাদি, কিছুদিনের জন্য গো।
ইচ্ছা তো আছে কন্টিনিউ করে যাওয়ার। কষ্ট করে টাইপ করা একটা ব্যাপার কিন্তু লোকে যদি নাই পড়ে তো কষ্ট করেই বা কি! এখানে বুঝাও যায় না ব্লগের বাইরে পাঠক কেমন।
দেখা যাক।
নীলাঞ্জনা নীলা
রুবা’পু তুমি বিশ্বাস করবে না আমি মন দিয়ে অপেক্ষা করি তোমার এই পোষ্টের।
তবে আসলেই খারাপ লাগে যখন কোনো একটি পোষ্ট দেয়ার পর সেটা সঠিক মাত্রায় যত্ন না পায়। তখন মনে হয় আমি ভালো লিখিনি। আপু এমন অবস্থা আমারও যায়, বেশ কিছু মানুষ আছে যারা সত্যিকারের সত্যিটা বলে, তখন বুঝি যে ভালো লিখেছি। তাই তুমি পোষ্টটা থামিও না। আমি সত্যিই অপেক্ষায় থাকি। -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
না গো দি, একেবারে থামানোর ইচ্ছা এখনো নেই। তবে এটা তো আমার নিজের লেখা নয় যে প্রশংসা করতেই হবে। কেবল এটুকু যদি জানতে পারতাম যে তোমার মতো কতোজন রেগুলার পাঠক আছে এই আত্মজীবনীর। মাঝে তো ব্লগে একটা লেখা কতোজন পড়লো সেটা দেখা যেতো, এখন সে সুযোগ নেই। পাঠকই যদি না থাকে তো কেনো অযথা কষ্ট করবো বলো? টাইপই তো করছি, নিজের মেধা তো এখানে কিছুই নেই। টাইপ করছি কেনো? মানুষের কাছে সহজভাবে পৌছে দেয়ার জন্যই তো?
মোঃ মজিবর রহমান
“কি সময় পেয়েছ কলেজে আসতে”ভাল লাগ্ল আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যা, রাজনীতির নেশা বঙ্গবন্ধুকে আচ্ছন্ন করে রাখতো।
মোঃ মজিবর রহমান
সেই কারণেই ষে হয়েছে অবিসংবাদিত রাজনৈতিক নেতা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
(y)
অলিভার
পিতা, সে যারই হোক না কেন, সে একজন ‘পিতা’। বঙ্গবন্ধুর বেলাতেও সেই পিতা চরিত্রের কোন পরিবর্তন নেই, গুরুগম্ভীর ভাব আর দায়িত্বপরায়ন নির্দেশনা তার মাঝেও দেখা মেলে। আর বোধ করি যুগে যুগে শিক্ষকেরাও এমনই থাকবে, বিরতির পর ছাত্র পড়া লেখায় ফিরে আসলে তাদেরও যেন একটা টিপ্পনি না কাটলেই না!
মাঝে মাঝে সংক্ষিপ্ত বিরতি কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী রূপ লাভ করে। তাই বলছি, থামিয়ে না দিয়ে বরং লিখলতে থাকুন। প্রয়োজনে সময় নিয়ে নিয়ে লেখুন অথবা নির্দিষ্ট বিরতির পরপর। তারপরও নিয়মিত লিখে যান 🙂
মারজানা ফেরদৌস রুবা
দোয়া করবেন, সে ইচ্ছাই এখন পর্যন্ত আছে।
অলিভার
-{@ -{@
অয়োময় অবান্তর
আপনার কষ্ট করে লেখা সার্থক হোক। পিতা সম্পর্কে জানার রইল বাকী।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ।