শেষ পর্যন্ত আমিও হাশিম সাহেবকে বলেছিলাম, সালাম সাহেবকে নমিনেশন দিতে। সেজন্যে আমার উপর রাগ করেছিলেন তিনি। শহীদ সাহেব রিপোর্ট দিলেন, সালাম সাহেবই সকলের চেয়ে জনপ্রিয়। তিনি সালাম সাহেবকে নমিনেশন দিতে প্রস্তাব করেছিলেন। লাল মিয়া ও হাশিম সাহেব বেঁকে বসলেন। এই সময় কিছু টাকা পয়সার ছড়াছড়ি হচ্ছিল। আমি খবর পেতাম, যদিও চোখে দেখি নাই। শেষ পর্যন্ত খান বাহাদুর সামসুদ্দোহা সাহেবকে নমিনেশন দিল প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি বোর্ড। কেন্দ্রীয় বোর্ড খান বাহাদুর সাহেবকে কেটে দিয়ে খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদকে নমিনেশন দিল। সালাম সাহেব ইলেকশন করলে বোধহয় নির্বাচিত হতে পারতেন, কিন্তু মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করলেন না। কারণ পাকিস্তানের উপর ভোট। খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদও নমিনেশন পেতে পারেন না, কারণ মাত্র কয়েক মাস পূর্বে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তিনি মুসলিম লীগের নমিনেশন পেলেন কারণ তাঁর চাচাতো ভাই খাজা শাহাবুদ্দীন সাহেবের মেয়েকে বিবাহ করেন। তাই নাজিমুদ্দীন সাহেব, চৌধুরী খালিকুজ্জামান সাহেবকে বলে নমিনেশন নিয়ে আসেন।
শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, নীচতা ছিল না, দল মত দেখতেন না, কোটারি জানতেন না, গ্রুপ করারও চেষ্টা করতেন না। উপযুক্ত হলেই তাকে পছন্দ করতেন এবং বিশ্বাস করতেন। কারণ, তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল অসীম। তাঁর সাধুতা, নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাইতেন। এজন্য তাঁকে বারবার অপমানিত ও পরাজয়বরণ করতে হয়েছে। উদারতা দরকার, কিন্তু নীচ অন্তঃকরণের ব্যক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগণের ক্ষতি হয়।
আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল ‘আমরা মুসলমান’ আর একটা হল ‘আমরা বাঙালি।’ পরশ্রীকাতরতা ও বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোনো ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘ পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয় তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুন থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভরতি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ার খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং- ৪৭ হতে ৪৮)
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী (পর্ব-৩৬)
১১টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
একেবারে ঠিক কথা। “রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করোনি”—-সাধে কি এ কথা বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? আমরা প্রচন্ড স্বার্থপর। অন্যের খুশী কিংবা আনন্দে কখনোই খুশী হইনা।
বঙ্গবন্ধু ঠিকই বলেছেন।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
পরশ্রীকাতরতা নামক ব্যাধি সত্যিই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথকে রুদ্ধ করে দেয়। নিজেরা উঠার চেষ্টা না করে অন্যকে কিভাবে নামানো যায় সে চেষ্টাতেই অহর্নিশ সময় ক্ষেপণ!
নীলাঞ্জনা নীলা
দেশ থেকে একজন নতূন মহিলা এলেন ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে এক বছর আগে। বাঙ্গালীদের স্বভাব তো জানেনই, কথা শুরু করে দিলেন। নিশ্চয়ই স্বামীর সাথে ইত্যাদি, ইত্যাদি। কি চালাক মহিলা এসেই কিভাবে জানি চাকরী পেয়ে গেছেন। নিশ্চয়ই কিছু আছে! ঠিক এমন কথাই ওই ভাবীকে নিয়ে শুরু হলো। যেদিন প্রথম দেখা হলো, আমি বললাম আপনি যথেষ্ট স্মার্ট, আমাদের দেশের সকল মেয়েরা যদি এমন স্মার্ট হতো। উনি হেসে বললেন, এই প্রথম কেউ একজন চালাক না বলে স্মার্ট বললো। বললাম চালাকীর কি এতে? কিন্তু বুঝলাম এখানে মহিলারা ঘরে বসে রাঁধে আর বাচ্চা-কাচ্চার জন্ম দেয়। স্বামীসেবা করে। হিজাব-বোরখা পড়ে সমালোচনায় এক নম্বর অবস্থানে রাখে। আর যারা চাকরী করে নিজের এবং সন্তানদের প্রয়োজন মেটায়, তাদের নামে কতো যে কথা! রুবা’পু একটা কথা বলে রাখি, এসব মহিলারা আমাকে ঘাটায় না। একবার যদি ঘাটাতো, তাহলে খবর করে ছাড়তাম। 😀
লীলাবতী
উদারতা সবাইকে দেখাতে নেই। লিখুন নিয়মিত আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ঠিক। ধন্যবাদ।
মোঃ মজিবর রহমান
শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, নীচতা ছিল না, দল মত দেখতেন না, কোটারি জানতেন না, গ্রুপ করারও চেষ্টা করতেন না। উপযুক্ত হলেই তাকে পছন্দ করতেন এবং বিশ্বাস করতেন। কারণ, তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল অসীম। তাঁর সাধুতা, নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাইতেন। এজন্য তাঁকে বারবার অপমানিত ও পরাজয়বরণ করতে হয়েছে।
উদারতা দরকার, কিন্তু নীচ অন্তঃকরণের ব্যক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগণের ক্ষতি হয়।
মোক্ষম সত্যকথা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এই ছোট্টছোট্ট বাস্তব সত্যগুলো একটু একটু জানছি আর ধারণ করছি, যা জীবন চলার পথকে মসৃন করবে।
মৌনতা রিতু
লিখে যাও আপু, সংরক্ষন হোক ব্লগে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ। সাথে আছো তাই।
মিষ্টি জিন
পড়ছি, ভাললাগছে
লিখতে থাকুন আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সাথে আছেন, তাই শক্তি পাচ্ছি।