শরীর আমার খারাপ হয়ে পড়ে। দিনেরবেলায় ভীষণ গরম, রাতে ঠাণ্ডা। সকালে আর বিছানা থেকে উঠতে পারি নাই। বুকে, পেটে আর সমস্ত শরীরে বেদনা। দুই তিন দিন পায়খানা হয় নাই। অসহ্য যন্ত্রণা আমার শরীরে। দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে শুয়েই রইলাম। মাখন আমার কাছেই বসে আছে। ডাক্তার ডাকতে হবে, কাউকেই চিনি জানি না। একজন সেচ্ছাসেবককে বলা হল, তিনি বললেন, “আভি নেহি, থোড়া বাদ।” তাকে আর দেখা গেল না, ‘থোড়া বাদই রয়ে গেল।’ বিকালের দিকে মাখন খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমারও ভয় হল। এই বিদেশে কি হবে? টাকা পয়সাও বেশি নাই। মাখন বলল, “মামা আমি যাই ডাক্তার যেখানে পাই নিয়ে আসতে চেষ্টা করি। এভাবে থাকলে তো বিপদ হবে।” শহীদ সাহেব কোথায় থাকেন জানি না, অন্যান্য নেতাদের বলেও কোন ফল হয় নাই। কে কার খবর রাখে? মাখন যখন বাইরে যাচ্ছিল ঠিক এই সময় দেখি হেকিম খলিলুর আমাকে দেখতে এসেছেন। তিনি জানেন না, আমি অসুস্থ। খলিলুর রহমানকে আমরা ‘খলিল ভাই’ বলতাম। ছাত্রলীগের বিখ্যাত কর্মী ছিলেন। আলীয়া মাদ্রাসায় পড়তেন এবং ইলিয়ট হোস্টেলে থাকতেন।
ইলিয়ট হোস্টেল আর বেকার হোস্টেল পাশাপাশি, আমরা ঠাট্টা করে বলতাম ‘ইডিয়ট হোস্টেল’। খলিল ভাই আলীয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করে দিল্লিতে এসেছেন এক বৎসর পূর্বে, হাকিম আজমল খাঁ সাহেবের হেকিমি শিখবার জন্য। আমার অবস্থা দেখে তিনি বললেন, কি সর্বনাশ কাউকে খবরও দাও নাই! তিনি মাখনকে বললেন, আপনার ডাক্তার ডাকতে হবে না, আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি। আধ ঘন্টার মধ্যে খলিল ভাই একজন হেকিম নিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি আমাকে ভালভাবে পরীক্ষা করে কিছু ওষুধ দিলেন। তাঁকে খলিল ভাই পূর্বেই আমার রোগের কথা বলেছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ভয় নাই। ওষুধ খাওয়ার পরে তিন বার আপনার পায়খানা হবে, রাতে আর কিছুই খাবেন না। ভোরে এই ওষুধটা খাবেন। বিকালে আপনি ভাল হয়ে যাবেন। তিনি যা বললেন, তাই হল।
পরের দিন সুস্থ বোধ করতে লাগলাম। কনফারেন্সও শেষ হয়ে যাবে। খলিল ভাই আমাদের সাথেই দুই দিন থাকবেন। আমাদের দিল্লির সকল কিছু ঘুরে ঘুরে দেখাবেন। এই সময় আর একটা ঘটনা ঘটল। বরিশালের নূরুদ্দিন আহমেদের সাথে আনোয়ার সাহেবের ঝগড়া হয়েছে। নূরুদ্দিন রাগ করে আমাদের কাছে চলে এসেছে। তার টাকা পয়সাও আনোয়ার সাহেবের কাছে। তাকে কিছুই দেয় নাই, একদম খালি হাতে আমার ও মাখনের কাছে এসে হাজির। বলল, “না খেয়ে মরে যাব, দরকার হয় হেঁটে কলকাতা যাব, তবুও ওর কাছে আর যাব না।” এই নুরুদ্দিন সাহেবকেই মাখন ইসলামিয়া কলেজ ইউনিয়নের ইলেকশনে জেনারেল সেক্রেটারি পদে পরাজিত করেছিল। নুরুদ্দিনকে ছাত্ররা ভালবাসত কিন্তু সে আনোয়ার সাহেবের দলে ছিল বলে তাকে পরাজিত হতে হয়েছিল। আইএ পড়লেও দলের নেতা আমিই ছিলাম। আমরা একই হোস্টেলে থাকতাম। বললাম, “ঠিক আছে তোমার ওর কাছে যাওয়া লাগবে না, যেভাবে হয় চলে যাবে।” যদিও ওর জন্য টিকিট করার টাকা আমাদের কাছে নাই। তিন দিন থাকবে ঠিক হল। খাবার খরচ বেশি, হোস্টেলে খেতে হয়। দুই দিনের মধ্যেই খলিল ভাইকে নিয়ে দিল্লির লালকেল্লা, দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস, কুতুব মিনার, নিজাম উদ্দিন আওলিয়ার দরগাহ, নতুন দিল্লি দেখে ফেললাম। কিছু টাকা খরচ হয়ে গেল। হিসাব করে দেখলাম, তিনজনের টিকিট করার টাকা আমাদের নাই। দুইখানা টিকিট করা যায়, কিন্তু না খেয়ে থাকতে হবে। খলিল ভাই একমাত্র বন্ধু, তবে তিনি তখনও ছাত্র তার কাছেও টাকা পয়সা নাই। যাহোক, আর দেরি না করে স্টেশনে এসে হাজির হলাম। তিনজনে পরামর্শ করে ঠিক করলাম, একখানা টিকিট করব এবং কোনো ‘সার্ভেন্ট’ ক্লাসে উঠে পড়ব। ধরা যদি পড়ি, হাওড়ায় একটা বন্দোবস্ত করা যাবে।
প্রথম শ্রেনীর প্যাসেঞ্জারদের গাড়ির সাথেই চাকরদের জন্য একটা করে ছোট্ট গাড়ি থাকে। সাহেবদের কাজকর্ম করে এখানেই এসে থাকে চাকররা। দিল্লি যাওয়ার সময় আমরা ইন্টারক্লাসে যাই। এখন টাকা ফুরিয়ে গেছে, কি করি? একখানা তৃতীয় শ্রেনীর টিকিট কিনলাম হাওড়া পর্যন্ত। আর দুইখানা প্লাটফর্ম টিকিট কিনে স্টেশনের ভিতরে আসলাম। মাখনের চেহারা খুব সুন্দর। দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না ‘চাকর’ হতে পারে। আমরা শুনলাম, খান বাহাদুর আবদুল মোমেন সাহেব এই বগিতে যাবেন। নুরুদ্দিন খোঁজ এনেছে। ভাবলাম, বিপদে পড়লে একটা কিছু করা যাবে। নুরুদ্দিনকে খান বাহাদুর সাহেব চিনতেন। তিনি রেলওয়ে বোর্ডর মেম্বারও ছিলেন। আমরা তাঁর গাড়ির পাশের সার্ভেন্ট ক্লাসে উঠে পড়লাম। মাখনকে বললাম, তুমি উপরে উঠে শুয়ে থাক। তোমাকে দেখলে ধরা পড়ব। এই সকল গাড়িতে বোধহয় কোনো রেলওয়ে কর্মচারী আসবে না। নুরুদ্দিনকে সামনে দিব যদি কেউ আসে। একবার এক চেকার সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কোন সাহেবের লোক?” নুরুদ্দিন ঝট করে উত্তর দিল, “মোমেন সাহেব কা।” ভদ্রলোক চলে গেলেন। কিছু কিছু ফলফলাদি নুরুদ্দিন কিনত, আমরা তিন জন খেতাম। ভাত বা রুটি খাবার পয়সা নাই। তিনজনে ভাত খেতে হলে তো এক পয়সাও থাকবে না।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং- ২৬ ও ২৭)
৮টি মন্তব্য
অনিকেত নন্দিনী
হাহাহা। অবশেষে এই বুদ্ধি! চাকরদের বগিতে করে ভ্রমণের পরের গল্প জানার অপেক্ষায় রইলাম।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
কতো যে চমক আছে! পাশাপাশি ফুটে উঠছে আগেকার সময়ে মাটি মানুষের নেতারা কিভাবে নিজের ঘাটের পয়সা খরচ করে রাজনীতি করতেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
কতো কিছু জানা হচ্ছে। অপেক্ষায় আছি পরের পর্বের জন্য।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
যথাসময়েই হাজির করার ইচ্ছা রাখি।
দীপংকর চন্দ
বইটি আমার কয়েকবার পড়া।
এতো সাবলীল প্রাণবন্ত লেখা, পুনঃপাঠেও ভালো লাগা অটুট থাকে।
অনিঃশেষ শুভকামনা।
ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অনেক ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
চাকরদের অংশ পড়ে দারুন মজা পেলাম।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
তখনকার সময়ে রাজনীতিবিদদের জীবন যাত্রা স্পষ্ট হচ্ছে।