বুলেটটা ছুটে আসছে অসম্ভব দ্রুত গতিতে, ঠিক যেমনি করে বুলেটটির ছোটার কথা ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনক মনে হলেও আমি বুলেটটির এগিয়ে আসার প্রতিটি ধাপ স্পষ্ট দেখতে পারছি। ইচ্ছে করলেই ছুটে গিয়ে আমি এখন বুললেটির গতি পরিবর্তন করে দিতে পারি, কিংবা নিজে সরে গিয়ে বুলেটের আঘাত করার রেঞ্জের বাইরে চলে আসতে পারি। অবিশ্বাস্য হলেও আমার এখন এর কোনটিই করতে ইচ্ছে করছে না। ভেতর থেকে আমি প্রস্তুত ছিলাম, এটা যে হবেই তা আমার জানা ছিল। কিংবা বলা যেতেই পারে এটা আমার স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে পরখ করার মত একটা বিষয়। কিংবা তোমাদের চোখে যা আত্মহত্যা, আমি সেটাই করছি এই মুহূর্তে…
হ্যাঁ, আমি জানতাম আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম একটা দীর্ঘ সময়। সাথে চমৎকার একটা স্বপ্নেও বিভোর ছিলাম লম্বা এই সময়টা ধরে। স্বপ্ন যা বাস্তবতাকে ছুঁয়ে তার সমমানের আরেকটা বাস্তবতায় রূপ লাভ করেছিল আমার নিউরন গুলির সহায়তায়। এই স্বপ্নটাকে যদি কেউ সিম্যুলেশন করে ধরে রাখতে পারত তাহলে নিশ্চিত এরচেয়ে নিখুঁত ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রোগ্রাম দুনিয়ার দ্বিতীয়টি হতে পারত না। কিন্তু আমার এই সময়টাতে প্রযুক্তি এখনো তত দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়নি, আর হয়নি বলেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সেই স্বপ্নটাতেও কিছু একটা ছিল, এমন কিছু যা আমার মস্তিষ্ককে ঠিকই বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমি সেই স্বপ্ন থেকে বের হতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত আমাকে সেই পথটাই বেঁছে নিতে হল যেটা সাধারণত কেউ বেঁছে নেয় না।
হ্যাঁ, স্বপ্নে আমাকে আত্মহত্যাই করতে হয়েছিল। আর এভাবেই ঐ স্বপ্নটার ইতি ঘটল।
ধারেকাছে কোথাও হুইসিল বেজে যাচ্ছে তারস্বরে। হুইসিলের শব্দটা যেন নিজেই নড়াচড়া করতে পারছে। একটু আগে ঐ হুইসিলের শব্দের উৎস যেমন অনেক দূরে মনে হয়েছিল এখন সেটা নিতান্তই নিকটে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আর একটু পরেই আমি সেই হুইসিলটাকে সহ হুইসিল বাদককে দেখতে পারবো।
হল ও তাই, চোখ ধাঁধানো আলো জ্বেলে একটা ট্রেন এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আর আমার অবস্থান ঠিক সেই ট্রেনটার চলার পথের মধ্যখানে। পায়ে খুব শক্ত করে সেঁকল লাগানো রয়েছে আমার। ইচ্ছে করলেও আমি এখন এই রেল পথ ছেড়ে বাইরে দাড়াতে পারব না। চরম ভয়ংকর একটা মুহূর্ত, বলা চলে আমার এই জীবনের শেষ মুহূর্ত এটা। কিন্তু আশ্চর্যজনক শোনালেও, আমি ভয় পাচ্ছি না। কোনরূপ অস্থিরতা আমাকে ছুঁতে পারছে না। নিশ্চল মানুষের মতই আমি নির্বিকারে দাড়িয়ে আছি রেল লাইনটার মধ্যে। ধীরে ধীরে ট্রেন এগিয়ে আসছে আমার দিকে। এত ধীরে যে আমি তার চাকার প্রতিটা সাইকেল পূর্ণ করার সময় পর্যন্ত গুনে দিতে পারব। সেই হিসেবে অফুরন্ত সময় আমার হাতে। কিন্তু এটাও নিশ্চিত, প্রতিটি মাইক্রো সেকেন্ড পার হচ্ছে আর নিশ্চিত মৃত্যু আমার দিকে ধেয়ে এগিয়ে আসছে…
হ্যাঁ, আমি এবারও আত্মহত্যা করেছি। কারণ আমার জানা ছিল মৃত্যু রূপে ঐ ট্রেন আমাকে কখনোই ছুঁতে পারবে না, বরং আমাকে সহায়তা করবে। আর হয়েছেও সেটাই। আমি এবারে সত্যিকার অর্থেই জেগে উঠেছি ঐ ঘুম থেকে।
অদ্ভুত, তাই না? আমি একটি ঘুমের মধ্যে আরেকটি ঘুমের স্বপ্ন দেখছিলাম, আর সেই স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন থেকে জেগে উঠবার জন্যে এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম যে নিজের পরোয়া পর্যন্ত করিনি। একটা ধারণার উপর ভিত্তি করে নিজেকে বসিয়ে দিয়েছি গান পয়েন্টের সামনে। তারপর যখন সেই স্বপ্নটা থেকে বের হয়ে আসলাম, বুঝলাম এটাও আমার আরেকটা স্বপ্ন। আর ততক্ষণে সেই স্বপ্ন থেকে আমাকে আবার জাগিয়ে তুলবার আরও অনেক ধাপ পার করে ফেলেছিল আমারই অবচেতন মন। আর এবারে সোজা ধরে নিয়ে দাড় করিয়ে দিয়েছিল একটা ট্রেন লাইনের উপর।
জেগে উঠলাম আবার। সেই পরিচিত জায়গা, সেই পুরনো গন্ধ বাতাস জুড়ে। আধো আলো আধো অন্ধকার পুরো ঘরটা জুড়ে। আসবাব সবই অস্পষ্ট, কিন্তু স্মৃতিকে ধার করে আমি সবই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কোথাও জেনারেটর কিংবা মেশিনের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। খুব সম্ভবত লোড শেডিং চলছে।
আলসেমির কারণে উঠে বসতে ইচ্ছে করছে না। মাথাটা ঘুরিয়ে দেয়ালে ঝোলানো ডিজিটাল ঘড়িটার দিকে তাকালাম। রাত এমন বেশি কিছু হয়নি, তবুও মেশিনের ঐ গুঞ্জন ছাড়া মোটামুটি চারিপাশটা নিশ্চুপ বলা চলে। অসময়ে ঘুমিয়ে পড়লে অবশ্য এমন অসময়েই জেগে উঠতে হয়।
পাশ ফিরে ঘুরতে গিয়েই ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। কিন্তু যতক্ষণে বুঝতে পারলাম ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। খুব মোটা কয়েকটা বেল্ট দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে একটা টেবিলের উপর আটকে রাখা হয়েছে আমাকে। খুব সম্ভবত আমার শরীরে এমন কিছুর প্রবেশ করানো হয়েছে, যার কারণে আমি কোন কিছুই অনুভব করতে পারছি না। অসাড় হয়ে পড়ে আছি টেবিলটার উপর। আর এটা বুঝতে পারার মুহূর্তেই চট করে মনে পড়ল যে মেশিনের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল সেটা মূলত কোন জেনারেটরের গুঞ্জন নয়। খুব ধীরে ধীরে পেন্ডুলামের ন্যায় দুলতে থাকা ধারালো এক যন্ত্রবিশেষ আমার দিকে নেমে আসছে। আর একে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনার কাজটিই করছে একটা ছোট্ট মোটর। আবারও ঘড়ির দিকে তাকালাম, ঘড়ির সময়ের যদি কোন হেরফের না হয়ে থাকে তবে নিশ্চিত করে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার মৃত্যু ঘটবে।
কিংবা কে জানে!
হয়ত এটাও একটি আত্মহত্যার প্রচেষ্টা, যা আমাকে জাগিয়ে তুলবে অদ্ভুত এই স্বপ্ন থেকে…
১৭টি মন্তব্য
বোকা মানুষ
দুর্দান্ত একটা গল্প!
অলিভার
ধন্যবাদ বোকা ভাই 🙂
নীতেশ বড়ুয়া
কিভাবে বলি! ‘Inception’ মুভিতে মানুষকে ঘুমের মধ্যে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির বেশ কয়েকটি স্তরে যাওয়ার ব্যাপারটি বুঝানো হয়েছিলো, আর আপনি ঘুমের মধ্যে নাকি ঘুম ছাড়াই স্বপ্নের মধ্যে একের পর এক মৃত্যুর জাল বুনেছেন আর শেষ্টিও করেছেন সেই অনাকাংখিত স্বপ্ন নাকি জাগরণের অভদুত মোহ ছড়িয়ে।
আপনার লেখা মানেই বিজ্ঞানের জ্ঞানের সাথে ধ্যানের কিছু পাওয়া। (3 অলিভার দাদা -{@
অলিভার
সত্যি বলতে কি, ইনসেপশন মুভির ঘটনাচক্র এখনো আমার কাছে পরিষ্কার নয় :p একবার নয়, গুনে গুনে সম্ভবত ৩ বারই দেখেছিলাম। তবুও পুরোটা বুঝে উঠতে পারি নি। সেদিক থেকে এটা শুধু সাদামাটা গল্পই নয় বরং তার থেকে অনেক নিচে এর অবস্থান।
তবে লেখাটা ভিন্ন কিছু চিন্তা করে শুরু করেছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই যা চিন্তা করি তার থেকে ভিন্ন কিছুই কিবোর্ড টাইপ করিয়ে নেয় আমাকে দিয়ে :p সেই হিসেবে গল্পকারের নামের স্থানে আমার নামটা না বসিয়ে ‘মহামান্য কিবোর্ড’ – এর নামটাই ব্যবহার করা উচিৎ ছিল বলে মনে করছি।
চমৎকার এমন মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ -{@ -{@
নীতেশ বড়ুয়া
Dimensional Delusion এর চমৎকার এক্সাম্পল এই ‘ইন্সেপশন’ মুভিটি।
আপনার গল্পের ক্ষেত্রে বলতে চাই Dream/Dreams of Suicidal Delusion। মুভিটিতে যেমন বাস্তবতাকে ভ্রমে শেষ করা আপনার গল্পে মৃত্যুকে স্বপ্ন বিভ্রমে নিয়ে যাওয়া। মিলটি হচ্ছে ‘বিভ্রম’ যদিও আদতে ভ্রম নাকি তাও প্রশ্নবিদ্ধ দু’জায়গাতেই…
fact of Endless reality :p
আবু খায়ের আনিছ
নীতেশ দাদা সাথে সহমত। এই কমেন্টস এর পর আমি আর কোন কমেন্টস করতে পারছি না।
নীতেশ বড়ুয়া
😀
শুন্য শুন্যালয়
আপনার লেখাগুলোর ছবি কোথা থেকে নেন অলিভার? সবসময় লক্ষ্য করেছি, লেখাটার জন্যেই যেন ছবিগুলো।
গল্পটা খুবই ইন্টারেস্টিং এবং ব্যতিক্রম। আপনার লেখা এমন হবে, ভেবেই যেন আসা আপনার লেখায়। 🙂
অনেক ভালো লেখেন আপনি।
অলিভার
হা হা হা
ছবিগুলি গুগল ইমেজ সার্চিং এর সহায়তা নিয়ে সংগ্রহ করি। মাঝে মধ্যে দু’একটা বিভিন্ন ইমেজ শেয়ারিং সাইট কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া হতে নেই। কিন্তু কোন ছবিই মূলত সরাসরি ব্যবহার করি না। ছবি সংগ্রহের পর কিছুটা পরিবর্তন করে নিয়ে তারপর সেটাকে ব্যবহারের চেষ্টা করি।
কৃতজ্ঞতা, লেখাটি পড়ে চমৎকার এমন মন্তব্য দেবার জন্যে 🙂
রিমি রুম্মান
তবে আজকের ছবিটি দেখার পর থেকেই মাথা চক্কর দিচ্ছে। পুরো লেখাটা পড়ে শেষ করতে পারিনি। ভাল করে পড়ে মন্তব্য করবো আশা রাখি। 🙂
অলিভার
তাহলে অপেক্ষায় রইলাম আপনার অপর আরেক মন্তব্যের 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
আপনি সবসময় অন্যরকম লেখেন। আর তাই আগ্রহ আকাশ-ছোঁয়া।
ছবিটার তুলনা হয়না। (y)
অলিভার
সত্যিই অন্যরকম! ভালো করে চিন্তা করলে প্রায় একই থিমে ভিন্ন ভিন্ন কথা লিখি, অন্তত আমার তাই মনে হয়।
আপনাদের মত করে স্বল্প কথায় বিশাল গল্প লিখতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।
শুভ কামনা আপু 🙂
জিসান শা ইকরাম
অলিভার এর গল্প মানেই অন্য রকম …………
অলিভার
আর অলিভার মানেই ফাঁকিবাজ :p :D) :D)
আগুন রঙের শিমুল
অলিভার , দুর্দান্ত একটা গল্প পড়লাম 🙂
অরুনি মায়া
সুন্দর গল্প | দম বন্ধ হয়ে আসছিল পড়ার সময় | কারণ আমার একটু স্বপ্নভীতি আছে,,,