সূর্যাস্তের পরের সময়টা আমার ঠিক বোধের বাইরে। এ এক অদ্ভু্ত সময়! সাঁঝ-সকালের সাদা সিধা ভালো চাকুরে মানুষটি হঠাতই রাতের আঁধারে ছোরা হাতের ভয়ংকর খুনে হয়ে যায়। পেশাদার খুনীটি সব ছেড়ে ছুড়ে দিব্যি সংসারী বনে যায় কিংবা সন্ন্যাসী। তীব্র ধর্মবিদ্বেষী ছেলেটাও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে স্রষ্টার অনুগ্রহের আশায়। বারো হাতের কাপড়ে পা হতে মাথা অব্দি জড়িয়ে রাখা মেয়েটি বনে যায় বেশ্যা। দাঁতভাঙা থিওরি মুখস্ত করা ক্লাসের বোকাসোকা লাজুক ছেলেটি হয়তো লিখে ফেলে জীবনের প্রথম মিলন কাব্য।
কি আছে এই আঁধারের কালিমায়! বহু মানুষ আছে যারা রাতের পর রাত দু চোখের পাতা এক না করে কাঁটিয়ে দেয়। অতিশয় ভদ্রলোকেরা তাদের হেয়ালি-অকর্মা বলে তাচ্ছিল্য করতে দ্বিধা করে না। কিন্তু রাতঘুমে সাদা কালো স্বপ্ন দেখে অভ্যস্ত ভালো মানুষগুলো কোনো ক্রমেই বুঝে উঠতে পারে না, এই নিষ্কর্মা হেয়ালী মানুষগুলো নির্ঘুম চোখে কি অদ্ভুত জোছনা-জোনাই রঙা স্বপ্ন বুনতে পারে নিখুঁত ভঙ্গিমায়। আবার পরক্ষণে চাইলেই এক নিমিষে আশ্চর্য নিরলিপ্ততার সাথে কল্পনার জোড়া-সুতোগুলো কেঁটে চঞ্চল খন্ডগুলোকে অপার্থিব নিস্তব্ধতায় উড়িয়ে দিতে পারে।
মানুষের মনস্তাত্বিক ব্যাপারগুলো খুবই জটিল। আর সেক্ষেত্রে অনেকখানি প্রভাব ফেলে প্রহর। ভোরের ফুরফুরে মেজাজে মর্নিং ওয়াক করে আসা লোকটি দুপুর না পেরোতেই চিড়চিড়ে মেজাজের হয়ে ওঠে, আবার বিকেল গড়ালেই রাগ মিইয়ে আসে, কতশত চিন্তা এসে ভিড় করে তখন। তবে রাতজাগা মানুষগুলো, রাতঘুমের মানুষদের থেকে আলাদা এক জগৎ তৈরি করে নেয়। বেলা পড়ে আসার সাথে সাথেই সে জগতে তাদের বিচরণ শুরু হয়ে যায়। কৃষ্ণপক্ষ রাত্রির গাঢ়ত্ব যতই বাড়তে থাকে কিংবা কোণে কোণে পূর্ণিমার স্বচ্ছ-শীতল জোছনা প্রস্ফুটিত হতে থাকে, নিদ্রাহীন মানুষগুলো ততই উতলা হয়ে ওঠে, যেন কিছু ছুঁতে চায় ওরা; যা কিনা নাগালের ভেতরেই, কিন্তু অদৃশ্য। এক পর্যায়ে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির মাঝে সুঁচ সমান মধ্যস্থতায় দোলায়মান থেকে পাওয়া, না পওয়ার দুর্বোধ্য হিসেব কষতে শুরু করে। হয়তো সেই হিসেব মেলাতে পারে; হয়তো পারে না। এ নিয়ে আক্ষেপ নেই তাদের। নতুন ভাবনায় আড়াল করে দেয় অসমাপ্ত অঙ্ক। কিংবা সকল কিছুকে তুচ্ছ করে অসীম সাহসিকতায় সহজ সমাপ্তি টেনে আনে আত্মহননের পথে।
শুভ-অশুভ যা ই হোক না কেন, রাতের গাম্ভীর্যে কিংবা নৈশব্দে জমাট বেঁধে থাকে শক্তি, দুঃসাহস। এই জেগে থাকা মানুষগুলোর মানসিক শক্তি কিন্তু লিব্রিয়াম-সিডাক্সিন খেয়ে ঘুমিয়েই পড়া মানুষগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। ইন্দ্রিয়ের আলস্য কিংবা নিগুঢ় অন্ধকার কোনোটিই এদেরকে কাবু করতে পারে না। আপন মানসিক বলে তারা রাত্রিকে ছোঁয় খুব কাছ থেকে। এই শক্তির জোরেই কেউ হয়তো করে ফেলে জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর কাজটি কিংবা আবির্ভুত হয় স্রষ্টার স্বরূপে মহৎ সৃষ্টির আড়ালে। রাতময় সংযোগ ঘটে অনুরূপ আত্মায়।
সূর্যোদয় হয়।
নিশাচরদের কেউ ঘুমোতে যায়, কেউ ব্যস্ত হয়ে যায় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে। তখন কিন্তু তাদের চেনা দায়। বরং রাতের সেই মানুষগুলো তখন অনেকাংশেই ব্যবহারিক হয়ে ওঠে। অভাবনীয় এক পরিবর্তন খেলে যায় তাদের আচরণে।
রাতভর কবিতাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে বারান্দায় পায়চারি করছিল যে ছেলেটি, দুপুরের খাওয়া ভুলে সে কিনা অফিসের ফাইলে বুদ হয়ে যায়। মোট টাকার অঙ্কটা মিলছেই না; চাকরি নিয়ে যে টান পড়বে। রাতভর বালিশে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কাঁদতে থাকা কিশোরীটিও ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথেই সাগ্রহে চুলে বিনুনি করে; বিছানা পরিপাটি করতে শুরু করে। যেন গত রাতের ক্রন্দনরত মেয়েটি তার অচেনা, সেই মেয়ের দুঃখগুলোও তার অজানা।
প্রহর বদলে দেয় বাহ্যিকতা; এমন কি মনকেও বদলে দিতে সক্ষম। সূর্যকিরণ কারো জন্য হতে পারে জৌলুস, কারো জন্য আশার বাণী। নরম রোদ ঝলমলে কোনো সকালে নেশাগ্রস্ত টাল-মাতাল যুবকটিও হয়তো এক চিলতে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে গা ঝারা দিয়ে উঠে বসে। চুল-দাড়ি কেটে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে শুরু করে। প্রেমিকাকে দেয় প্রতিশ্রুতি। আদরের ছেলেটিকে ঘিরে অসহায় বাবার মনে সঞ্চার হয় নতুন আশার।
এই আশা জাগানিয়া আলোকরশ্মিই আবার কারো কারো সহ্যের বাইরে; চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, ঝলসে দেয় অন্তরাত্মা। দিনের আলোয় গা ঢাকা দিয়ে, রাতের আঁধারে তারা বেরিয়ে আসে কেবল পশুত্বকে জানান দিতে। আবার এই আঁধারকেই পবিত্রজ্ঞান করে শুভ আত্মার খোঁজে অন্তরাত্মা ভাসিয়ে দেয় অনেকেই। তাদের কাছে এই নিকষ-কালো নির্জনতা মাতৃগর্ভের মতই নিরাপদ; গভীর ও স্বচ্ছ। নিদ্হীন এলোমেলো কল্পনাই সেসব নিশাচরদের পূজনীয় স্বপ্ন; আধ্যাত্ম এবং সার্বিক শক্তির পরিপূরক।
অথচ রাতঘুমে অভ্যস্তদের জন্য রাতের অন্ধকার কেবল সমূহ ত্রাসের শংকা এবং নিছক কালিমা ছাড়া যেন কিছু নয়। এ কালিমার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা স্বচ্ছ-সফেদ প্রগাঢ় সীমাহীন অদ্ভুত জগতটাকে তারা দেখতে পায় না। সে জগৎ তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাদের চোখ যদ্দুর যায়, তারা দেখতে পায় শুধুই অশুভের আনাগোনা।
২২টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
বহুবার পড়লাম।
সময় আসলেই প্রহেলিকা। এতো গভীরতা নিয়ে লেখা, ভাবছি কিভাবে সম্ভব এতো সহজভাবনার সাথে মেলানো সময়ের জালকে? একটার পর একটা জাল খুলছি কিন্তু সেই আরেক জাল। মোহ-আবেশে আচ্ছন্ন হবার মতো লেখা।
এককথায় অসাধারণ, দূর্দান্ত, অতুলনীয়। (y) -{@
সাবরিনা
দারুণ প্রশংসা করতে জানেন তো আপনি। ধন্যবাদ। অনেক ভালোবাসা।
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রশংসা করার মতো হলে তো করতেই হয়।
আজিম
প্রহরের সাথে সাথে মানব মনের পরিবর্তন এবং বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন মানসিকতা-সংক্রান্ত আরো কিছু গবেষণামূলক এ্ই লেখাটি খুব ভাল লাগলো। বোঝা গেল বিবেকের দংশন রয়েছে আপনার আর আছে লেখার হাতও।
আরো উন্নতি করুন, এই আশা করি।
সাবরিনা
ধন্যবাদ। সঙ্গেই থাকবেন।
জিসান শা ইকরাম
ভালো লিখেছেন।
* আপনার বিভাগ নির্বাচনটা সঠিক হচ্ছে না। বিভাগ অর্থ আপনি কোন বিভাগে বাস করেন তা নয়। এখানে বিভাগ হচ্ছে সাহিত্য- সাহিত্যের মাঝে বিভাগ- গল্প,কবিতা, রম্য। আরো অনেক বিভাগ আছে এখানে, ভ্রম্ন,ছবি ব্লগ, গান, মুভি রিভিউ, সিরিয়াল, মুক্তিযুদ্ধ, সমসাময়িক, একান্ত অনুভুতি।
বিভাগ হচ্ছে আপনার লেখাটা কোন বিভাগে যাবে। লেখা খুঁজে পেতে বিভাগ নির্বাচনটা জরুরি। ঢাকা বিভাগ বলতে বুঝাবে- দর্শনীয় স্থান, গুরুত্বপুর্ন ব্যক্তির কাজ,জীবনি ইত্যাদি। বুঝতে না পারলে জানাবেন।
শুভ কামনা।
সাবরিনা
হা হা হা আমি এখনো বুঝি নি তো। নেট বিষয়ক কিছুই আমার মাথায় ঢোকে না। আমি বুঝতেই পারি না আমার কোন লেখাটা আসলে কোন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সমস্যা নেই। যত দ্রুত সম্ভব আমিনের কাছ থেকে বুঝে নেব।
ব্লগার সজীব
এটি তো সহজ খুব।কেউ কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগে পড়ছে।তাকে যদি পড়াশুনার বিভাগ জিজ্ঞেস করা হয়,তিনি উত্তর দিবেন ঢাকা বিভাগ :D) :D)
আপনার লেখাটি একান্ত অনুভুতি বিভাগে প্রকাশ হলে ভালো হয়।কারন আপনি কোন দর্শনীয় স্থান নন।লাল বাগের কেল্লা নন বা শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতি সৌধ ও নন :p
লেখাটি খুবই ভাল হয়েছে আপু।
সাবরিনা
ওহহ আচ্ছা। এখন থেকে তাই দিয়ে দিব নি
সাবরিনা
হঠাত একটা প্রশ্ন এলো মাথায় ব্লগার সজীব। ঢাকা বিভাগ থেকে কোনো লেখাই কি প্রকাশ হয় না তাহলে? কারণ আমি যদ্দুর জানি এখানে আপনাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যিনি নিজেই কোনো দর্শনীয় স্থান কিংবা লাল বাগের কেল্লা, শহীদ মিনার অথবা স্মৃতিসৌধ।
আমি এখানে নতুন। তাই আক্রমণ না করে ম্যানেজমেন্ট এর দিকে খেয়াল করা উচিত। ধন্যবাদ।
ব্লগার সজীব
আপনাকে আক্রমন করা হয়নি আপু।আপনাকে কেন আক্রমন করবো?আপনি কি আমার শত্রু? মন্তব্যের শেষে তাহলে ইমো আর দিতাম না। জানতে চেয়েছেন তাই লিংক দিলাম ঢাকা বিভাগে প্রকাশিত কিছু লেখা।
https://sonelablog.com/archives/24563 – আমাদের অহংকার জাতীয় স্মৃতিসৌধ
https://sonelablog.com/archives/11284 – যানজট মুক্ত সবুজ ঢাকা !
https://sonelablog.com/archives/6724 – পাল্টে যাচ্ছে ঢাকা
https://sonelablog.com/archives/4274 – খবরঃধলেশ্বরী-১ ব্রিজে অত্যাধুনিক টোল প্লাজা স্থাপনের কাজ সমাপ্তির পথে।
https://sonelablog.com/archives/308 – দেশকে জানুন – ঢাকা বিভাগ
সোনেলার ব্যানারের নিচেই সব বিভাগ গুলো আছে আপু। ওখানে ক্লিক করলেই বিভাগ আনুযায়ী প্রকাশিত লেখা চলে আসে। আমার মন্তব্যে আপনি দুঃখ পেয়ে থাকলে আমি স্যরি। আপনি যেমন ইচ্ছে তেমন পোষ্ট দিতে পারেন। এ বিষয়ে আমার আর কোন বক্তব্য বা মন্তব্য নেই। আমি আমার পূর্বের সব মন্তব্য প্রত্যাহার করলাম।
জিসান শা ইকরাম
মন্তব্য প্রত্যাহার কেন করবেন? সহ ব্লগারের পাশে থাকবেন সব সময় এটি আমাদের প্রত্যাশা।
জিসান শা ইকরাম
রাতটা আমার কাছেও ভিন্ন।
কোলাহল শুন্য, কানে অন্য কোন শব্দ না আসায়, নিজকে নিয়ে মগ্ন থাকা যায়।
বরাবরের মতই আপনি এই লেখাটি অত্যন্ত ভালো লিখেছেন।
লিখুন নিয়মিত।
শুন্য শুন্যালয়
চমৎকার আপনার লেখার হাত। রাতের সাথে সাথে দিনের আলোয় মানুষের মিশে যাওয়া, দুই প্রহরের বর্ননা অসাধারন ফুটিয়েছেন।
রাতঘুমে অভ্যস্তদের জন্য যদ্দুর যায়, তারা দেখতে পায় শুধুই অশুভের আনাগোনা…এই লাইনটুকু পড়ে একটু হাসছি। 🙂 রাতঘুমে অভ্যস্ত এই আমি র দুঃসাহস হচ্ছেনা কিছু বলার, এমন করে লিখতেই যে পারবনা। আপনি অনেক ভালো লেখেন সাবরিনা। লেখা চালু রাখবেন সবসময়।
সাবরিনা
ধন্যবাদ আপু।
অনেকখানি হাসলে আরো ভালো হত। জানেন তো প্রতি দিন পাঁচ গ্যালন করে হাসা উচিত।
অরণ্য
আপনার লেখা চমৎকার। দারুন প্রকাশ আপনার। (y)
সাবরিনা
Thank you. -{@
স্বপ্ন
অত্যন্ত ভালো লিখেছেন আপু।
সাবরিনা
ধন্যবাদ আপু/ভাইয়া -{@
মেহেরী তাজ
আপনি মারাত্মক ভালো লেখেন।
আপনার এই লেখাই মনে হয় আমি প্রথম পড়ছি। এবং এই লেখা আরো কয়েক বার পড়তে চাই।
সাবরিনা
হা হা হা আপনার ইচ্ছা পূরণ হোক হাইনেস। 🙂
নীতেশ বড়ুয়া
রাত, অন্ধকার। সময় বন্ধ করে দিলেই অন্ধকার হয়ে ওঠে রাত… অন্ধকার মানেই শুন্যতা আর শুন্য হতেই শুরু তাই মনে হয় রাতেই সবার ভিন্ন কিছু শুরু হয় যা রাত ফুরোলেই চলতে শুরু করে ভিন্ন ভিন্ন আমেজে 🙂