১
আমি থাইল্যান্ড হতে বাংলাদেশে এসে প্রথম অফিসে পা রাখতে দেখলাম, অফিসের এদিক সেদিক বিভিন্ন বয়সী নারী। অবাক হই নাই, কারণ হর হামেশাই বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ এখানে হয়ে থাকে। এগিয়ে আসে একটি মেয়ে। হাতে গরম চা, বিস্কুট, আপেল। আফা আপনার কথা খালি স্যারেরা কয়। আপনি নাকি খ্রিস্টানদের দেশে গেছিলেন’? আমি মুচকি হেসে বললাম, আপনার নাম কি? বলল, নাসরীন আক্তার (ছদ্ম নাম)। আমরা গোয়ালন্দের পতিতা পল্লী হতে আপনাদের এখানে প্রেরশিক্ষন নিবার আইছি। আফা একটা বিস্কুট খান? আমি ওর বিস্কুটের একটু অংশ ভেংগে মুখে দিলাম। এসময়ে প্রশিক্ষক মোজাম্মেল হক নিয়োগী ভাই বললেন, লায়লা ভাল আছেন? ঘার নেড়ে বললাম হ্যা ভাল, আপনি? তিনি বললেন ভাল আছি, কিন্তু প্রশিক্ষণ চালাতে একটু বেগ পেতে হচ্ছে। তিনি বললেন হিউম্যান রাইটস এর উপর ১৫ দিনের একটি টি ও টি। ওরা প্রশিক্ষণ নিয়ে অন্য মেয়েদের দিবে। নাসরীন ততক্ষণে অস্থির হয়ে আছে আমার সাথে কথা বলবার জন্য, আপা আপনি নাকি বিদাস থিকা লজেন্স নিয়া আইছেন। আমি বললাম আজ নিয়ে আসি নাই, আগামী কাল বাসা হতে নিয়ে আসবো, তখন তোমাকে দিব। পরের দিন সকাল ৮ ঘটিকার সময় অফিসে গিয়েছি। আমার কথার শব্দ শুনে নাসরীন আক্তারের আগমন। আপা লজেন্স? আমি ওর হাতে দুটি লজেন্স গুজে দিয়ে বললাম কেমন আছেন নাসরীন আপা। বললেন এখানে ভাল লাগতেছে না, বন্দী বন্দী লাগতেছে, নিয়োগী ভাই বাইরে যাইবার দিতেছে না। আপনেদের ম্যানেজারও কইছে, বাইরে যাওন যাইব না। আফা একটু বসি আপনের কাছে। আপনারে আমার খুব মনে ধরছে। বললাম বসেন। ওর চোখে চোখ রেখে বললাম নাসরীন আপা আপনাকে একটা ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞাসা করবো। নাসরিন বলল, বলেন। আমি অভয়বানী পেয়ে বললাম,আপনি কেন এই পথে এলেন? আপা আপনি আমারে নাসরীন কইবেন আর তুমি ডাকবেন। আমি খুব খুশী হমু। চঞ্চল এই মেয়েটি শুরু করলো তার কাহিনী
২
তখন আমার বয়স ১৪ বছর। আফা বিশ্বাস করবেন না, কাঁশবাগানের ধার দিয়ে হাটতে কি যে ভাল লাগতো। একবার কাঁশবনের ধার দিয়া দৌড়াতে দৌড়াতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম. উইঠ্যা দেখি আমার সামনে ‘ও’ দাঁড়ায়ে আছে। বললাম, ও টা কে? মুচকি হেসে বলল, আমি ওকে ভালবাসতাম। ওর নাম কাশেম । আমাদের পাশের গ্রামে বাড়ি। আফা হুনেন, কত যে ভালবাসতাম ওকে। কাশেমও আমাকে খুব ভালবাসত। বললাম, বল হুমড়ি খেয়ে যে পড়ে গেলে তার পর কি হল। আফা যে কি কন? আমার জন্য লিপিস্টিক, চুরি, মালা, চুলের ব্যান্ড আমার হাতে তুইল্যা দিল। আমি কি যে খুশী। ঐদিন সারা বিকাল আমরা কাঁশ বাগানের ধারে বইস্যা কত কথা যে কইছি। ও কইছিল সামনের মাসে আমাগো বাড়িতে বিয়ার পয়গাম পাঠাইব। এক বুক নিঃস্বাস ছেড়ে বলল হায় রে পয়গাম। মনের আশা মনেই রইল।
৩
আমাগো বাড়ি কুমিল্লা। বললাম কোন উপজেলা, কোন গ্রামে তোমার বাড়ি। বলল আফা আমারে এইড্যা জিজ্ঞাস করবেন না । আমি কমু না। ঘাড় নেড়ে বললাম, ঠিক আছে তুমি বলে যাও। আমরা খুব গরীব। ৫ বোন, ১ভাই। ভাইটি সবার ছোট। বড় ৩ বোনের বিয়া হইয়া গ্যাছে। কিন্তু ২ বোন স্বামীর অত্যাচারে এখন আমাগো বাড়ী আইয়া রইছে। বাবা পরের বাড়ী কামলা দেয়। মা আর বড় দুই বোন বাড়ি বাড়ি কাম করে। কোন রকমে সংসার চলে। একবার পাশের গ্রামের রহিম চাচা বাবারে আইস্যা কইল, তোমার নাসরিনরে গার্মেন্সের কামে দিবা। বেতন ভাল। আমাগো গ্রামের ফুলকিও গার্মেন্সে গ্যাছে। ও কামে গ্যালে ওর লগে এক সাথে থাকতে পারবো। কথাডা শুইন্যাই আমার বুকের মধ্যে ধক্ ধক্ করতে লাগলো। আমি কাশেমরে রাইখ্যা কোন জায়গায় যামু না। আমি মারে কইলাম, আমি না খাইয়্যা থাকুম , তাও আমি যামু না। কিন্তু আমার দুই বোন, মা, বাবা সবাই আমারে বুঝাইতে লাগলো। রহিম চাচা রোজ আমাগো বাড়ি আসে আর বাবা মার সাথে ফুসুর ফুসুর করে। রহিম চাচা মারে কইল, পরশুদিন নাসরিনরে রেডি কইর্যা রাখবেন, আমি ঢাকায় নিয়া যামু। কোন চিন্তা নাই, আপনার নাসরিন খুব ভাল থাকবো।
৪
আমার হাতে আর মাত্র ১ দিন। আমার কথার কে দাম দিব। ঐদিন কাশেমরে যাইয়া কইলাম। কাশেম আমারে আদর কইর্যা কইল। নাসরিন তোরে ছাইড়্যা থাকতে আমারও কষ্ট অইব। আমিও ট্রাক এর হেলপার । এখন তুই যদি ঢাকা যাস, আমিও ঢাকায় যাইয়া ট্রাকের হেলপারের চাকরী নিমু। তুই ঢাকায় যা, দুইমাসের মধ্যেই তো আমি তোরে আমার বউ কইর্যা ঘরে আনুম। হায়রে আফা , ঘর আর করা হইল না। ও আমারে কাঁশবাগান হতে দুইড্যা কাঁশ ফুল ছিড়্যা একটা আমার চুলের খোপায় পড়ায়ে দিল, আর একটা দিয়া আমার গলায় মালার মত কইর্যা জড়াইয়া দিল। নাসরিন চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারছিল না। অনেকক্ষণ ডুকরে ডুকরে কাঁদলো। আমি নাসরিনকে বাধা দিলাম না। কারণ এই কাঁদার ভিতরও একধরণের সুখ আছে। প্রিয়জনকে মনে করার সুখ। একটু পরে একজন পার্টিসিপেন্ট এসে বলল নাসরিন ক্লাসের সময় হয়ে গিয়েছে। নাসরিন চোখ মুছে বলল আফা আমার ক্লাস শেষ হলে আবার আপনেরে সব কমু। আমি ওকে আচ্ছা বলে কম্পিউটার চালু করলাম।
৫
বিকাল পাঁচটার সময় নাসরিন যথারীতি আমার কাছে এল। ছটফটে দুষ্ট প্রকৃতির মেয়ে। বলল, আফা আফনেরে আমার খুব ভাল লাগতেছে। আমি হেসে বললাম, যারা খুব ভাল তারা সবাইকে ভালবাসে। নাসরিন তারপর তোমার কি হল, আমি সব কথা শুনবো। নাসরিন বলে চলল। আফা বাড়িতে মা আমার জন্য ক্ষীর, পিঠা বানাইল, বাবা একটা বড় দেইখ্যা ইলিশ মাছ আনলো। সবাই মিল্যা খাইতে বসলাম। কতদিন পরে যে এত ভাল খাওয়ন খাইলাম আফা। অভাবের সংসার, একবেলা খাইতো, আরএক বেলা না খাইয়্যা থাকি। আমার বাবা আমার জন্য না জানি ধার কইর্যা ইলিশ মাছ আনছে কে জানে। মনে মনে কইলাম , আমি তোমাগো ঠিক গোসত দিয়া ভাত খাওয়ামু। তোমাগো সব ধার শোধ করুম। আমার ছোড বোন বলল, তুই আমার জন্য একটা বাসনা সাবান আর একটা লাল জামা ঢাকা হইতে আনবি। আমি আমার বোইনের মাথায় হাত রাইখ্যা কইছিলাম, তোর জন্য আমি লাল জামা আনুম। সবার ছোট ভাইট্যা কইল, তুই আমার জন্য একটা বল আনবি। লালু বল খেলে, আমি খেলতে চাইলে আমারে লালু খেলতে নেয়না। আমি কইলাম ঠিক আছে সব আনুম। বেলা মাথার উপর হতে গড়াইয়া গেছে। রহিম মিয়া বাড়িতে আইস্যা বাবাকে ডাক দিল। আমার বুকের মধ্যে কেমন যে লাগতেছিল গো আফা, তা আপনেরে কি কইর্যা কই। মা একটা টুপল্যা আইন্যা আমার হাতে দিল। কইল এডার মইধ্যে মুড়ি, গুর আর নাইর্যালের নাড়– আছে। তোর দুইড্যা জামা এর মধ্যে আছে। আমি তোর জন্য একট্যা নাল দেইখ্যা গামছা কিন্যা এর মইধ্যে ভইর্যা দিছি। মার সেই লাল গামছাটা আফা এখনো আমার কাছে আছে। ওই গামছাটার মধ্যে এখনো আমি মার গদ্ধ পাই। বেলা পশ্চিমে হেইল্যা গেলে বাড়ি হইতে ঢাকার দিকে রওয়ানা হইলাম। আমার বাবা, মা, বোন অনেক দূর পর্যন্ত আগাইয়্যা দিল। একটু দূরে খেঁজুর গাছের তলায় কাশেম দাড়াইয়া আছে। আমার কাছে আইলো। আমার হাতে একট্যা বড় প্যাকেট ধরাইয়্যা দিল। আমি নিলাম। বুকে জড়াইয়া ধরলাম। কইলাম আমার জন্য দোয়া কইরো। রহিম মিয়া তখন একটু দূরে আগাইয়্যা গেছে। হাঁক দিয়া কইল, নাসরীন তারা তারি আয়। একটু পরেই সন্ধা নাইম্যা যাইব। হাটতেছি আর ওর দিকে তাকাইয়্যা তাকাইয়্যা দেখতেছি।
৬
আফা ফার্মগেটের একটা টিনের বাসায় উঠলাম। ছোড একটা ঘর, তার মধ্যে ফুলকি, পরি আর লতা থাকে। ওরা সবাই আমার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করলো। ডাল ভর্তা দিয়া রাতে ভাত খাইলাম। রাতে ওগো সাথে ঘুম আসলাম। সকালে কাশেমের প্যাকেটডা খুইল্যা দেখলাম, ওইড্যার মধ্যে একডা সাবান, লিপস্টিক, তেল, আর একটা মেরঝেন্ট্যা রংয়ের শাড়ি, বিলাউজ আর পেডিকোড। আমার কান্না আইল। দুইদিন এভাবে থাকলাম। পরের দিন ঘরে একড্যা খারাপ ব্যাডা আইল। পরীর সাথে কি সব বাজে বাজে কথা কইল। আমার দিকে আড়ে আড়ে তাকায়, আর খারাপ খারাপ কথা কয়। পরীর শরীরে হাত দেয়। আমি ঘর হতে বাইরে আইলাম। লতা কইল আমি গোয়ালন্দ আমাগো বাড়িতে যাইতেছি। তিনদিন দিন পরে আসুম। লতা চইল্যা গেল। ফুলকি আর পরীও আজ রাতে ঘরে আইল না। আমার ডর করতে লাগলো। রহিম মিয়া আইল। কইল কিরে নাসরিন তোর ডর লাগতেছে। ডর করিস না। তোর চাকরির জন্য যোগাযোগ করতেছি। সাতদিনের মধ্যে তোর চাকরিটা পাকা হইয়্যা যাইব। তখন তোর সাথে আর লাগে কিডা। রহিম মিয়া কইল আজ এখানে থাকুম। আমি কইলাম এখানে থাকবেন? রুম তো মাত্র একটা। সে কইল আরে ওইধারে একটু শুইয়া থাকুম। রাতে শুইয়া আছি, রহিম মিয়া আমারে জড়াইয়া ধরল। আমি চিৎকার দিয়া উঠলাম। আমার মুখটা সে চাইপ্যা ধরলো। কইল তুই এমন করলে তোরে চাকরিও দিমু না আর খুন কইর্যা ফ্যালামু। আফা শরীরটা আমার ব্যাথা হইয়া গেল। শেষ রাতে একটা লোক আইল, রহিম মিয়ার হাতে এক বান্ডিল টাকা দিল। লোভী দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইল। হাসলো, বললো তোমার চাকরী হইয়্যা গেছে। রহিম মিয়া অনেক দিন পর একটা খাসা মাল আনছো। গায়ের রং ফর্সা, চেহারা শ্রীদেবীর মতো দেখতে। আমার আর তর সইতেছে না। আরো যে কত কথা কইল আফা। কিন্তু আমার শরীর স্পর্স করলো না। সকালে ফুলকি আগে ঘরে আইল। রহিম মিয়া কইল, ফুলকি সাতদিন পর নাসরিন চাকরীতে যোগ দিব। ওরে দেইখ্যা রাখবি। এই ব্যইল্যা রহিম মিয়া চইল্যা গেল।
৭
লতা তিনদিন পর বাসায় ফির্যা আইলো। কইল, নাসরীন আমার মার খুব অসুখ। তাই কাইল আবারও যাইতে হইবো। কিছু টাকা র্যাইখ্যা গেছিলাম। তাই নিবার আইছি। তুই যাবি আমাগো বাড়ি? আমি দুইতিন দিন পরই চইল্যা আসুম। আমি রহিম মিঞা আর ঔ ব্যাটার কথা মনে করলাম। ভাবলাম লতার সাথে গেলেই আমার ভাল হইবো। আমি ওর সাথে চইল্যা গেলাম। উঠলাম একটা বাড়িতে। একজন মহিলাকে দেখলাম বিছানায় শুইয়া আছে। লতা আমারে খুব যত্ন কইর্যা খাইয়াইলো। লতা আমার ছবি তুললো। একসাথে বিছানায় শুইলাম। মাঝ রাতে ঘুম হতে জাইগ্যা দেখি লতা বিছানায় নাই। একজন লোক আমার পাশে, আমারে জড়াইয়া শুইয়া আছে। আমি ধরফরাইয়্যা উঠলাম। আমারে জোড় কইরা জড়াইয়্যা ধরলো, আমি কিছুতেই ছাড়াইতে পারলাম না। আমার মুখটারে জামা দিয়া বাইন্ধা দিছিলো। তারপর আমারে জোর কইর্যা কিসব করল। আমি কানতে লাগলাম। একটু পর লতা আইল। আমার সাথে ঠাট্টা কইর্যা কইল, কিরে ঘরে কি নাগড় আইছিল? আমি কি করুম বুঝতে পারতেছিলাম না। ব্যাডা নাসরিনের হাতে দুইট্যা ১০০ টাকার নোট গুইজ্যা দিয়া চইল্যা গেল। আমি লতারে কইলাম আমি সকালে ঢাকা চইল্যা যামু। লতা কইল তুমি যাইবা বইল্যা তো তোমারে এখানে আনি নাই। তোমার আর যাওয়া হইবো না। ফার্মগেটে যে লোকটা আইছিল পরের রাতে সেইলোকটা আইল, আমার সাথে রাতে থাকলো, যাওয়ার সময় কইল বেশি তেরিবেড়ি করবি না। তেরিবেড়ি করলে মাইর্যা ফালামু। এভাবে ১০ দিন থাকলাম। বিশ্বাস করেন আপা আমার শরীরে এতটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছিল না । তারা আমারে ডাক্তারের কাছে নিয়া গেল। ঔষধ খাইলাম, ভাল হইলাম। তারপর গোয়ালন্দের পতিতা পল্লীতে আমারে নিয়া আইলো…এরপর থিক্যা এখানে আছি।
৮
লতা আমারে নাচ, আর সিনেমার কয়েকটা গান শিখাইয়া দিল। আফা এখন আর খারাপ লাগে না। আজ ৮ বছর ধইর্যা আমি এখানে আছি। আপাগো আমি এখন নিজেই একটা ঘর ভাড়া নিছি। নিজের স্বাধীনমতো থাকি । আপা কোন কোন দিন ১৪/২০ জন লোক আমার সাথে থাকে। আমারে নাকি তাগো ভালো লাগে। কেউ ৫০০ টাকা, কেউবা ১০০ টাকা,৫০টাকা আবার কেউ ১০ টাকা দেয়। আফা ছাত্ররাও আমার কাছে আসে। এই দেখেন মোবাইলে তার ছবি আছে। আমি ইচ্ছে করেই ছবিটা দেখলামনা। নাসরিন বলে চলল, ফরিদপুরের একটা কলেজে পড়ে। আফা ওরে আমি বিশ্বাস করি। ওর কাছে আমি ৫ ভরি স্বর্ণ, ৪০ হাজার টাকা দিছি। ওর কাছে জমাইতেছি। ও কইছে, আমারে বিয়া করবো। আমি নাসরিনকে বললাম, তুমি সর্বনাস করেছো। ওই ছেলেটার কাছ থেকে ছলে বলে কৌশলে এসব তুমি নিয়ে নাও। নাসরিন তোমাকে ছেলেটা কোন দিন বিয়ে করবে না। শুধু এসব নিয়ে একদিন ভাগবে, তুমি টেরও পাবে না। তুমি একবার ঠকেছ। আর নিজেকে ঠকিও না। অবাক হয়ে বলল, কি কন আফা! ও আমার সাথে রোজ ৩ / ৪ বার করে মোবাইলে কথা কয়। আমি নাসরিনকে আবারও বুঝালাম। নাসরীন শুধু আমার দিকে তাকায়ে কি যেন ভাবল।
৯
নাসরিনকে বললাম তোমার কাশেম এর কথা মনে হয় না। মনে হয় না আবার আফা , খুব মনে হয়। ওর শাড়িটা এখনো যত্ন কইর্যা রাইখ্যা দিছি। সবার কথা মনে হয়। মাঝে মাঝে কান্দি। কি করুম আফা এসবই আমার কপালে ছিল। আফা আফনের কথাও খুব মনে থাকবো। আমি আবারও বললাম, নাসরিন তুমি তোমার সম্পদ ওই ছেলেটার নিকট হতে তোমার কাছে নিয়ে নিবে। তুমি টাকাগুলো ব্যাংকে রাখ। ওর মাথায় স্বস্নেহে হাত দিয়ে বললাম, এপথ হতে ফেরা যায় না! নাসরীন তখন দূরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চোখের পানিতে ওর সুন্দর গাল দুটো ভিজিয়ে দিল। আমি পরম মমতায় ওর চোখের পানি মুছে দিলাম। কিন্তু কোন কথাই আর বলতে পারছিলাম না।
১০
প্রশিক্ষণের শেষ দিনে নিষিদ্ধ পল্লীতে ফিরে যাওয়ার সময় নাসরীন আমার কাছে এল, বলল আফা আমি এই খারাপ পথ হইতে ফিরা আসুম। সবাই যেমন থাকে আমিও থাকুম। গার্মেন্সে চাকরী নিমু। আর নিজেকে ঠকামু না। আর ওই ছেলেটার কাছ হতে সব জিনিস ফিরাইয়্যা আনুম। এই বলে আমার পা ছুয়ে ছালাম করলো। আমি ওকে বললাম কি করছো নাসরীন। পা ছঁয়ে ছালাম করতে হবে না। তুমি ভাল থাক এটা আমি চাই। তবে নিজেকে কখনোই খারাপ ভাববে না। তুমি একটা মিষ্টি , সুন্দর আর খুব ভাল একটা মেয়ে। তোমার ভবিষ্যৎ সামনে পড়ে আছে। নাসরিন সামনের দিকে পা বাড়ালো। নাসরীনের চলার পথে চেয়ে শুধুই ভাবতে লাগলাম, হায়রে সমাজ! মেয়েরা পতিতাবৃত্তি করলে সমাজ তাদের ডাকে পতিতা…..ছেলেরা এসব কাজ করলে কেন সমাজ তাদের পতিত বলে ডাকে না??? বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ব্যাথা করে উঠলো। আমি মিটিংএ যেয়ে বসলাম। কিন্তু কিছুতেই মিটিংএ মন বসাতে পারলাম না। মনের ভেতর শুধু হাজারও প্রশ্ন দাপাদাপি করতে লাগলো।
২৫ অক্টোবর,২০০৯
৩৪টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
সহজ ভাবে প্রকাশ করলেন একটি মেয়ের অব্যক্ত কথগুলো।
যতই পড়ছিলাম নাসরীনের প্রতি গভীর মমতা এসে যাচ্ছিল
সম্পুর্ন পড়ে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।
মেয়েরা এসবে ইচ্ছে করে আসেনা
পুরুষরা বাধ্য করে মেয়েদের এসবে জড়াতে
পুরুষের কিছুই হয়না
মেয়েরা হয়ে যায় পতিতা।
স্বপ্ন নীলা
জিসান ভাই ওর সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন আমার মনে খুবই কষ্ট হচ্ছিল —- আসলেও মেয়েরা ইচ্ছ করে এ পথে আসে না — পরিস্থিতি বাধ্য করে —–
ভাল থাকবেন সব সময়
বনলতা সেন
এমন অজস্র ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটছে। কখনও কখনও মনে হয় এ সভ্যতার অভিশাপ।পৃথিবী নাকি জ্ঞানে বিজ্ঞানে এগিয়ে চলছে?
তাহলে এই অভিশাপ কেন আমরা বহন করছি ?
স্বপ্ন নীলা
আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি — কিন্তু মনে আমাদের রয়ে গিয়েছে ঠিক আগের মতেই — প্রকৃত শিক্ষা এবং সচেতনতাই আমাদেরকে মুক্ত করতে পারে — তাছাড়া নয় —–
ভাল থাকবেন আপু
মোঃ মজিবর রহমান
হুম। এভাবেই নষ্ট হয় আমার আপনার পাশের সহস সরল মানুস গুল।
সেন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন,
স্বপ্ন নীলা
ঠিক বলেছেন — এভাবেই আমাদের চারপাশ নষ্ট হয় —– ভাল থাকবেন নিরন্তর
মোঃ মজিবর রহমান
আপনিও ভাল থাকুন
স্বপ্ন নীলা
অনেক অনেক শুভকামনা রইল ——–
ব্লগার সজীব
আপু, লেখাটা পড়ে কষ্ট পেলাম খুব। কিভাবে নাসরিনের মত একজন গ্রামের সহজ সরল মেয়ের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। আপনি এদের জন্য কাজ করছেন, আপনার প্রতি অনেক শ্রদ্ধা আপু।
স্বপ্ন নীলা
বাস্তব খুবই কঠিনরে ভাইয়া —এভাবে নাসরিনের মত মেযেদের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় ——-
আমি তখন শিশুদের নিয়ে কাজ করতাম ভাইয়া —
লেখাটা পড়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল
আগুন রঙের শিমুল
.
স্বপ্ন নীলা
হুমমম — উত্তরটা আমি পেয়ে গিয়েছি ভাইয়া — শুভকামনা রইল — ভাল থেক নিরন্তর ——–
শুন্য শুন্যালয়
খুব কাছ থেকে ওদের দেখেছি আপু। HIV প্রোগ্রামে কাজ করেছি ওদের সাথে। লেখাটা পড়ে অনেক কিছুই মনে এসে গেলো। খুব সুন্দর করে লিখেছেন আপু। নাছরিনদের সবার গল্পই হয়তো এক। কস্টগুলো যার যার।
স্বপ্ন নীলা
ঠিক বলেছেন আপু । নাসরিনদের সবার গল্পই এক — কষ্টগুলো শুধুই আলাদা ——-খুবই খারাপ লাগে —
ভাল থাকবেন আপু
ছাইরাছ হেলাল
স্বপ্ন নীলা
ভাইয়া আপনার মন্তব্য হতে অনেক বিষয় জানতে পারলাম –ঠিক তাই রাষ্ট ওদের জন্য কোন দায়ই নেয় নাই সেই বৃটিষ আমল থেকেই — কোন কোন এনজিও ওদের নিয়ে কাজ করছে তাও আবার স্বল্প পরিসরে—
ওদের জন্য কষ্ট হয়, ওদের শিশুদেরকেও এ পথে আসতে বাধ্য করা হয়, কারণ পরিবেশই বাধ্য করে —
ওদেরকে ফাঁদ ফেলে এ পথে পা ফেলতে বাধ্য করা হয় — কি নির্মম !! ভীষণ খারাপ লাগে —
আন্তরিক ধন্যবাদ ভাইয়া, ভাল থাকবেন নিরন্তর
অলিভার
গ্রামের সহজ সরল পরিবার থেকে এভাবেই অনেক নাসরীন’কে নিয়ে আসা হয় স্বপ্ন দেখিয়ে। আর তারপর….
বাস্তবতা এতটা নির্মম যে তাদের সম্মান তো রক্ষা করতেই পারেই না উল্টো নামের পূর্বে পতিতা শব্দটি লেগে যায়, যেখানে শব্দটা লাগার কথা ছিল অন্য কারো নামের আগে।
স্বপ্ন নীলা
তাদেরকে আমরা পতিতা বলে ডাকি !! কিন্তু কখনো ভাবি না যে তারা কেন এই পথে পা বাড়ালো !!! তাদের পুনর্বাসনের কোন ব্যবস্থা নেই — তাদের জীবনযাত্রা খুবই বেদনাবিধুর !!
আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল
নুসরাত মৌরিন
লেখাটা পড়ছিলাম মগ্ন হয়ে।পড়তে পড়তে মনটা এত খারাপ হয়ে গেল!! 🙁
নাসরীনরা কি কখনো ফিরতে পারে ?এটা কেমন সমাজ আপু, মেয়েদেরই দিকে শুধু আঙ্গুল তুলে কিন্তু একটা মেয়ে কি পতিতা হতে পারত যদি না পিশাচেরা রাতের অন্ধকারে ওদের দেহের রক্ত মাংসে উল্লাস খুঁজত?এই প্রশ্ন কেউ রাখে না!!
যুগে যুগে নাসরীনদের তাই আর আলোতে আসা হয় না…ঐ অন্ধকারের আড়ালেই থেকে যায় ওদের দুঃখ জাগানিয়া ভোর গুলো!!
স্বপ্ন নীলা
আপু আপনার মন্তব্য পড়ে ভীষণ ভীষণ ভাল লাগলো— ভীষণ গঠণমূলক মন্তব্য ——-
এমন একটি সমাজেই আমরা বাস করছি আপু — যে সমাজ আমাদের নারীদের দিকেই শুধুমাত্র আংগুল তোলে — নাসরীনরা হারিয়ে যায় অন্ধকার জগতে ——-
ভাল থাকবেন আপু
লীলাবতী
সত্য ঘটনা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো আপু। কত কষ্ট পেয়েছে এতটুকু নাসরীন । সব কিছুর জন্য এই দায়ী নাসরিনরা। নাসরীনের পাশের গ্রামের সেই চাচা, দেখা যাবে সমাজে তার ভালোই অবস্থান। অথচ সেই নাসরীনকে পতিতা বানিয়েছে। একটু বিবেকেও বাধে না এই নরপশুদের মেয়েদের এপথে আনতে। নাসরীন ফিরে পাক তার বহু কান্নায় অর্জিত স্বর্নালংকার আর টাকা। ফিরে পাক তার স্বাভাবিক জীবন।
স্বপ্ন নীলা
ঠিক তাই আপু —— নাসরীন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে কিনা জানি না —–তবে মন হতে দোয়া করি নাসরীন তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক ——-
ভাল থাকবেন আপু
মিথুন
আমরা যারা তাদের কাছ থেকে দূরে থাকি, তাদের কাছে সে পতিতাই। নর্দমার মতো ও পথ এড়িয়ে যাই, ভাবনা তাদের কস্ট নিয়ে, সেতো অনেক পরের কথা।
স্বপ্ন নীলা
আমরা শুধু জানি তারা পতিতা — কিন্তু কেন সে এই পথে এসেছে — তাদের জীবন কেমন চলছে — এটা নিয়ে আমাদের ভাববার অবকাশ নেই —– আমরা নারীদেরকেই শুধু দোষ দিয়ে যাচ্ছি — কিন্তু আর কত ——–
আর কোন নাসরীনের জীবন যেন এমন না হয়
শুভকামনা রইল
মেহেরী তাজ
এতো সহজ ভাবে এতো বড় একটা ব্যাপার উপস্থাপন করেছেন দেখে ভালো লাগলো।
স্বপ্ন নীলা
আন্তরিক ধন্যবাদ আপু — ওরা নিজেরাই এ পথে আসে না —-ওদেরকে বাধ্য করা হয় এ পথে পা বাড়াতে — ভাল থাকবেন নিরন্তর
খসড়া
কিছু কি বলার আছে?
স্বপ্ন নীলা
কিছুই বলার নেই আসলে — কিই বা বলবো !! শুধুমাত্র কষ্ট পাওয়া ছাড়া —!! তারপরও আশার বিষয় অনেক বেসরকারী সংস্থা এখন ওদের নিয়ে কাজ করছে যাতে ওদের শিশুদের পড়ালেখা হয় এবং তাদের স্বাস্থ্য ভাল থাকে — এবং ন্যায্য পাওনাটা যাতে পায় —
কেউই তাদের পুণর্বাসনের কথা বলে না — আফসোস
ভাল থাকবেন নিরন্তর
নীলাঞ্জনা নীলা
নারী, যত যন্ত্রনা, ক্লেদ, কষ্ট সবই তোর জন্য। মুক্তি নেই মনে হয় আর। নাসরীনের কান্না স্পর্শ করে গেলো আপু।
স্বপ্ন নীলা
নারীর মুক্তি !! দিনকে দিন আরো জটিলতার ভেতর আরো প্রবেশ করছে — পুরুষতন্ত্র তার খোলস পাল্টিয়ে এখন নতুন রূপ ধারণ করেছে — খুবই খারাপ লাগে
নাসরিনদের জন্য শুধুই মনের ভেতর কষ্ট লাগে —
ভাল থাকবেন আপু
আম্মানসুরা
এই জাতীয় ঘটনা গুলো খুব বেশি পীড়াদায়ক। সহ্য করা যায় না।
স্বপ্ন নীলা
ঠিক বলেছেন — এ জাতীয় ঘটনাগুলো খুবই কষ্টের —
আর যেন কোন নাসরীন এই জালে জড়িয়ে না পড়ে
শুভকামনা রইল আপু
প্রজন্ম ৭১
কি মন্তব্য করা যায় এমন লেখায় ? সমাজের একটি বড় ক্ষত এটি। আর এই ক্ষত আমরাই তৈরী করেছি।
স্বপ্ন নীলা
ঠিক তাই — আমরা এই ক্ষত তৈরি করেছি — আর তাই আমাদের এখন হতে সতর্ক হতে হবে যে আর কোন মেয়ে যাতে এই ধরণের প্রতারণার শিকার না হয় —–ফাঁদে না পড়ে —-
আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল