ছবিঃ দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ – অব্রে মেনন
২৩ জুলাই, ১৯৭২ / দ্য নিউইয়র্ক টাইমস।
পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম যে কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়েছিল পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। তার মধ্যে অন্যতম হল নির্বিচারে বাঙ্গালী নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন। যা আজো মানবতার ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। আব্রে মেননের ২৩ জুলাই, ১৯৭২ / দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। এর একটি লিখা পেয়ে পড়তে থাকলাম, আর শিউরে উঠতে থাকলাম। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী নারিদের উপর পাকিস্তানি নরপিশাচদের অত্যাচার এবং যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। পরে আরো খুঁজে ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির কিছু তথ্য পেলাম। আমার জানামতে পৃথিবীর কোন ভাষায়ই এই বর্বরতার কথা লিখা সম্ভব না। তবুও দিলাম সোনেলার জন্য।
পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালি নারী ধর্ষণে দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করতোঃ
১. উপস্থিত ধর্ষণ।
২. যৌনদাসী।
* উপস্থিত ধর্ষণঃ
পাকিস্তান আর্মি, বিহারি, রাজাকার ও দালালরা অধিকৃত বাংলাদেশের শহর-গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে/এলাকায় আক্রমন করে খুন-লুটপাটের সাথে সেখানেই নারীদের ধর্ষণ করতো।
পাকিস্তানি ও দালালরা রাস্তা থেকে বা কোন জায়গা হতে বাঙালি নারীদের তুলে নিয়ে ধর্ষণ করতো।
নিখোঁজ-গ্রেফতারকৃত পরিবারের সদস্যদের সন্ধানে ও বিপদে পড়ে যারা পাকিস্তান আর্মি-বিহারী ও দালালদের কাছে সহযোগিতা চাওয়ার জন্য যেতো; তাদের অনেককে ধর্ষণ করা হতো।
ধর্ষণ শেষে নির্যাতিতদের কাউকে হত্যা করা হতো, কাউকে ছেড়ে দেয়া হতো।
একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য, উপস্থিত ধর্ষণের শিকার যারা হয়েছিলেন, তাদের যৌনদাসী করা হয়নি; মানে দীর্ঘদিন ধরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়নি। একাত্তরে মোট নির্যাতিত নারীর শতকরা ৭০ ভাগ উপস্থিত ধর্ষণের শিকার।
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির হিসেবে, উপস্থিত ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা প্রায় ৩,২৭,৬০০ জন। এদের প্রায় ত্রিশ ভাগ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন।
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি আরো জানাচ্ছে, অধিকৃত বাংলাদেশে প্রতিদিন উপস্থিত ধর্ষণে গড়ে ৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য অংশগ্রহণ করেছিল এবং প্রায় ৬,০০০ বিহারি ও দালাল পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছিল ও সহধর্ষক হিসেবে ছিল।
* যৌনদাসীঃ
যৌনদাসী পদ্ধতিতে নারীকে দীর্ঘদিন বন্দী রেখে ধর্ষণ করা হয়।
পাকিস্তান আর্মিরা তাদের ক্যাম্পগুলোতে এসব নারীদের বন্দীদের করে রাখতো এবং দিনের দিনের পর গণধর্ষণ করতো।
এই বন্দিনী নারীদের কোন পোশাক পড়তে দেয়া হতো না, যাতে ওরা পালিয়ে যেতে বা আত্মহত্যা না করতে পারে।
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি জানাচ্ছে,
পাকিস্তানিরা যৌনদাসী পদ্ধতিতে প্রায় ১,৪০,৪০০ জন নারীকে নির্যাতন করেছিল এবং এদের ৮০ ভাগই গর্ভধারণ করে।
বন্দী এসব নারীদের চল্লিশ ভাগ যুদ্ধের সময় খুন হয়, অতিরিক্ত ধর্ষণে মারা যায় ও আত্মহত্যা করে।
পাকিস্তানিরা পরিকল্পিতভাবে বাঙালি নারীদের বন্দী করে ধর্ষণ করতো, যাতে তারা পাকিস্তানিদের সন্তান গর্ভধারণ করেন।
বাঙালি নারীদের ধর্ষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানিরা তাদের লালসা চরিতার্থ ও বাঙালি জাতির প্রতি ঘৃণার চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ করে।
পাকিস্তানিরা ভাবতো এতে করে বাঙালি জাতিকে তারা জাতিগত ধোলাইয়ের মাধ্যমে বিশুদ্ধ করছে। এবং পাকিস্তানিরা এবং এদেশে তাদের দোসর-রাজাকার, আলবদররা, পাকিস্তানিদের এই নিশংসতাকে ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদ হিসেবে প্রাচার করে অনেক মানুষকে বিভ্রান্ত করে গঠন করে তাদের এদেশিয় বাহিনি।
একাত্তরে বাঙালি নারীর প্রতি যে সহিংসতা পাকিস্তানিরা করেছে, তা মানব ইতিহাসে নজিরবিহীন…
মানবসভ্যতার ইতিহাসের ভয়ংকরতম অপরাধগুলোর একটি সংঘটন করার পরও বাঙালির একটি বড় অংশ শুধুমাত্র ধর্মীয় কারনে মানবতাবিরোধী অপরাধী পাকিস্তানকে সমর্থন করে যায়…
ছবিঃ ঢাকার ইসলামপুরে মিশনারিজ অব চ্যারেটিজ-এর মাদার তেরেসা যুদ্ধশিশু ক্যাম্পে ২১ জন যুদ্ধশিশু। (১৯৭২)
মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তান জিহাদ তথা ধর্মযুদ্ধ হিসেবে দেখতো, প্রমাণঃ
http://www.dawn.com/news/1151200
তথ্য সুত্রঃ লিবারেশনওয়ার বাংলাদেশ আর্কাইভ থেকে। একজন মানুষকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারিনাঃ তিনি সাব্বির ভাই, যিনি ই আর্কাইভের দায়ত্বে নিয়োজিত থাকে। সংবাদ এবং সাংবাদিকতার প্রয়োজনে যতবার গেছি, তিনি ততবার আমাকে এক্সেস দিয়েছেন। সহযোগিতা করেছেন জানতে। কোথায় কোন ব্যাপারটা পাওয়া যাবে। সাথে থেকে দেখিয়ে দিয়েছেন। উনি কথা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের যে ভাষন আছে তা আমাকে একদিন শুনতে দিবেন, যেই ভাষনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দূড় কন্ঠেই বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধিদের বিচার হবেই, তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন কোন কোন অপরাধ থাকলেই কেবল সাধারন ক্ষমা পাবে আর কোন কোন অপরাধের জন্য শাস্তি পেতে হবে এবং সেই যুদ্ধাপরাধীরা ক্ষমার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। আমি যদি সেটা পাই। কথা দিলাম সোনেলার সকলের জন্য, আমি সোনেলায় সেটা প্রকাশ করবো।
সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। শুভকামনা নিরন্তর।
১০টি মন্তব্য
অনিকেত নন্দিনী
মানবসভ্যতার ইতিহাসের ভয়ংকরতম অপরাধগুলোর একটি সংঘটন করার পরও বাঙালির একটি বড় অংশ শুধুমাত্র ধর্মীয় কারনে মানবতাবিরোধী অপরাধী পাকিস্তানকে সমর্থন করে যায়…
এদের বিবেকবোধ জাগবে কবে?
সীমান্ত উন্মাদ
জানিনা আপু। তবে এটা জানি দূঢ়ভাবেই জানি। একদিন জাগবেই আবার বাঙ্গালী।
অপার্থিব
ভাল লেখা। পৃথিবীর ইতিহাসে সকল যুদ্ধেই সবচেয়ে বড় নিপীড়নের শিকার হয়েছে নারী, আমাদের মুক্তিযুদ্ধও তার ব্যতিক্রম নয়। আমাদের এখানে প্রচলিত রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার কারণে যুদ্ধ শেষেও এই নারীদের দুর্দশার ইতি ঘটেনি, এটাই জাতি হিসেবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় লজ্জার ।
সীমান্ত উন্মাদ
ধন্যবাদ এবং শুভকামনা, বিবেক জাগ্রত হোক সকলের।
জিসান শা ইকরাম
৪লাখ ৬৮ হাজার নারী ধর্ষিতা হয়েছেন ঐ সময়।
শুধু মাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে এই অন্যায়কে হালকা করার চেষ্টা হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি পেতেই হবে, এদের ক্ষমা নেই।
1971, দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ-ওয়ারবেবিজ-অব্রে মেনন এর বইটা অনেক খুঁজেছি আমি, পাইনি।
সীমান্ত উন্মাদ
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ ডিজিটাল আর্কাইভ হচ্ছে। কাজ শেষ হলে সেখানেই পড়তে পারবেন। আশাকরি এই বছরের মাঝেই পাবলিকলি ওপেন করে দেওয়া হবে। শুভকামনা নিরন্তর।
ব্লগার সজীব
এসব ইতিহাস আমরা ভুলে গিয়েছি অথব ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাল লিখেছেন। আপনার সন্ত্রাসবাদের উপর লেখা তো আর পেলাম না।
সীমান্ত উন্মাদ
শুরুতেও তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি সজীব ভাই। আসলে ঐ লিখাটা লিখতে অনেক রিসার্চ এবং পড়তে হয়। আমি গত ৪ মাসে ন্যাশনাল ক্রাইম নিউজ কাভার নিয়ে এতো বেশি ব্যাস্ত, একই সাথে আরো একটি গুরুত্বপূর্ন কাজ করতে হচ্ছে। আরো কিছুদিন সময় লাগবে। তবে কথা যখন দিয়েছি, শেষ করেই যাবো। শুভকামনা জানিবেন নিরন্তর।
আর হাঁ আমাদের ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে, তবে কি জানেন, ইতিহাস ইতিহাসই, আর ইতিহাসের স্বীকৃত সত্যকে কোনদিন মুছে দেওয়া যায়না। যতচেষ্টাই করাই হোক, কেউ না কেউ আমাদের জানিয়ে দিয়ে যাবেন, যাচ্ছেন। আমরা জানছি, একে অন্যকে জানাচ্ছি।
তানজির খান
বারবার তথ্যবহুল এমন পোস্ট চাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। শুভকামনা রইল প্রিয় ব্লগার
সীমান্ত উন্মাদ
আপনার জন্যও অনেক অনেক শুভকামনা তানজির ভাই। আর এই যেন আমি ধন্য এবং কৃতজ্ঞ যে আমি আপনার প্রিয় তালিকায়। লজ্জাও পাচ্ছি, আমি খুব সাধারন ধুলিকনা টাইপ মানুষ ভাই। ভালোবেসে ভাই হিসেবে পাশে থাকবেন এতেই আমি খুশি।