★★জন্মদিন★★

মামুন ২০ জুন ২০১৬, সোমবার, ০১:৩৭:৪২অপরাহ্ন গল্প ৮ মন্তব্য

বাইরে পাখির কিচির মিচির। প্রতিদিন এই সময়েই ঘুম ভাঙ্গে সাদেকের। আলো-অন্ধকার এক সাথে হাত ধরাধরি করে চলে মনে হয় এ সময়টাতে। আলো আঁধারকে বাড়ি পৌঁছে দিতে যায়। সাদেকের এমন-ই মনে হয় প্রতিদিন।

বউটা এলোমেলো হয়ে নিচে কাঁথার ওপরে শুয়ে আছে। পাশে একমাত্র ছেলে। সে ও মায়ের সাথে কুন্ডলি পাকিয়ে রয়েছে। দু’জনের দিকে তাকিয়ে কেমন মায়ায় ভরে যায় অন্তরটা। কোনো কারণ ছাড়া-ই চোখ ভিজে আসে সাদেকের। ছেলে দশ বছরের। স্কুলে যায়।

মা-ছেলেকে হাজারো বলেও বিছানায় ওর সাথে তাদেরকে ঘুমাতে আনতে পারে না সাদেক। সারাদিন ঠেলাগাড়ি টেনে চলা সাদেককে এক রুমের ঘরটির একমাত্র আরামের বস্তুটিতে একটু আয়েশ করে ঘুমানোর সুযোগ জোবেদা কি ইচ্ছে করেই দেয়? পরের দিনটির জন্য ঢের সারা শক্তি সঞ্চয়ের জন্য-ই বুঝি।

ছেলে মায়ের ন্যাওটা।মা ছাড়া কিছু বুঝে না। রাত বাড়ে। ছেলে ঘুমায়। নীল জোছনায় চারদিক নীলাভ হয়ে এলে জোবেদা চোখ মেলে। সাদেক জেগে থাকে। দু’জন আরামের শয্যাটিতে একে অপরের নীল বেদনা ভাগ করে নেয়। বিত্তহীনদের জীবনের একমাত্র আনন্দবিলাস!

যৌথ রান্না ঘরটির একটু বাম দিক দিয়ে আগালে একেবারে শেষ প্রান্তে টয়লেট-গোসলখানা। সাথে চাপকল। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে এসে ঘরে ঢুকেই ছেলেকে বিছানায় বসা দেখে সাদেক। একটু অবাক হয়। কদাচিৎ ও এমন হয় না। ছেলে কখনো-ই এই সময়ে ঘুম থেকে উঠে না। মায়ের মত ছেলেও বড্ড ঘুমকাতুরে।

বাবার অবাক দৃষ্টি দেখে ছেলে হাসে। সাদেক কাছে যেয়ে ছেলের মাথার এলোমেলো চুল ঠিক করে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে,
‘ বাজান! অহন-ই ওঠলা যে? বাইরে এহনো আন্ধার। ঘুমাও আরো। আইজ ইশকুল আছে না?’
– না বাজান। আইজ স্কুলে যাবো না।
‘ তয় মায়’র পাশে যাইয়া ঘুমাও।‘

কাজে যাবার তাড়ায় সাদেক ছেলেকে ভালোভাবে দেখবার সময়ও পায় না। ঠেলাগাড়ি চালিয়ে রুজী-রোজগারের জন্য দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে সে। জোবেদা সাথের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকদের বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করে। ছেলেটা একা একা-ই বড় হয়ে যাচ্ছে। ছেলের সাথে সেই জুম্মাবার ছাড়া আর বলতে গেলে দেখা-ই হয় না তাঁর।

এই কাকডাকা ভোরে চলে যায়, অনেক রাতে ফিরে এসে দেখে ছেলে ঘুম।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠেলাগাড়ির তালার চাবি নিয়ে শার্টটা কাঁধে ঝুলিয়ে ঘরের দরোজা টেনে দেয়। ছেলে খাটে বসে থেকে নির্ণিমেষ দৃষ্টিতে বাবার চলে যাওয়া দেখে। ভেতরটা বাবার চলে যাবার সাথে সাথে আঁধার হয়ে যায়।
বাইরের আলো আঁধারকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে না ফেরা পর্যন্ত ছেলে একভাবে বসে থাকে। ঘুমন্ত মায়ের দিকে চেয়ে থেকে ভাবে-
‘ মা তো স্যারদের কোয়ার্টারে চলে যাবে কাজে। দুপুরের সময় একবার এসে ওকে খাইয়ে আবার বের হবে। আসবে সেই সন্ধ্যার একটু আগে। আর বাবার আসতে অনেক রাত… সে ঘুমে থাকবে তখন।‘

আজ ওর জন্মদিন। বাবা সেটা জানলেন না! স্কুলে অন্য বন্ধুদের জন্মদিনে কখনো কখনো সে ও গিয়েছে। কত আনন্দ করে ভালো ঘরের ছেলেরা। কত কত উপহার পায়। ওর বাবু মনে একটা আক্ষেপ ধীরে ধীরে অতৃপ্তিতে রুপ নিতে চায়। সেটা পূর্ণতা পাবার আগেই মায়ের পাশে আবার সে ঘুমিয়ে পড়ে। বাবু ভাবনায় একটা কথাই ঘুরপাক খেতে খেতে ওকে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে নিয়ে যায়-
‘আমার বাবা অন্যদের মত না কেন?’
… …
রাতে ঘুম থেকে বাবার ডাকে ছেলের ঘুম ভাঙ্গে। চোখ কচলে অবাক হয়ে বাবাকে দেখে। মায়ের হাসিমুখ। খাটের ওপর ছোট্ট একটা কেক। ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা মোমবাতি। ঠিক স্কুলের ভালো ঘরের ছেলেদের বাসায় দেখা জন্মদিনের দৃশ্যের মত! ওদের এই বস্তির এক রুমের বিবর্ণ কক্ষটি আজ বাবা-মায়ের চোখের আলোয় যেন ঝলমলে হয়ে উঠেছে! বাবা ওর হাত ধরে ওকে খাটের ওপরে বসাতে বসাতে বলেন-
‘ আইজ তোমার জন্মদিন বাজান!’
বাবার মুখের দিকে পরম মমতায় তাকিয়ে থেকে ছোট্ট বাবুটার বাবু মনে এই ভাবনা দোলা দিয়ে যায়-
‘আমার বাবা ও অন্য বাবাদের মত।‘

বাবুটা আরো একটু বুঝতে শিখে একদিন এটাও জানবে, ‘ পৃথিবীর সব বাবা-ই নিজেদের মত.. একই.. একজন বাবার মত!’

# মামুনের অণুগল্প

৬৩৯জন ৬৪০জন
0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ