বান্ধবীর মুখে আক্তার জাহানের কষ্টের কথা
“নিরন্তর যুদ্ধ করতে করতে, কারও সহায়তা না পেয়ে আকতার জাহান হতক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন!”
—– অধ্যাপক শাওলী মাহবুব।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহান জলিকে নিয়ে লিখা তাঁর ঘণিষ্ঠ বন্ধু ও সাবেক সহকর্মী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাওলী মাহবুব এর লেখাটি পড়ে আমার কেবলই মনে হলো, এতো শিক্ষাদীক্ষা অর্জন করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী মেয়েরাও কেনো এতো ভীতু, বোধহীন এবং ব্যক্তিত্বহীন মানুষ হয়?
জানি আমার এই কথাটাকে অনেকেই বাঁকাভাবে দেখবেন। কারণ, এই সমাজে বেশিরভাগ মানুষই নারীকে আকতার জাহান এর মতো দেখতে চায়।
সেই তো ঘর টিকলো না!
সেই তো ডিভোর্স নিতে হলো!
শেষপর্যন্ত বোকার মতো একটি সুইসাইডাল নোট লিখে নিজের জীবনটাই বিসর্জন দিতে হলো!!
তো দিয়ে কি লাভ হলো? কিছু কি আসলো গেলো তথাকথিত স্বামীটির? (স্বামী-স্ত্রী শব্দটি আমার কাছে প্রভু-দাসী রুপ মনে হয় এবং শাওলী মাহবুবের লেখা পড়ে আকতার জাহানের দাম্পত্য সম্পর্কের ধরণটি আমার কাছে এমনটাই মনে হয়েছে।) উলটো অপমৃত্যুর দুদিন যেতে না যেতেই প্রাক্তন স্বামীটি মৃত আকতার জাহানের চরিত্র হণন করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। আর তিনি কি করলেন? বিয়ে ভেঙে যাওয়ার চার বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও বিয়ে না করে ঘরভাঙার শোক উদযাপন করলেন। আহা নারী! তুমি কতো পতিব্রতা ছিলে! কিন্তু ফলাফল কি হলো? জিরো!!! এতো দুর্বল চিত্তের কেনো ছিলে তুমি? কেনো তুমি লাঠি ঝাঁটা খেয়েও স্বামীর ঘরে পড়েছিলে? তোমার কি ছিলো না? শিক্ষা? অর্থ? পরিপূর্ণ একজন মানুষের অবয়ব? কি ছিলো না তোমার? হ্যাঁ, তোমার একটা জিনিস ছিলো না। সেটা হলো ভেতরের শক্তি, আত্মশক্তি। তোমার মানসিক বৈকল্যই তোমাকে আজ আস্তাকুড়ে এনে ফেলেছে!
ভাবা যায়? শিক্ষিত, সুশ্রী, আর্থিকশক্তিতে বলীয়ান মেয়েটি শুধুমাত্র আত্মশক্তির অভাবে অতলে হারিয়ে গেলো!
জানলাম,
*তুমি উপার্জন করেছো ঠিকই, কিন্তু সেই উপার্জনের উপর তোমার ব্যক্তিগত অধিকার ছিলোনা স্বামীর অনুমতি ছাড়া তুমি তা খরচ করতে পারতে না।— কি হাস্যকর!
*বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে তুমি স্বামীর অনুমতি ছাড়া একাডেমিক কোন কাজে অংশ নিতে পারতে না।—হাউ ইট পসিবল?
*স্বামীর অনুমতি ছাড়া বাসায় কাজের সাহায্যকারী রাখতে পারতে না।—কি করে সম্ভব?
*বড় হাঁড়ি টানতে টানতে নাকি তোমার পিঠে তীব্র ব্যথা তৈরি হয়েছিলো; ভারত থেকে চিকিৎসা করে এসেও মুক্তি মেলেনি সেই ব্যথার। — এতো লোকলজ্জা তোমার? লোকে জানবে বলে চুপ ছিলে!
*পরিবারের মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে বলে পরিবার থেকে স্বামীকে তালাক দেয়ার অনুমতি মেলেনি।—সিদ্ধান্ত তোমার। পরিবার দায় নিবে কেনো? আর অনুমতিই বা দিতে হবে কেনো?
*আরো জানলাম, যৌতুক!
রেফ্রিজারেটর থেকে শুরু করে অনেক আসবাবই তোমার মায়ের বাড়ি থেকে আনা।— যে মেয়ে শিক্ষিত হওয়ার পরও কোন ধরনের প্রতিবাদ ছাড়া মায়ের বাড়ি থেকে যৌতুক নিয়ে স্বামীর বাড়ির মানুষকে খুশি করতে চায়, আমি বলবো তাদের আসলে কোন পারসোনালিটিই নেই। যদি থাকতো তো সেদিনকেই তুমি বুঝে যেতে আর বেঁকে বসতে।
*বন্ধুর ভাষ্য অনুযায়ী মা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে তুমি অনন্য হলেও একজন আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ তুমি মোটেই ছিলে না।
সমাজ তোমাকে আত্মহননে সহায়তা করেছে কতোটুকু সে বিচারে আমি যাচ্ছি না, তবে তোমার মানসিক বৈকল্য যে এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী সেটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি।
আকতার জাহানের বন্ধু লিখেছেন, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আকতার জাহান-এর যদি এতো দুরবস্থা হয়, তাহলে অশিক্ষিত আকতার জাহানদের অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়।
আমি বলবো, আকতার জাহান অক্ষর জ্ঞানে শিক্ষিত ছিলেন, কিন্তু স্বশিক্ষার মাধ্যমে মানসিক শক্তি অর্জন করতে পারেন নি। যা আমি অঁজপাড়া গায়ের অনেক মেয়ের মাঝেও খুঁজে পাই।
তাই বলবো,
হাজারো আকতার জাহানকে বাঁচাতে তাই, আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠা চাই।
মুক্ত করো ভয়,
আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।
১৯টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রথম কথা আমি আত্মহত্যাকে ঘেণ্ণা করি। আর যারা করে তাদেরকে তো আরোই। আত্মহত্যা কোনো সমাধান না। বরং যার উপর অভিমান করে আত্মহত্যা করে, তাদের বরং সুবিধাই হয়। আমি জানিনা যখন কেউ আত্মহত্যা করার চিন্তা করে তাদের মাথায় এ কথাটা কেন আসেনা?
রুবা’পু এমনও সময় গেছে এ জীবনে, অনেকেই অবাক হয়ে গিয়েছিলো কিভাবে আমি নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম! কিন্তু মাথায় কখনোও এমন আসেনি আর পারছিনা, এবার তবে শেষ করি সব। আমি বুঝে পাইনা কেন ভয় পায় এরা! ঠিক বলেছেন আপনি স্বশিক্ষা ছিলোনা আকতার জাহানের।
সবশেষে জানাচ্ছি ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক রুবা’পু। -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আমি নিজেও যে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি, তা নয়। জীবনে দু দু’বার আমাকে অনেক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিলো। ধৈর্য ধরে শক্তমনে সবকিছু মোকাবেলা করেছি বলেই না আজ শক্ত ভিতের উপর নিজেকে দাঁড় করাতে পেরেছি।
ছোটবেলা আম্মা শিখিয়েছেন যেকোন পরিস্থিতিতে নিজের উপর ভর করা। বলতেন, যে নিজেকে সাহায্য করে না, তাকে অন্য কেউও সাহায্য করতে চায় না। আর কখনোই অন্যায়ভাবে কারো বশ্যতা স্বীকার করতে নেই।
যাহোক, ঈদের শুভেচ্ছা রইলো। ঈদ মোবারক। -{@ -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
রুবা’পু বাহ! এমন মায়েরা আছে বলেই এখনও আমরা বেঁচে আছি। আমার মামনিও একই কথা বলেছিলো। আমার মামনির মতো পজিটিভ মনের মানুষ খুব কম দেখেছি। আর এই পজিটিভ মনোভাব আমিও পেয়েছি।
আপনার মাকে আমার প্রণাম জানাবেন। -{@
লীলাবতী
পুরুষকে আকড়ে ধরে ব্যাতীত এক পা চলাচলের অযোগ্য এই নারী, উনি সমাজের কোন সু- উদহারন হবেননা। এভাবে কেন হবেন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক? নিজকে শেষ করে দেয়ার যে শক্তি, তার অর্ধেকও যদি দিতেন প্রতিরোধ করার জন্য, তাহলে তা অনুকরন যোগ্য হতো। সব নারী সাহসী হোক।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
শিক্ষিত নারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে না লড়ে আত্মহননের পথ বেঁচে নেবে, এটা আমি মানতেই পারছি না। এতো দুর্বল চিত্তের মানুষের উপর স্বামীত্ব ফলাবে, এই তো স্বাভাবিক। সে সুযোগ দিয়েছে বলেই স্বামী ঘাড়ে চেপে বসেছে।
শিক্ষাই অর্জন করেছে কেবল, শিক্ষার আলোটুকু ধারণ করতে পারেনি।
মিষ্টি জিন
আত্মহত্যা মানুষ তখন ই করে যখন নিজেকে সে আর ভালোবাসেনা।
জীবনটা এতও তুচ্ছ না যে কারো জন্য এটা শেষ করতে হবে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনেক উচ্চ শিক্ষিত মেয়েরা স্বামীর অনেক অন্যায় সহ্য করে বা করতে বাধ্য হয়। সবাই প্রতিবাদ করতে পারেনা।
তাই বলে আত্মহত্যা? না একদমই মানতে পারিনা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অন্যায় সহ্য করা এক কথা আর অপমান মেনে নেয়া আরেক কথা। আবার অন্যায়েরও সীমারেখা থাকে। সীমাহীন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া মানে নিজেকে বিসর্জন দেয়া। হোয়াই? কেনো আমি নিজের মান-অপমান সব বিসর্জন দিয়ে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে যাবো?
প্রতিবাদ করতে পারেনি বলেই তো নিজেকে শেষ করে দেয়ার মাঝেই মুক্তি খুঁজেছে! অথচ একবার যদি ঘুরে দাঁড়াতে পারতো, স্বামীই অবাক চোখে তাঁকে ফিরে ফিরে দেখতো।
কামনা করি দুর্বল চিত্তের মেয়েরা নিজের উপর শক্তি খুঁজে পাক।
ব্লগার সজীব
পত্রিকায় ওনার আত্মহত্যার সংবাদ পড়ে খুবই খারাপ লেগেছিল আপু। এমন শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী একজন হয়ে কেন তিনি এমন ভাবে জীবন ধারণ করবেন? ওনার মত নারী যদি এমন ভাবে জীবন ধারণ করেন তো সাধারণ নারীদের কি অবস্থা তা তো বুঝাই যায়। নারীদের প্রতি মনোভাব আসলে আমাদের তেমন পাল্টেনি আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
বিভিন্ন লেখায় উনার কাছের মানুষজনের বক্তব্য থেকে যতোদূর বুঝেছি, আকতার জাহান অন্তর্মুখী টাইপের মানুষ ছিলেন। এ টাইপের মানুষ চাপা স্বভাবের কারণে প্রতিবাদ করতে পারে না।
কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, পুরুষশাসিত এই সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে আক্রান্ত হলে মুখ খুলতে হবে, ঘুরে দাঁড়াতে গেলেও মুখ খুলতে হবে।
সর্বোপরি, আমার পর্যবেক্ষণ বলে আকতার জাহানের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় তাঁর স্বামীটিকে আরোও বেপরোয়া করে তুলেছে। শুরুতেই অন্যায়ের বিরোধিতা করতে পারলে আজ এতোদূর গড়াতো না।
ইকবাল কবীর
আত্তহত্যা কোন সমাধান নয়। আমাদের সমাজে অনেক অন্ধকার আছে যা আমাদেরকেই আলোকিত করতে হবে। আমরা যদি সমস্যা থেকে পালিয়ে বেড়াই তাহলে কিছুতেই কিছু করা সম্ভব না। ওনার আত্তহত্যায় আমি শোকাহত কিন্তু এইটা ওনার কাছে প্রত্যাশা করা যায় না। ওনার উচিত ছিল সমস্যা মোকাবেলা করা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ঠিক। সমস্যা থেকে পালিয়ে না বেড়িয়ে সমস্যার মোকাবেলা করা উচিৎ। আগে জীবন, তারপর অন্যকিছু।
রিমি রুম্মান
আমাদের এক জীবনের পুরোটাই সুখের কিংবা দুঃখের নয়। পাথর সময় পেরিয়ে আবার আলোয় ভরে উঠবে, উঠবেই । তবুও মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, কতটা হতাশার মধ্য দিয়ে গেলে ! যে গেলো, সে তো গেলোই। কিন্তু যাঁদের রেখে গেলো , তাঁদের কথা ভাবল না একবারও !!
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আমার কাছে সবচেয়ে কষ্টের বিষয়, তাঁর মতো অলস্কয়ার মানুষ কেনো হেরে গেল? কেনো জিতে গিয়ে আরো দশটা মেয়ের কাছে নিজেক উদাহরণ হিসাবে তুলে দিলেন না?
তাইলে অজঁপাড়া গায়ের হত দরিদ্র নারীরা কি করবে?
প্রজন্ম ৭১
এমন প্রতিষ্ঠিত নারীদের এমন আত্মহনন মেনে নেয়া কঠিন খুব। নারীর প্রতি আমাদের মনোভাব কবে পাল্টাবে? নারীর মৃত্যুর পরে তাঁর চরিত্র নিয়ে কিছু লিখলেই অপরাধী আড়ালে চলে যায়, সামনে এসে দাঁড়ায় নারী সম্পর্কে বিশ্রী ইতিহাস, মানুষ তা সত্য বলে ধরে নেয়। মৃতু তখন বৈধ হয়ে যায়। (y)
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আমরা এতোটাই বিকৃত মানসিকতা লালন করি যে, মরে যাওয়া মানুষটির চরিত্র নিয়েও গসিপে মগ্ন হয়ে যাই, অথচ একবারও ভাবি না মৃত মানুষটির যেখানে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি খণ্ডনের সুযোগই নাই, সেখানে এ নিয়ে আলোচনাটাই তো রুচিহীন।
আর এই করি বলেই ভিকটিম সুযোগ পায়।
ইঞ্জা
অবশ্যই নারীর প্রতি আমাদের (পুরুষ জাতির) মনোভাব বদলানো উচিত, আমাদের ভালো করেই আবার বুঝা উচিত নারী শুধু নারী নয়, সে কখনো মাতা, কখনো কন্যা, কখনো সে স্ত্রী, যে নারী দশ মাস দশ দিন কষ্ট করে পুরুষ জম্ম দেয়, যে নারী এই পুরুষদের জম্ম দিতে গিয়ে সাক্ষাত মৃত্যু দেখে আসে সেই নারীকে কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়।
হে পুরুষ তোমরা মানুষ কবে হবে?
মারজানা ফেরদৌস রুবা
নারীর সচেতনতা বাড়াতে নারীকেই গলাতে তুলতে হবে আওয়াজ, হাতে নিতে হবে কলম, পায়ের নিচে মাটিকে করতে হবে শক্ত, তবেই নারীমুক্তি সম্ভব।
তবে সব বিবেচনায় দেখি, পুরুষতান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন পুরুষ তা মেনে নিতে বিব্রতবোধ করাতেই বাড়বে দ্বন্ধ। সংঘাত অনিবার্য। এক সময় পূর্বেকার অবস্থাতেই ফিরে কী না মানবজাতি!
যদি অধিকারবোধ সম্বন্ধে পুরুষের মাঝে সম্মানবোধ জাগ্রত হয়, তবেই শান্তি।
ইঞ্জা
সহমত
মৌনতা রিতু
নারীকেই তার যায়গা শক্ত করতে হবে। শিক্ষিত হয়ে এমন কাজ সত্যিই অভাবনীয়,
হ্যাঁ, কষ্ট আছে তাই বলে হেরে যাব কেন ?
ভাল পোষ্ট অবশ্যই আপু।