
ধর্মতলা থেকে বীরপাড়ার পথে যাত্রা—১৯৯৩ইং— শীত শুরুর দিককার সময়। একটা বয়সে মানুষ যেমন হঠাৎ পুরনো কোনো চিঠি বা পরিচিত মুখের খোঁজে ঘর ছাড়ে, তেমনই এক অজানা টানেই আমি পাড়ি জমিয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির ছোট্ট শহর বীরপাড়ার উদ্দেশে। সেখানে আমার বড়দি থাকতেন—রবীন্দ্রনগর কলোনিতে, যা প্রায় সীমান্ত ছুঁয়ে থাকা জায়গা, ভুটানের কাছ ঘেঁষে। তখনও জানতাম না, এই সফর আমার জীবনের দিগন্ত বদলে দেবে।
দুপুর ১:৩০ মিনিটের সময় কোলকাতা ধর্মতলা থেকে উত্তরবঙ্গের বাসে উঠে বসে ছিলাম। বাস ছাড়লো আরও আধাঘন্টা পর, প্রায়ই বেলা দুটোর দিকে। আমি বাসে জানালার সাথে থাকা সিটে। বাস যাচ্ছিল দ্রুত গতিতে। জানালার বাইরে দিয়ে যেন সরে যাচ্ছিল চা-বাগানের সারি, দূরে হিমালয়ের পাহাড়ি রেখা—এক ছায়াভাসের মতো। স্টেশনের কোলাহল কাটিয়ে যখন আমি বীরপাড়া নামলাম, পরদিন ঠিক দুপুরবেলা। তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। স্টেশনে একটা পুরোনো বোর্ডে লেখা ছিল—“বীরপাড়া, জলপাইগুড়ি।” সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, এই শহর যেন আমাকে চিনে ফেলেছে বহু আগেই।
রবীন্দ্রনগর কলোনি ছিল এক অদ্ভুত মায়ার জায়গা। সাথে মিশে আছে লাল মাটি। একটা ভাঙাচোরা রিকশা চেপে পিচঢালা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম রবীন্দ্র নগর কলোনির দিকে। রিকশা বসে যেতে যেতে মনে হয়েছিল, সময় যেন এখানে থেমে আছে। রাস্তা যেনে ফুরচ্ছে না। এদিক-সেদিক চেয়ে চেয়ে যেতে যেতে একসময় পৌঁছে গেলাম রবীন্দ্র নগর কলোনিতে। বড়দি’র বাড়ির সামনে গিয়েই রিকশাওয়ালা ট্রিংট্রিং বেল বাজাচ্ছিল, বাড়ির ভেতর থেকে যেন কেউ বের হয়৷ রিকশাওয়ালার বেলের ট্রিংট্রিং শব্দে বাড়ির ভেতর থেকে বড়দি বের হয়ে জিজ্ঞেস করছিল, ‘’কে, কাকে দরকার?” রিকসাওয়ালা বললো, আজ্ঞে দিদি বাংলাদেশ থেকে আপনদের অতিথি এসেছে।
রিকসাওয়ালার কথা শুনে বড়দি আমার দিকে তাকালো। আমি রিকশা থেকে নেমেই দিদির পায়ে ছুঁয়ে নমস্কার করে বললাম, “দিদি, আমি আপনার ছোট ভাই নিতাই।”
ছোট ভাই নিতাই বলার সাথেসাথেই বড়দি হাউমাউ করে আমাকে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। বড়দি’’র কান্নাকাটির শব্দে আশেপাশের বাড়ির অনেকেই দিদির বাড়ির সামনে জড়ো হয়ে গেল। অনেকেই অনেক কথা জিজ্ঞেস করলো, উত্তর দিলাম। তারপর বড়দি ভাগিনা-ভাগ্নী আর জামাইবাবু আমাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। বাড়ির ভেতরে গেলাম, জামাকাপড় ছাড়লাম। খাওয়াদাওয়া করলাম, বিশ্রামও করার জন্য খাটের পার শুলাম। ভাবতে লাগলাম, দীর্ঘদিন পর যেন জীবনের কোনও হারিয়ে যাওয়া খণ্ড ফের ফিরে পেলাম।
বীরপাড়ার মানুষজন ছিল মিশুক, তারা অচেনা মানুষকেও আপন করে নিতে পারতো। সকালে বাজারে গেলে দু-একটা ভুটানি বা নেপালি মুখ দেখতে পাওয়া যেত। সেখানে ঘুরতে ঘুরতেই একদিন কেউ বলেছিল, “ভুটান তো এখান থেকে হাঁটলেই চলে যেতে পারো”—সেই বাক্যটাই আমার ভিতরে একটা আগুন জ্বেলে দিয়েছিল।
তখন থেকেই শুরু হয়েছিল আমার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত টান—সীমান্ত শুধু মানচিত্রের রেখা নয়—এটা এক মানসিক আকাঙ্ক্ষা। কিছু পেরিয়ে যাওয়ার, নতুন কিছু দেখার, নিজেকে অন্যরকম এক আয়নায় দেখার তৃষ্ণা। পরদিন সন্ধ্যায়, বড়দি’র হাতের গরম লুচি আর আলুর দম খেতে খেতে আমি স্থির করেছিলাম—পরদিনই ভুটানের পথে রওনা হব। তা যা-ই থাকুক কপালে!
স্মৃতির স্মরণিতে: গুমটুর পথে—পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার এক ছোট্ট শহর হলো,বীরপাড়া। যার অবস্থান ভুটান সীমান্ত ঘেঁষা। রবীন্দ্র নগর কলোনি নামের এক শান্ত পাড়ায় ছিল আমার বড়দি’’র বাড়ি। যাইহোক, আগের সন্ধ্যায় ভাবা আর রাত পোহাতেই ভুটানের গুমটু শহরে যাওয়ার পায়তারা যেন আমাকে বিচলিত করছিল। সকাল তখন প্রায় আটটা। তড়িঘড়ি করে সকালের নাস্তা সেরে সোজা চলে গেলাম, বীরপাড়া শহরে। বীরপাড়া শহরের শেষ প্রান্তে ভুটান গুমটু যাবার জীপগাড়ি আর লেগুনা গাড়ির মতো গাড়িগুলো দাড়িয়ে থাকে। হিসাব মতো যাত্রী হলেই গাড়ি চললো গুমটু শহরের দিকে। ভুটান গুমটু শহরে পায়ে হেঁটেও যাওয়া যায়। দুরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার। কিন্তু আমি এখানে নতুন বিধায় পায়ে হেঁটে যাবার সাহস পাইনি। তাই আমি জীপ গাড়িতেই চেপে বসলাম। ভাড়া মাত্র ৩ টাকা। বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পরই পৌঁছে গেলাম ভারতের শেষ সীমান্ত মাকরাপাড়া, ভুটানের গুমটু।
ভারত সীমান্ত শেষেই ভুটান গুমটু শহরে প্রবেশের সুবিশাল গেইট—সীমান্ত গেইট পেরিয়ে গুমটুতে প্রবেশ করতেই মনটা যেন ধপধপ করছিল, ভয়ে। ভয় মানে, যদি সীমান্ত প্রহরী আমাকে আটকে দেয়, তাই মনের ভেতর যতো ভয়। ভয় ভয় মনেই আস্তে ধীরে সীমান্ত গেইট পাড় হলাম। আমাকে কেউ আর কিছুই বলল না, কেউ কিছু জিজ্ঞেসও করলো না। আমি দিব্বি বীরদর্পে হেঁটে সীমান্ত গেইট পাড় হয়ে সোজা গুমটু শহরের অনেক ভেতরে চলে গেলাম। মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম আমি এক নতুন দেশে পা রেখেছি। সেখানকার বাতাস ছিল আরও নির্মল, মানুষের মুখে এক ধরনের শান্ত অভিব্যক্তি। শহরটি ছোট হলেও পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন এবং অত্যন্ত সৌন্দর্যমণ্ডিত। প্রথম দিনই আমি গুমটু শহরে গিয়ে ওখানকার পরিবেশ আর ভুটানিদের আচার-ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলাম।
সময় পেলেই চলরে মন—এর পর থেকে আমি প্রায়ই সময় পেলেই সেখানে যেতাম। গুমটু শহরের শেষপ্রান্তে ছিল একটি ছোট ঝর্ণা, যা পাহাড়ের বুক চিরে নেমে সমতলে জলধারায় রূপ নিয়েছিল। ওখানে গেলেই আমি বসে থাকতাম ঝর্ণার ধারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঝর্ণার ধ্বনি, পাখির ডাক আর হালকা বাতাসে মন ভরে যেত। কখনও কোনও স্থানীয় দোকানে গরম চা খেতে খেতে সেখানকার মানুষদের সঙ্গে গল্প করতাম। তাঁরা বেশ বিনয়ী এবং অতিথিপরায়ণ। কিছু ভাঙা বাংলাও বলতে পারতেন অনেকে, যা আমার সঙ্গে তাঁদের বন্ধনের এক সেতু হয়ে উঠেছিল।
হঠাৎ একদিন সকালবেলা—নাস্তা না করেই ভুটান গুমটু যাবার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বড়দির বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা বীর পাড়া। ওখান থেকে জীপগাড়ি চরে চল্র গেলাম ভুটান গুমটু। আমি গুমটু শহরের ভেতরে গিয়ে এক স্থানীয় ছোট্ট স্কুলের জানালা দিয়ে উঁকি মারি। স্কুলে পড়ুয়া বাচ্চাদের উচ্ছলতা, তাদের চাহনি আর নির্ভরশীলতা দেখে আমার মনে পড়ে যায় নিজের শৈশবের কথা। আমি দাড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবছিলাম! হঠাৎ স্কুলের এক শিক্ষক আমাকে দেখে ভেতরে আসতে বলে। আমি ভয় পাচ্ছিলাম!
মনে বড়ো ভয়—আমার আমতা আমতা মনোভাব দেখে স্কুলের ওই শিক্ষক নিজেই বাইরে এসে আমাকে স্কুলের ভেতরে নিয়ে শিক্ষকের সামনে বসতে দেয়, আমি বোকার মতো বসি। শিক্ষক আমার পরনের পোশাকআশাক দেখে বুঝতে পেরেছে যে আমি এই এলাকার বা ভারতের বীর পাড়ার বাসিন্দাও নই। তিনি আমাকে প্রথমে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো, “তোমহারা মোকাম কাঁহা?” আমি বললাম, বাংলাদেশ। শিক্ষক আবার জিজ্ঞেস করলো, “এদারসে কাঁহা” আমি বুঝতে না পেরে বললাম, সার আপনি বাংলা জানেন? শিক্ষক বললো, “হ্যাঁ” হ্যাঁ বলেই বললো, তুমি এখানে কোথায় এসেছ? বীর পাড়া। আমার বড়দির বাড়ি।
তারপর শিক্ষক আমাকে স্বাগত জানান এবং আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে কৌতূহলভরে প্রশ্ন করতে থাকেন। এই আন্তরিকতা আমাকে আজও তাড়া করে।
ওখানকার স্থানীয় মেলা—আরেকদিন স্থানীয় এক ছোট মেলা দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানকার হস্তশিল্প, খাবার, গান-বাজনা সবকিছুই ছিল ভিন্ন কিন্তু মায়াবী। আমি একটা শীতে ব্যবহার করার জন্য সেখানকার তৈরি একটা কম্বল কিনেছিলাম, যা আজও আমার ঘরে আছে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে।
একদিন সন্ধ্যাবেলা—হঠাৎ ঝড় উঠেছিল গুমটুর আকাশে। পাহাড় ঘেরা অঞ্চলে আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু ওই দিন ঝড়ের সাথে হালকা বৃষ্টি আর বজ্রপাতের শব্দ মিলে এক ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছিল। আমি তখন এক ছোট কাফেতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কাফের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, গুমটুর পাহাড়ি রাস্তাগুলো কুয়াশায় ঢেকে গেছে। সেই মুহূর্তটা যেন সিনেমার কোনো দৃশ্য! এক কাপ গরম চা, আর ভেতরে বাজছিল ভুটানিজ সুরে বাজানো এক ধীর লয়ের বাঁশি—সেই অভিজ্ঞতা আজও মনে গেঁথে আছে।
নেমন্তন্ন—একদিন আমি স্থানীয় এক ছোট্ট পরিবারের আমন্ত্রণে দুপুরের খাবার খেতে যাই। সেদিন তাঁরা ভুটানের ঐতিহ্যবাহী খাবার “এমা দাতশি” পরিবেশন করেছিলেন। ভিন্ন স্বাদের হলেও খাবারটির উষ্ণতা আর পরিবারের হাসিমুখ আমাকে বুঝিয়ে দেয়, মানুষ যত দূরেই থাকুক, আন্তরিকতা ভাষা বা সংস্কৃতির সীমা মানে না।
সেই থেকে ভুটানের গুমটু মনের গভীরে—ওই সফরের প্রতিটি দিন আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। গুমটুর সেই নিঃশব্দ অথচ সমৃদ্ধ সৌন্দর্য, মানুষদের আন্তরিকতা, আর প্রকৃতির অপার শান্তি আজও আমাকে টানে। যখনই জীবনের কোনো ক্লান্তির মুহূর্ত আসে, মনে করি সেই গুমটুর সকালগুলো—ঝর্ণার পাশে বসে থাকা এক নিঃশব্দ আমি। আজও যেন ঘুমের ঘোরে কোনোএক সময় গুমটু শহরের একটা চায়ে দোকানে বসে চা পান করছি আর গুমটু শহরের বাইরের সেই সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করছি। আর মনে মনে বলছি, “প্রিয় গুমটু তুমি আমার মনের গভীরে।
৪টি মন্তব্য
নার্গিস রশিদ
খুব ভালো লাগলো ভ্রমন কাহিনী ।
নিতাই বাবু
আমার ভ্রমণকাহিনী লেখা আপনার মতো হবে না, দিদি। আপনার মতো করে ভ্রমণকাহিনী লিখতে হলে আরও অনেক সময় লাগবে। আপনি ভ্রমণকাহিনী, অণুগল্প, সামাজিক, দেশ-বিদেশের ঘোরাফেরার কাহিনী দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। এজন্য আপনার শ্রীচরণের নমস্কার জানাই। আশা করি ভালো আছেন।
নার্গিস রশিদ
নিতাই দাদা, আমার লেখা ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো । অনেক ধন্যবাদ জানাই অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য। এই রকম অনুপ্রেরণা পেলে লিখতে ইচ্ছা করে। ভালো থাকবেন। নাতনী ভালো আছে তো ? আর আপনার শরীর ? সংকোচ করবেন না কিছু দরকার লাগলে । আপনার লেখা সত্যি খুব উঁচু মানের।
নিতাই বাবু
আপনার আশীর্বাদে নাতিন ভালো আছে, দিদি। আর আমার শরীর স্বাস্থ ভালো আছে।