
“কালো কালো করিসনে লো
ও গোয়ালের ঝি!
আমায় বিধাতা করেছে কালো
আমি করব কী!”
অনেক দিনের শখ ছিলো, সাদা কালো ফ্যাশন হাউজ থেকে একটা সাদা কালো শাড়ি কিনবো। আমার শখ পূরণ হলো ঠিক অন্যভাবে। রাসেল, আমার দাদুর সর্বকনিষ্ঠ পুত্র। সাধারণত দাদুর ছেলে আমার চাচা হওয়াটাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিকতা হলো,,,দাদুর ছেলে দুনিয়াতে আসছে আমার জন্মের প্রায় ১২/১৩ বছর পর।
তো এখন আমি রাসেলকে চাচা কেমনে বলি? রাসেল বড় হওয়ার পর থেকে আমাকে লিপি আন্টি বলে সম্বোধন করে। আমি রাসেলকে বা’জান ডাকি। রাসেল ফিনল্যান্ড প্রবাসী।
২০১৩ সালে দেশে এসে দেশী দশ থেকে সাদাকালো শাড়িটা গিফট করল। সাদাকালো ফ্যাশন হাউজ প্রোডাকশনে আসার পর এর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে বলার কিছু নেই। তুমুল তুঙ্গে অন্যান্য ফ্যাশনেবল ব্রান্ডেড পোষাকের সাথে পাল্লা দিয়ে সাদাকালো ব্র্যান্ড। পরিধেয় অনুষঙ্গে নারী সেজে ওঠে রমনীয় কমনীয় রূপে। সেই অনুষঙ্গের রঙ যদি বৈষম্যে চালাচালি হয়!!!
তখন আর মন শান্ত থাকে কি করে?
** শুনেছিলাম আম্মা’র মুখে, আমার নানীজান আমার জন্মের পরে আমাকে দেখে খুশি হননি। তাচ্ছিল্যের সাথে নাকি বলতেন আম্মা ‘র নাম ধরে ” —‘ওর প্যাডে (পেটে) হইছে এই মাইয়া?’ অর্থাৎ আমার মা যতটা শারিরীক রংএ সাদা! তার গর্ভে জন্ম নেয়া এই আমি, আমার নানিজানের চোখে তীব্র কালো কুৎসিত।
আমার বাবার রংএ আমি রঞ্জিত হয়ে জন্ম নিয়েছি, এ কথা তখন নানিজান কিংবা ওই সময়ে যারা যারা আমার মায়ের কোলে আমাকে দেখে মেনে নিতে পারেননি, তারা কেহই হয়ত চিন্তাও করেননি।
সময়ের স্রোত ভেসে যেতে যেতে শরীরের রং যতটুকু ধুয়ে গিয়ে ধুসর হয়েছে! তাতে করে হয়ত কেউ আর আমার মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া এই আমাকে কুৎসিত কালো তকমায় ফেলেন না! তবে… আমার মায়ের মেয়ে আমি! এ কথাও সহজে অনেকেই মেনে নিতেন না।
কালো ধলো নিয়ে কেন যে কোনোকালেই আমার ভেতর কোনোধরণের কমপ্লেক্স জন্ম নেয়নি! আজো আমি তার রহস্য বুঝে উঠতে পারি না। বরং এই কালো সাদা নিয়ে প্রসঙ্গ নিয়ে যারা খুব বেশি টেনশিত বাক্যবিনিময় করেন! আমার সবসময়েই সে বিষয়ে ঘোরতর আপত্তি।
সেই বাল্যকাল থেকেই গায়ের রং কোনোরকম প্রভাবিত করার মতো বিষয় হতেই পারেনি।
** পাক্কা ৩/৪ দিন প্রসব যন্ত্রণার পরে আমার প্রথম কন্যা সন্তানের জন্ম হলো। জন্মের পরে নবজাতকের স্বাভাবিক কান্না শুনতে পাইনি। আমার মায়ের একটা চিৎকার কানে এলো- আল্লাহ্…এত কষ্টের পর এইয়া? আমি তখনো জানি না, আমার কি সন্তান এসেছে আমার কোলে! অনেক্ষণ বাদে নার্স নাসিমা খালা যখন বললেন আমার মাকে!- ‘দ্যাখো ভাবি তোমার সতীনের মাথাভর্তি চুল!’ দু’হাত তুলে মহান স্রষ্টার দরবারে শোকরিয়া জানিয়েছি কন্যা সন্তান তার দরবারে চেয়ে পেয়েছি বলে।
মেয়েটার জন্মের কয়েক ঘন্টা পরে যখন আমার কাছে দেয়া হলো…! দেখেছিলাম একটা শিশু সন্তান এসেছে আমার কোল জুড়ে। সন্তান ছাড়া আর কিছু দেখিনি। প্রতিবেশি দাদী সমতুল্য যখন প্রথম তুলনা করে বলে উঠলেন…! মনে পড়ে গ্যালো…. নানী’জানের মন্তব্য। পথে ঘাটে মেয়েকে কোলে নিয়ে বাপের বাড়ি টু শশুড় বাড়ি আসতে – যেতে পড়েছি এমন অনেক অর্বাচীনের খপ্পরে। মেয়ের ২৪ দিন বয়সে আমার শশুড় ইন্তেকাল করলেন। বাবার বাড়ি থেকে শশুড় বাড়ি আসতে যেতে দেড় ঘন্টার মত সময় লাগে। বাসে মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি পাশঘেষা মহিলা যাত্রী বারবার মেয়েকে দেখছেন আর আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। আমার মনে তখন অজানা আতংক,,,মেয়ের যদি বদ নজর লাগে! এমন করে দেখে কেন এরা? ভীষণ বিরক্ত আমি। আমি তাদের কিছু বলতেও পারি না।
অনেক্ষণ বাদে প্রশ্ন এলো তাদের তরফ থেকে, তাতে মেজাজ গেল আরো খারাপ হয়ে-
পাশের মহিলা দু’পাটি দাঁত প্রদর্শন করে জিজ্ঞেস করে বসল চরম বেক্কল মার্কা প্রশ্ন- এ বাচ্চা কি আপনার? কপালের চামড়া যথাসম্ভব সর্বোচ্চ ভাঁজ টেনে রেখে জবাব দিয়েছিলাম… আমার কোলে দেখতে পাচ্ছেন যখন তখন আমারই!
কি কারণে দাঁত কেলানি হাসিতে দুই মহিলা উদ্ভাসিত হলেন বোঝার দরকার নাই বলেই উল্টাদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তা দেখছি। আরো কতক্ষণ পরে আবারো প্রশ্ন বাচ্চার বাবা’কে লক্ষ্য করে– ‘বাচ্চার বাবা কি ওই?’ সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই তারা যেন বিজয়ের হাসিতে সন্তষ্ট হলেন।
প্রসঙ্গান্তরে বুঝাবার চেষ্টা করেছেন মেয়ে তাঁর বাবা ‘র মতো হয়েছে। আমার চোখে শুধুই আমার গর্ভজাত প্রথম কন্যা সন্তান।
সময় অনেক বদলেছে। দেশ অনেক এগিয়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে। মানুষ মনে এবং মননে কতটুকু উন্নতি করেছে?
একজন মেয়ে শিক্ষা,রুচি,জ্ঞান,আধুনিকতায় নিজেকে যতই উচ্চশিখরে পৌঁছাক না কেন!!! বিয়ের বাজারে এখনো তাঁকে হতাশা নিয়ে মুখ গুঁজে থাকতে হচ্ছে। শিক্ষা দীক্ষায় তাবড় তাবড় পাত্র পক্ষ যতই বড়কথার ফুলঝুড়ি ছোটান না কেন- মেয়ে খুঁজতে গেলে চামড়ার রঙ অগ্রাধিকার সর্বাগ্রে। হায়রে সমাজ ব্যাবস্থা!!!! আজো সাদা কালো ‘র এই মহান বৈষম্যের দৌড়াত্ব সমান্তরাল সেই যুগ মনে করিয়ে দ্যায়- কালোর দাসত্ব সাদা ‘র বীরত্ব।
“কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
ও কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে
মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে
কালো? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ”
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নোটঃ লেখাটা সম্পূর্ণরূপে পরিমার্জিত করে এখানে দিয়েছি। লেখাটি খুব সম্ভবত ৫/৬ বছর আগের কোনো এক বন্ধুর কালো রং নিয়ে কটাক্ষের ভিত্তিতে ফেসবুক ওয়ালে লিখেছিলাম।
এখনো পাত্র/পাত্রী দেখাদেখি নিয়ে গায়ের রং নিয়ে বৈষম্যমূলক আচরণ লক্ষ্যনীয়।
আজও আমার মায়ের ডাক্তার আমাকে দেখেই বলে বসলেন আমার মা’কে – না মা! আপনার মেয়ে তো আপনার মত হয়নাই!
আমি শুধু হাসলাম। প্রশ্নটা করার ইচ্ছে দমন করেই চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম। পাঠকের কাছে প্রশ্নটা রেখে গেলাম– মা ফর্সা হলেই সন্তানও ফর্সা হবে, এমন কথা কোন কেতাবে কোন পন্ডিত লিখে রেখে গেছেন?
ছবি: সোনেলা গ্যালারি থেকে নেয়া।
৪টি মন্তব্য
হালিমা আক্তার
আপনার লেখা পড়ে এক ভদ্রলোকের কথা মনে হলো। ভদ্রলোকের গায়ের রং কালো, তাই খুঁজে খুঁজে ফর্সা রং এর বিয়ে করেন। কারণ সন্তানের রং যেন ফর্সা হয়।বিধি বাম তিন সন্তানের একজনও মায়ের মত হয় নাই। আমাদের সমাজে এখনও মেয়েরা, মেয়ে হয়ে জন্ম গ্রহণ করে। সন্তান হিসাবে নয়। সাদা কালোর এই চক্র থেকে কবে বের হয়ে আসবে সমাজ।
বন্যা লিপি
শুধু ওই ভদ্রলোক কেন! দক্ষিণ এশিয় মহাদেশে শতেকে ৯৯.৯ % তথাকথিত ভদ্র(?) লোকেরাই নিজের সাথে একটা ফর্সা বউই ম্যাচ করতে বিবাহের শর্ত দিয়ে বিয়ের বাজারে নামেন।
এ চক্র কখনোই শেষ হবার নয়।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
নার্গিস রশিদ
চমৎকার একটা লেখা পড়লাম । আমাদের সমাজে মেয়েদের নানা বাধা বিপত্তি তো আছেই তার সাথে এই রং নিয়ে বিড়ম্বনা আর এক সমস্যা। খুব ভালো একটা দিক তুলে ধরেছেন । এই রকম নানা সমস্যা নিয়ে আরও লেখা চাই। শুভ কামনা।
বন্যা লিপি
মেয়ে (নারী) জাতীয় নানাবিধ সমস্যার বড় সমস্যা এই গায়ের রং। এই ন্যাক্কারজনক সমস্যাটা আসলে রং বৈষম্যধারী মানুষ নামক বিচিত্র চরিত্রের অধিকারীদের মগজে।
এদের মগজ ধোলাই প্রায় অসম্ভব।
মন্তব্যে আপনাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি শ্রদ্ধেয়া🌹🌹