শামুক- ১
মহেশখালীতে বাবা রাজশাহী থেকে পঞ্চাশের দশকে পালিয়ে যান। সেখানে যাবার খবর আমরা পাঁচ বছর পরে পাই। মায়ের বুকে প্রাণ আসে। চিঠির ভেতর ১৯৫২ সালে বাবা ৫০০ টাকা পাঠিয়ে লিখেন, নিয়মিত টাকা পাবে। ছেলে দুটোকে স্কুলে দিও। আমি ছোট ছেলেকে নিয়ে আসবো।
এর পর থেকে প্রায় চিঠি আসে। বাবা যেন কাছে ফিরে আসেন। বাবার চেহারা হালকা মনে পড়ে।
বাড়িতে দাদু মাথায় হাত দিয়ে পস্তাতে থাকেন। বড় ছেলে তার। অনেক আদরের ছেলে। সামান্য টাকা সরানো জন্যে বাবাকে ধোলাই দিয়েছিলেন। সাবালক বি এ পাস ছেলে। সইতে পারেন নি। দাদুর হাঁপানি বাড়ে। আমরা গত পাঁচ বছর দাদুর একান্নবর্তী সংসারে খেয়েছি। নানু কোনো সাহায্য করতেন না। বরং মাকে পাকাপাকি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। মা বাবার মনের ধাত বুঝতেন। নানুবাড়ি ফিরেও যান।
বাড়িতে আমার চাচা চাচী সকলেই নিচু চোখে মা আর আমাদের দেখতেন। বাবার খোঁজ পাওয়ার পর মা প্রতি মাসে দাদুকে ১৫০ টাকা দিতেন। আমাদের খাবার বাবদ। দিদিমাকে পান জর্দা কিনে দিতেন। দিদিমাকে প্রতি সপ্তাহেই মিষ্টি খাওয়াতেন। এতে আরেক বিপত্তি হলো। চাচা চাচিরা আড় চোখে বলতেন, বাবা নাকি ওখানে বিয়ে করেছেন। মা একদিন আমাকে ডেকে বললেন, তুমি তৈরি থেকো । তোমার বাবা শনিবারে আসছেন। তোমাকে নিয়ে যাবে।
================================
শামুক – ২
আমরা গ্রামের মানুষ। আম কাঁঠাল আর বেলতলা। বড় বাড়ি আমাদের। সামনে শিউলি আর বকুল গাছ। বাবার শখের ফুলের বাগান দাদু নষ্ট হতে দেন নি।
মা যত্ন করেছেন। এত কিছুর ভেতর থেকেও আমি ভয় পেলাম। স্কুল আছে। মা আছে। বাবা কি রকম হয়, তাই তো জানি না। হালকা স্মৃতি আছে। বাবা রোজ বাহির থেকে এসে মাগরিবের আগে আমাদের নাক , পা পরিষ্কার করতেন। লাল বর্ডার আঁকা রাবারের জুতো আর গায়ে লাল একটা চাদর পেঁচিয়ে পেছনে ঘাড়ের পেছনে বেধেঁ দিতেন।
তারপর সব কাজ মা।
এইটুকু স্মৃতি আমার। শনিবার আসতে দুই দিন বাকি।
আমি বাড়ির বাইরে বসে থাকি। মাকে ঘর গুছাতে দেখি। একটা নতুন চৌকি এসে খাটের পাশে পাতা হয়।
আমি মাকে বলি, এখানে আমরা শোবো?
মা বললো, দিদিমায়ের কাছে শোবে তুমি।
বাড়িতে মাকে নিয়ে চাচিদের হালকা টিটকারি। নওশা আসবে নাকি?
মা নীরব থাকেন। মায়ের কাছে টাকা জমেছে। আমাদের নতুন জামা বানিয়ে দেন। দুই ভাই এর জামা দু রকম। আমি লাল পছন্দ করি।
বন্ধুদের বলেছি, বাবা আসছে।
ওরা বললো, দেখি আগে। তোর জন্য স্কুল ব্যাগ আনে কি না।
আমি বললাম, বাবা লিখেছে, কিনেছি।
ওরা বললো, আর কিছু লিখেছে?
আমি বললাম, বাবার ছবি পাঠিয়েছে। আর একটা বৌদ্ধ মূর্তির ছবি পাঠিয়েছে। সোনার তৈরি।
ওরা বললো, জিজ্ঞেস করিস তো ওখানে তোর বাবা কি করে?
আমি ভাবি। ভয় লাগে। এটি কি জিজ্ঞেস করার বয়েস আমার?
ক্লাস নাইনে উঠলাম। কেবল স্বপ্ন দেখি। ও জানা বাবাকে রোজ স্বপ্নে দেখি।
সেই বাবা শনিবার ভোর রাতের ট্রেনে এসে কখন বাড়িতে মায়ের ঘরে ঢুকেছে টের পাই নি।
সকালে বাড়িতে শোরগোল। দাদুর সামনে শুকনো পটকা একটা মানুষ বসে আছেন। আর দাদু নিঃশব্দে কাঁদছেন।
সেই দেখে আমি মায়ের দিকে যেতেই মা আমাকে বাবার আনা সেই স্কুল ব্যাগ দিয়ে বলেন , গুই সাপের চামড়ার ব্যাগ। কক্সবাজারের পাহাড়ে নাকি অনেক গুই সাপ আছে। মহেশখালীর গরিব জেলেরা গুই সাপের মাংস খায়।
এভাবে বাবা ঘুরে ঘুরে তার মায়ের বুকে এসে খুব কাঁদলেন। দিদিমায়ের বড় ছেলে। দিদি মা অজ্ঞান হলেন। ভাইদের কিছুই বললেন না। বাবার শরীর অনেক মাংসল ছিলো। এখন পোড়া চামড়া।
দুপুরে খাবার পর বাড়ির পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হলে বাবা গিয়ে চৌকিতে শুয়ে ঘুমিয়ে গেলেন। আমার কত বছরের নির্ঘুম মা বাবার শান্তিময় ঘুমের দিকে চেয়ে রইলেন।
৬টি মন্তব্য
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
সুন্দর লেখা। বাবার জন্য অপেক্ষা পূরণ হল — দুপুরে খাবার পর বাড়ির পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হলে বাবা গিয়ে চৌকিতে শুয়ে ঘুমিয়ে গেলেন। আমার কত বছরের নির্ঘুম মা বাবার শান্তিময় ঘুমের দিকে চেয়ে রইলেন।
ধন্যবাদ।
ইঞ্জা
দাদাভাই, লেখাটি বেশ উপভোগ করছি, আপনার লেখা সবসময় জীবন ও মানুষের কথা বলে।
তৌহিদ
ভাস্কর দাদার লেখা পড়েই বুঝলাম তিনি নিত্য সামাজিক প্রেক্ষাপটে ঘটে জাওয়া জীবনের গল্পগুলোই উঠে আসে তার লেখনীতে।
এমন লেখা পড়তে আমার ভালো লাগে। শুভকামনা রইলো।
জিসান শা ইকরাম
এ যেন আমাদের দেখা চিরচেনা সংসারের চিত্র। বাস্তব করে চোখের সামনে উপস্থিত করলেন।
মহেশখালীতে বাবা কি করেন, তা জানতে পারব পরের পর্বে আশাকরি।
চতুর্থ পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি।
শুভ কামনা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
সুন্দর মানসম্পন্ন একটি উপন্যাস পড়ছি। আগামী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। আশা করি আরো ভালো ভালো পর্ব পাবো। শুভ কামনা রইলো
আরজু মুক্তা
চির চেনা আমাদের সংসার।
ভালো লাগলো