যে দিন যায় চলে, সে দিন আর ফিরে না

রিমি রুম্মান ২৩ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ০৬:১৬:১৪পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৬ মন্তব্য

চারপাশে সূৰ্যালোক ঝলমল করছিলযদিও, কিন্তু মাথার উপরে হালকা নীলআকাশে ছাইরঙ্গা মেঘ ভাসছিল বিচ্ছিন্নভাবে।এমন ভরদুপুরে একঝাঁক পাখি উড়ে বেড়াচ্ছিল এদিক ওদিক।অস্বচ্ছ জলের কলকল শব্দ তুলে ইটের দালান একে একে পিছনে ফেলে লঞ্চ ছুটে চলছে আমার ছোট্ট শহরের দিকে।চাঁদপুরের দিকে। বিপরীতমূখী একটি ইঞ্জিন চালিত বড় নৌকা ছুটে গেলো পাশ দিয়ে রাজধানীর দিকে। নৌকাটিতে গাদাগাদি করে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে একদল গরু। সম্ভবত কোরবানীর ঈদ উপলক্ষে বেশি দামে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের। ছোট পালতোলা অন্য আরেকটি নৌকা ঢেউয়ের সাথে দুলছে অদূরে। কিছু নারী-পুরুষ বসে আছে সেখানে ছাতার নীচে। লঞ্চের বেলকোনি থেকে কেবিনে ফিরে আসি।কেবিন নাম্বার ৩৪৮। সাথে নিয়ে আসা বইয়ে মনোনিবেশ করতে চেস্টা করি।কিন্তু লঞ্চের ঘড়ঘড় আওয়াজ আর মৃদু কাঁপুনিতে অক্ষরগুলো নড়েচড়ে উঠে।যেন বই থেকে বাহিরে  উঠে আসতে চাইছে। খুব মনে পড়ছে আমার শহরের প্রবীন এক ডাক্তারের কথা। নাম ছিল ডাঃ নুর রহমান। রোজ সকালে রিক্সায় অফিসে যাবার পথে বই কিংবা খবরের কাগজ পড়তেন তিনি। মাঝে মাঝে বেলকোনি থেকে ছোট্ট আমি রেলিং এগলা উঁচিয়ে সেই দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে ভাবতাম, রিক্সার ঝাঁকুনি সত্ত্বেও কেমন করে তিনি পড়ে যাচ্ছেন বিরতিহীন ভাবে!

এই যে এতোদিন পর পরবাস থেকে ফিরে নদী পথে আমার শহরে যাচ্ছি, এই পথ কতো চেনা, কতো আপন ! অথচ আজ যেন এ পথে আজন্ম অচেনা হলাম ! নিজের কাছে নিজেই যেন বড় অচেনা ! এ পথে এমন জলের কলকল শব্দ শুনতে শুনতে রিমি নামের কোন বালিকা  কি কখনো গিয়েছিল ? হ্যাঁ গিয়েছিল বহু বহুবার। মনের ভেতরে অন্যরকম উদ্দ্যাম, আনন্দ আর উচ্ছলতা ছিল সেইসব সময়ে। কেননা, পথ ফুরালেই আমার চিরচেনা ঘরে মায়াময় দুটি মুখ অধীর অপেক্ষায় থেকেছেন। বাবা-মা। এখনো হয়তো তাঁরা অপেক্ষায় আছেন, তবে সেই চিরচেনা ঘরে নয়, অন্যখানে। অন্য কোনখানে। শহরের বাড়িতে রাত কাটাবো। আমার বাবার বাড়ি। আমার জন্মস্থান। বাবা সবসময়ই বলতেন, আমি যখন থাকবো না, তখনও কিন্তু ঠিক এখনকার মতো করে আসবি।থাকবি। বেড়াবি। “ আসবি তো ?” বলে রাজ্যের অনিশ্চয়তা মাখা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে করুনভাবে তাকাতেন। বাবার ধারনা ছিল, স্বামী -সংসার-সন্তান নিয়ে ব্যস্ত আমরা দুই বোন তাঁর মৃত্যুর পর আর এই বাড়িতে আসবো না, আমাদের আসা হবে না। এই প্রশ্নটি যে কতোটা ভারী ছিল, সেদিন বুঝিনি। সেইসব ভাবতে ভাবতে ধ্যানমগ্নের মতো চোখ বুঝে থাকি। কী ভীষন নিৰ্জনতা , নীরবতা ভেতরে ! কী ভীষন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি !

বুড়িগঙ্গা পেড়িয়ে লঞ্চ পদ্মা- মেঘনার মোহনায় এসে পড়েছে। এগিয়ে যাচ্ছে বিরামহীন ঘড়ঘড় শব্দে। সূৰ্য ততোক্ষণে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। হুইসেল বাঁজিয়ে লঞ্চ তীরে এসে ভিড়েছে যখন, দেখি টার্মিনালে  আমার ভাই দাঁড়িয়ে।অন্যবার এমন করে বাবা দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমাদের নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। এবার দৃশ্যপট বদলেছে।কেননা,বাবার পৃথিবীর পথ চলা ফুরিয়েছে সেই ২০১০ সালে।

পথের দু’ধারে হেঁটে চলা মানুষ দেখতে দেখতে বাড়ির দিকে ফিরি। যেন এইশহরে অচেনা এক আগন্তুকের আগমন ! কলাপসিবল গেটে কিংবা দোতলার বেলকোনিতে কেউ উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে নেই। আমার আগমনকে ঘিরে যে ঝকঝকে পেইন্ট হতো বাড়িটিতে , তা-ও হয়নি এবার। উৎসব উৎসব রব নেই “ রবমঞ্জিল” নামের বাড়িটিতে। শুধু দক্ষিণের জানালায় এখনো দক্ষিণা বাতাস বইছে আগের মতোই।বেঁচে থাকতে  আম্মা প্রায়ই বলতেন, “ এই রুমে ঘুমা, এইখানে ফ্যান লাগে না, ভোরের দিকে শীত শীত লাগে, কাঁথা গায়ে দেয়া লাগে“। কেউ বলেনি, তবুও আমি এই রুমেই ঘুমালাম এতো বছর বাদে। ঘুমাবার আগে, অর্থাৎ যখন সন্ধ্যা ঘনায়মান, তখন রিক্সায় শহর ঘুরে দেখতে বেরিয়েছিলাম। আহা কতোদিন পর আমার শহর, আমার স্কুল, আমার সাঁতার শেখা লেক দেখা ! আমার আজন্ম চেনা, বহুকালের চেনা মানুষজনকে দেখবো পথে যেতে যেতে ! আলো-আঁধারির মাঝে রিক্সা এগিয়ে চলছিলো।চারিদিকে এতো মানুষ, এতো কোলাহল, ঈদের আমাজ, তবুও যেন কোথাও কেউ নেই!  খুব সন্তৰ্পণে আমার আনন্দটুকু ম্লান হচ্ছিলো। খুব করে চাইছিলাম কেউ ডেকে উঠুক। বিস্ময় নিয়ে বলুক, আরে, কবে এসেছো নিউইয়র্ক থেকে ! কিন্তু নাহ ! কেউই আমায় চিনলো না ! এপথ ওপথ ঘুরে শেষে বেদনায় নীল হয়ে ফিরে এলাম।ইচ্ছে করছিল,  প্রতি দুয়ারে কড়া নেড়ে চিৎকার করে বলি, “ আমারে চিনো নাই? আমি তোমাদের রিমি, রব সাহেবের ছোট কন্যা রিমি, লিপির বোন রিমি, চিনছো, চিনছো, চিনো নাই ?”

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাস্ট্র

৬০১জন ৬০১জন

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ