যে অনুভূতি অর্থহীন কড়া নাড়ে অবচেতন মনে

রিমি রুম্মান ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ০৫:১৪:৩৬পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৮ মন্তব্য

২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত টুইন টাওয়ার ছিল নিউইয়র্ক সিটিতে বেড়াতে আসা টুরিস্টদের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। ১৯৭৩ সালের ৪ই এপ্রিল এটি খোলা হয়। লোয়ার ম্যানহাটনে ১১০ তলা দুটি সুউচ্চ ভবন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার কিংবা বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র নামেও এটি পরিচিত ছিল। অনেক দূর থেকে আমরা টাওয়ার দুটিকে দেখতাম একরাশ ভাললাগা নিয়ে। যেন আপন দুইভাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। সুদূর বাংলাদেশ থেকে যখনই কোন আত্মীয় বেড়াতে আসতো, আমরা অন্য দর্শনীয় স্থানের পাশাপাশি টুইন টাওয়ারে নিয়ে যেতে ভুলতাম না। অতিথিদের সুবাদে আমাদেরও দেখা হয়ে যেত আবারো। প্রতিবার নিরাপত্তা কর্মীদের কঠোর তল্লাশির মুখোমুখি হয়েছি। কখনো কোমরের বেল্টের কারনে, কখনোবা কানের দুলের কারনে সিকিউরিটি এলার্ম বেজে উঠতোসুউচ্চ ভবনের টপ ফ্লোরে দাঁড়িয়ে কাঁচের দেয়ালের ভেতর থেকে দুরুদুরু বুকে নিচের দিকে তাকাতাম। এত উপর থেকে নিচের দিকে তাকালে মনে হত খেলনা একটি পৃথিবী বুঝি নিচে। সবকিছুকেই খুব ক্ষুদ্র মনে হত। ম্যানহাটনের রাস্তা দিয়ে ছুটে চলা গাড়িগুলোকে খেলনা গাড়ি মনে হত। যেন কেউ উপর থেকে রিমোট দিয়ে সেগুলোর গতি নিয়ন্ত্রণ করছে। মানুষগুলোকে পুতুল বলে মনে হত।

তখন ২০০১ সাল। বাড়িতে দেশ থেকে আসা অতিথি। যেহেতু পরদিন মঙ্গলবার আমাদের সাপ্তাহিক ছুটি, তাই রাতে খাবারের টেবিলে বসে সিদ্ধান্ত হয় খুব সকালে আমরা বেরিয়ে পড়ব টুইন টাওয়ার দেখার উদ্দেশ্যে। অনেক রাত অবধি আড্ডা হয়, গল্প হয়। রাতে দেরি করে ঘুমাতে যাই সবাই, বিধায় খুব ভোরে পরিকল্পনা মাফিক উঠা হয়নি সেদিন। সকালে স্বামীর হৈচৈ আর উচ্চস্বরে ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গে। ভয়ার্ত কন্ঠে ডাকছে, ” তাড়াতাড়ি উঠো, টুইন টাওয়ার ধ্বসে পড়েছে, টিভিতে দেখাচ্ছে “। আচ্‌মকা ঘুম ভাঙ্গাতে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সবকিছু ঘোরের মত স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। বুকের ভেতরে হাতুড়িপেটা শব্দ। কোনমতে লিভিং রুমে গিয়ে দেখি অতিথিরা সকলে টিভি সেটের সামনে বসে আছে। সবার চোখে মুখে ভয়, আতংক। টিভির দিকে তাকিয়ে দেখি লাইভ দেখাচ্ছে। একটি টাওয়ার কেমন করে ধুলোয় লুটিয়ে পড়েছে যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম। কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখি একলা দাঁড়িয়ে থাকা অন্য টাওয়ারটিতে শাঁ করে একটি প্লেন কোণাকোণি ঢুকে গেল। মুহূর্তেই সেটিও মিশে গেলো ধরণির বুকে। মিশে গেল অনেকগুলো জীবন। যে দেহগুলোতে ক্ষণিক আগেও প্রান ছিল। আমরা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে নির্বাক তাকিয়ে আছি। কেউ কোন কথা বলছি না। শুধু ‘ওহ্‌ মাই গড’ শব্দটি নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এল। আমাদের হাত-পা কাঁপছিল, বুক ধড়ফড় করছিল অনেকটা সময়। টিভিতে খবরের নিচের দিকে লাল রং এর ব্রেকিং নিউজ ছুটোছুটি করছিলো। হাত,পা, শরীর হিম হয়ে আসা সব নিউজ। অতিথিরা সেই রাতেই বাংলাদেশে ফিরে যাবার ফ্লাইট ছিল। কিন্তু সমস্ত ফ্লাইট বাতিল ঘোষণা করা হল। আমরা বেরিয়ে পড়লাম কিছু জরুরি কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সব দোকান পাট বন্ধ। বাস, ট্রেন বন্ধ। কেবলই ধুলা, ধোঁয়া আর শব্দ শহর জুড়ে। যারা সেদিন সকালে কর্মস্থলে গিয়েছিল, তাঁরা সকলেই মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছে। নর্দার্ন ব্লুবার্ড পর্যন্ত যেতেই দেখি কুইন্স ব্রিজ ধরে দলে দলে মানুষ ম্যানহাটন থেকে কুইন্সের দিকে ফিরছে। সর্বত্র কেমন এক আতংকিত পরিবেশ। সেইদিন বাড়ি ফিরে আমরা টিভি সেটের সামনে বসে নিউজ দেখে কাটিয়ে দেই। ভয়ংকর সব খবর। শিউরে উঠা খবর। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে ভবন দুটিতে আটকে পড়া মানুষজনের আর্ত চিৎকার, বাঁচাবার আকুতি, কেউ কেউ প্রিয়জনদের শেষ বিদায় জানিয়ে দেওয়া ম্যাসেজ, এসবের রেকর্ড শোনা যাচ্ছিল সব কয়টি চ্যানেলে। পরদিন ম্যানহাটনে কর্মস্থলে যাই। চারিদিকে সকলের চোখে, মুখে ভয় আর আতংক বিরাজ করছিল। সেইসাথে বেদনা ভারাক্রান্ত মনে মানুষ যার যার অবস্থান থেকে আর্ত মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছিল। আহতদের জন্যে কাজ করছিল সকলেই। আমার কর্মস্থল সিক্সথ এভিনিউয়ের ফার্মেসীতে সেদিন ব্যান্ডেজ সহ প্রাথমিক চিকিৎসার সকল আইটেম ফুরিয়ে গিয়েছিল।

বিচ্ছিন্নভাবে সব কয়টি হামলায় মোট ২,৯৯৭ জন মানুষের মৃত্যু হয়। আহত হয় ৬,০০০ এর অধিক মানুষ। সেই থেকে সন্ত্রাসবাদী হামলার ইতিহাসে পৃথিবীতে একটি কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে ৯ই সেপ্টেম্বর ২০০১ দিনটি। আর আমি হয়ে রইলাম ভয়াল সেই এগারোই সেপ্টেম্বর এর সময়ের সাক্ষী।

দীর্ঘ প্রায় একযুগেরও অধিক সময় পরে আবারো সেই স্থানে যাই বছর দুয়েক আগে, ইংল্যান্ড থেকে সপরিবারে বেড়াতে আসা বাল্যবন্ধুকে নিয়ে। ধ্বংসস্তূপের যায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে “ন্যাশনাল সেপ্টেম্বর ইলেভেন মেমোরিয়াল এন্ড মিউজিয়াম”। ধ্বংসস্তূপের লোহা দিয়ে তৈরি করা জাহাজ পানিতে ভাসানো হয়। নিহতদের স্মরনে নির্মাণ করা হয় দুটি ফোয়ারা। সেখানে দেয়াল বেয়ে পানি ঝরছে অবিরত। যেন হাজারো মৃত মানুষের বিরামহীন কান্না। যেন তাঁদের বেঁচে থাকা প্রিয়জন কিংবা স্বজনদের বয়ে বেড়ানো কষ্টের নোনা জল। সেখানে লিখে রাখা মৃত মানুষগুলোর নামগুলো ছুঁয়ে দেখি। খুঁজে দেখার চেষ্টা করি আমার দেশের মানুষ ক’জনের নাম, যারা সেই ভোরে টাওয়ারগুলোয় কাজে গিয়ে আর ফিরেনি। জানি, এই খুঁজে ফেরা অনর্থক। জীবনের সবকিছুই অর্থবহ হয় না। কিছু অনুভূতি অর্থহীন কড়া নাড়ে অবচেতন মনে।

রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

৫৭৭জন ৫৮০জন

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ