মানুষের মন স্বরনহীন। আমি এই পোস্টে কিছু লিখলাম কিন্তু ভুল্বসত মুছে যায় আর মনে করতে পারি নাই। সে যাইহোক বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারীরা আজও অবহেলিত দলে বিদলে। কিন্তু কেন?

75

প্রতিরোধ ক্ষতের দাগ শুকায়নি ৭৮ উপজাতি পল্লীতে
সাঈদুর রহমান রিমন

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে গারো পাহাড়ি সীমান্তে গড়ে তোলা সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের কারণে পাঁচ সহস্রাধিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষ হয়েছে ৩৫ বছর আগে, কিন্তু এর দগদগে ক্ষত আজও রয়ে গেছে সীমান্তঘেঁষা ৭৮টি উপজাতি পল্লীতে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সময়ে তৎকালীন প্রশাসন প্রতিরোধ যুদ্ধে যাওয়ার অভিযোগ তুলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী গ্রামে গ্রামে বেপরোয়া লুটপাট চালায়। পানির দামে জমি বিক্রি করে সে টাকা মাসোয়ারা দিয়ে কোনোরকমে বেঁচে থাকতে হয়েছে অনেককে। এর পরও রেহাই মেলেনি নীপিড়ন-নির্যাতন থেকে।
ভুক্তভোগীরা আক্ষেপ করে জানান, শুধু প্রতিরোধ যুদ্ধ চলাকালে নয়, পরবর্তী সরকারগুলো ‘মুজিবভক্ত-দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে নানাভাবে হয়রানি চালিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরও সেই অবহেলা-বঞ্চনা অব্যাহত রয়েছে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বর্তমানে প্রতিরোধ যুদ্ধের সমর্থকদের কাদের বাহিনীর (কাদের সিদ্দিকী) লোক বলে অবজ্ঞা-নিপীড়ন চলছেই।’ দুর্গাপুরের বারোমারী গ্রামের শেখর হাগিদক ও শংকর হাগিদক প্রতিরোধ যুদ্ধে যাওয়ার কারণে তাদের বাবার আড়াইশ একর জমি বিক্রি থেকে পাওয়া সব টাকা হাতিয়ে নিয়েছে পুলিশ-বিডিআর। এত জমিজমার মালিক হওয়া সত্ত্বেও আজ শেখর-শংকরকে প্রায় ভূমিহীন অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ১৯৭৮ সালে দুর্গাপুরের বিরিশিরি এলাকায় বিপুল পরিমাণ সহায়সম্পদ ফেলে সপরিবারে পালাতে হয়েছিল জিতেন্দ্র ভৌমিককে। টানা ৩৭ বছর ধরে এই গেরিলা কমান্ডার ভারতের বিভিন্ন স্থানে নির্বাসন জীবন কাটিয়ে বড়ই ক্লান্ত। জীবনসায়াহ্নে অদম্য মনোবল নিয়ে তিনি দেশে ফিরে দেখতে পান, ঘরবাড়ি, ভিটেজমি কিছু নেই তার। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে পরিচালিত সশস্ত্র আন্দোলন চলাকালে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জন্য স্থাপিত হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন বারোমারী গ্রামের সূচনা ম্রং। তিনি এখন অন্যের জমিতে পাইট খেটে কষ্টেসৃষ্টে দুমুঠো খাবার খেতে পান। নিজের আশ্রয়ভিটা থেকেও তাড়িয়ে দেওয়ায় সূচনা ম্রং স্বামী-সন্তানদের নিয়ে অন্যের জমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন। দুঃখের কথা বলতে গিয়ে সূচনা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বদলা নিতে যারাই যুদ্ধে নেমেছিলেন, তারা সবাই চরম অভাব আর কষ্ট-যন্ত্রণায় ভুগছেন। তাদের কেউ তিন বেলা খেতে পারেন এমন নজির খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সূচনা বলেন, ‘কাদের সিদ্দিকী সাহেব মাঝেমধ্যেই খোঁজখবর নিতেন। কিন্তু একা একা তিনি আর কতজনের খবর নেবেন।’ প্রতিরোধ যুদ্ধের গেরিলা কমান্ডার ধোবাউড়ার বিজন মৃ বলেন, ‘পিতা হত্যার বদলা নিতে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করতেই সংগ্রামী জীবন বেছে নিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে জীবিত ফিরে ৩৪টি বছর ধরে পরাজিত সৈনিক হিসেবে তুষের আগুনে জ্বলতে হয়েছে! আমার মতো শত শত আদিবাসী দামাল ছেলে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা কেউ আর জীবনের স্বাভাবিকতায় ফিরতে পারেনি। পড়াশোনা চালাতে পারেনি। চাকরি পায়নি। তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা বেঁচে আছে, তারা ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসেছে।’ প্রতিরোধ যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে বার বার ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে অংশ নেওয়া বিজয় রিছিল বলেন, ‘পিতার রক্তের বদলা নিতে ছেলেদের যা দরকার তা করারই চেষ্টা চালিয়েছি, যে কারণে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগ নিতেও ঘৃণা বোধ করেছি। ২৬ বছর আসামে নির্বাসনে থেকেছি।’ অভাব আর কষ্টে নিষ্পেষিত বিজয় রিছিল বলেন, ‘পঁচাত্তরে আর দশজনের মতো নীরব থাকলে আমাদের জীবন হয়তো অন্য রকম হতো। আর যা-ই হোক অন্যের বাড়িতে দিনমজুরি খাটতে হতো না। প্রতিরোধে যুদ্ধ অংশ নেওয়ার কারণে আমরা সর্বস্বহারা হয়ে গেছি। তবু সান্ত্বনা এই যে, পিতৃহত্যার প্রতিবাদ করতে পেরেছি এবং সে প্রতিবাদ ছিল বীরত্বের। প্রতিরোধ যুদ্ধ চলাকালে জিয়ার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় আসার ব্যাপারেও আমি বিন্দুমাত্র রাজি ছিলাম না, তাই দীর্ঘ ২৬ বছর মেঘালয়েরই বিভিন্ন এলাকায় নির্বাসনে ছিলাম। শেখ হাসিনার সরকার গঠনের পর ১৯৯৭ সালে দেশে ফিরে আসি। কিন্তু তত দিনে জমিজিরাত, ভিটেমাটি সব শেষ। এখন দিনমজুরি খেটে জীবন চলছে। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দণ্ড ঘোষণার পর মনে হয়েছে, আমাদের প্রতিরোধ যুদ্ধ ছিল সার্থক। শেলেসটিন রুগা বলেন, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সর্বজনীন অংশগ্রহণের ভিত্তিতে এক বিশাল জনযুদ্ধ। মত-ভিন্নমত সবাই অংশ নিয়েছিলেন সে যুদ্ধে। সহযোগিতাও পাওয়া গেছে সর্বত্র। কিন্তু পঁচাত্তরের প্রতিরোধ যুদ্ধ ছিল একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির আর কষ্টসাধ্যের। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত লোকজনই কেবল সে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। সে ক্ষেত্রেও অনেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে তাদের। যুদ্ধক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কোনোরকম সহযোগিতা পাওয়া যায়নি বললেই চলে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে কষ্ট পাওয়া, ক্ষুব্ধ হওয়া লোকেরাও আমাদের পাশে এসে দাঁড়াননি। ফলে পঁচাত্তরের যুদ্ধে আমাদের অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়েছে। দীর্ঘ ২২ মাস যুদ্ধকালে কোনো দিন দুই বেলা খাবার পেয়েছে এমন প্রতিরোধ যোদ্ধা ছিল না।
দীর্ঘ সময় ধরে গাছের নিচে রাত যাপন, একবেলা-আধাপেটা খাওয়া, ঝরনার পানি সেবনই ছিল আমাদের সম্বল। এর পরও কোনো যোদ্ধাকে এতটুকু টলতে দেখিনি। কাউকে শুনিনি যুদ্ধে ক্ষান্ত দিতে। প্রতিদিন অভিযানে যাওয়ার জন্য প্রতিটি যোদ্ধার সে কি আকুতি! ক্যাম্প কমান্ডাররা তাদের সামাল দিতেই গলদঘর্ম হয়ে পড়তেন।’ গারো জনগোষ্ঠীর নেতা, দুর্গাপুর মহিলা কলেজের অধ্যাপক রেমন্ড আড়েং বলেন, ‘জাতির পিতা হত্যার প্রতিবাদে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অগ্রজরা যুদ্ধ করেছেন এটি আমাদের গৌরব। তবে এ যুদ্ধে আমরা অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছি।’ তিনি জানান, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গারো পাহাড়ি এলাকার গারো-হাজং-কোচ-বানাই-ডালু জনগোষ্ঠী মিলিয়ে অন্তত ১২ হাজার মানুষ জমি-জিরাত, সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। পাঁচ বছর না পেরোতেই শুরু হয় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। তখন সমগ্র দেশবাসীর মতো গারো পাহাড়ি সীমান্তের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন স্বজন-পরিজন সহায়-সম্পদ হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়। এর চার বছর পার না হতেই পঁচাত্তর সালে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। ফলে আবার পাঁচ সহস্রাধিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবার শরণার্থী হয়ে মেঘালয়ের পাহাড়ে অমানবিক জীবনযাপনে বাধ্য হয়। এ ছাড়া আরও যে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে তা হলো প্রতিরোধ যুদ্ধের কারণে অন্তত চারটি প্রজন্ম নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। প্রশাসনও প্রতিরোধ যুদ্ধে যাওয়ার অভিযোগ তুলে আদিবাসী পল্লীগুলোতে বেপরোয়া লুটপাট চালাতে থাকে। পানির দামে জমি বিক্রি করে সে টাকা পুলিশ-বিডিআরের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন আদিবাসীরা। এর পরও নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে রেহাই মেলেনি। আরেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নেতা স্বপন হাজং তুলে ধরেছেন ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত বিবরণ। তিনি জানান, ‘প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার অপরাধে ৭৮টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পল্লীর পাঁচ হাজার অধিবাসী তাদের সহায়-সম্বল হারিয়েছে। হাতছাড়া হয়েছে আট থেকে দশ হাজার একর ফসলি জমি। একের পর এক আক্রোশমূলক মামলার শিকার হয়েছে আরও সাত-আটশ মানুষ। অনেকে বিনা অপরাধে বছরের পর বছর জেলে থেকে জীবনের মূল্যবান সময় হারিয়ে এখন ন্যুব্জ মানুষে পরিণত হয়েছেন।’
অধ্যাপক অঞ্জন ম্রং বলেন, ‘আমরা প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়ায় আমাদের অন্তত চারটি প্রজন্ম নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছি। ১৯৭৫ সালে ক্লাস এইট থেকে ইন্টারমিডিয়েটে পড়া ছাত্রদের অধিকাংশই প্রতিরোধ যোদ্ধা হিসেবে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে আর তারা শিক্ষাঙ্গনে ফিরতে পারেননি। বরং সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দুষ্কৃতকারী আখ্যা নিয়ে অনেকটা পলায়নপর জীবনযাপনে বাধ্য হন। ফলে আদিবাসীরা এ চারটি প্রজন্মের নেতৃত্ব এবং মেধার সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।’

৬১৫জন ৬১৫জন

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ