সেদিন দাঁড়িয়ে আছি চৌরাস্তার মোড়ে। তের চৌদ্দ বছর বয়সের একটি ছেলে হেঁটে আসছে। লিকলিকে চেহারা, মলিন মুখ, চোখ ছলছল। ডেকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে তোমার? এই সময় এমন মন খারাপ করে কোত্থেকে এলে? আর যাচ্ছোই বা কোথায়? কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বুঝতে বাকি রইল না যে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া বইয়ের বোঝা বহন করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। কাঁধে চাপানো বইয়ের ব্যাগের চেয়ে অনেক বড় বোঝা তার মাথার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা না হলে এই পড়ন্ত বিকেলে যে ছেলেটির খেলার মাঠে থাকবার কথা, সে কিনা মন খারাপ করে রাস্তায় হাঁটেছে হন্তদন্ত হয়ে।
তাকে নিয়ে বাবা মায়ের অনেক বড় স্বপ্ন। ছেলে বিদ্বান হবে। অনেক বড় অফিসার হবে। তা না হলে বাবা-মা সমাজে মুখ দেখাবেন কি করে! কলিগের মেয়ে গত পরীক্ষায় গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছে। পাশের বাসার মেয়েটাও চান্স পেয়েছে মেডিকেলে। বড় ছেলে রাজনৈতিক দলের বড় ক্যাডার। তার ভয়ে বাঘে মোষে এক ঘাটে জল খায়। আর বড় মেয়ে? সেও অফিসের অনেক বড় অফিসার। তার দাপটেও অফিসের সবাই তটস্থ। লাখ টাকা মাইনে। বেতন ছাড়া উপরি ইনকাম আরও অনেক বেশি। তাই সে ইচ্ছা করলে অফিসের সবাইকে নিজের ইচ্ছামতো নাচাতে পারে, সমাজের আর দশজনকে পায়ের নীচে রাখতে পারে। বাবা মা বুক ফুলিয়ে সবার কাছে বলতে পারে আমি অমুকের বাবা, আমি অমুকের মা। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এটি খুবই দুঃখজনক। একজন সন্তানকে চিনতে গেলে তো আগে বাবা মাকেই চেনার কথা। হ্যাঁ হ্যাঁ ওই ছেলেটা? সে তো অমুক সাহেবের ছেলে। কিন্তু পৃথিবী উল্টে গেল নাকি!
সভ্যতার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিচয়ের রীতিটাও পাল্টে গেছে বুঝি? সারাক্ষণ অসুস্থ এক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে আমাদের সন্তানেরা। পড়াশুনা করে ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, অনেক বড় অফিসার হতে হবে, মন্ত্রী- এমপি- আমলা হতে হবে। ক্লাসে প্রথম হতে হবে, জিপিএ ফাইভ পেতে হবে, সবসময় বড় হতে হবে! কিন্তু আমাদের সন্তানেরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠছে কি না, তা কেউ ভেবে দেখছি না। তাই যে সোনালী বিকালে ছেলেটি খেলার মাঠে বা সাংস্কৃতিক চর্চায় থাকবার কথা, সে বইয়ের বোঝা কাঁধে হতাশায় ডুবে যাচ্ছে। হয়তোবা কেউ কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বড় অফিসার হচ্ছে, এলাকার চাঁদাবাজ, বখাটে রাজনৈতিক ক্যাডার হচ্ছে। কিন্তু সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠছে না। সুতরাং তাদেরকে নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। চলুন তাদেরকে সত্যিকারের মানুষ হবার উৎসাহ জোগায়। তাদের জন্য ভালোবাসার প্রাণ খুলে দিই। দরজা খুলে দিই, জানালা খুলে দিই, খেলার মাঠ – সাংস্কৃতিক চর্চার পথ খুলে দিই। ওরা প্রাণখুলে শ্বাস নিক, সত্যিকারের মানুষ হবার দৃঢ় শপথ নিক।
৮টি মন্তব্য
হালিমা আক্তার
চমৎকার লেখা। আমরা ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার, অফিসার হচ্ছি কিন্তু মানুষ হচ্ছি না। যেটা সবচেয়ে আগে প্রয়োজন সেটা নিয়ে ভাবছি না। লাগামহীন ঘোড়ার মতো দৌড়াচ্ছি। শুভ রাত্রি।
হালিম নজরুল
পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপু।
সাবিনা ইয়াসমিন
সন্তানদের প্রকৃত মানুষ বানাতে হলে নিজেদেরকে আগে প্রকৃত মানুষ বানানো লাগবে। বর্তমান সমাজ আমরাই তৈরি করেছি। প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের বাচ্চাদের উপর নিজেদের চাওয়া গুলো চাপিয়ে দিয়ে বোঝাচ্ছি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে নইলে এই কর্পোরেট সমাজে মানুষ হয়ে জন্ম নিলেও তোমাদের মানুষ হবার যোগ্যতা থাকবে না। অথচ আমাদের সন্তানদের এটা বোঝাতে ব্যর্থ হচ্ছি যে, একটা সুন্দর দেশ এবং সমাজ গড়তে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার আমলা কামলা সবই লাগে, তোমরা তোমাদের পছন্দমতো পেশা/জীবিকার উদ্যেশ্য নিজেদের তেমনি করে তৈরি করে নাও। শুধু পড়ার জন্য না পড়ে জ্ঞান অর্জন করো, সুশিক্ষিত হও,ভালো মানুষ হও।আমরা তোমাদের পাশে আছি। আফসোস, আমরা আমাদের সন্তানদের এগুলো বলিনা। আমাদের স্বপ্নসাধ ওদের উপর চাপিয়ে দিয়ে ওদের শৈশবের সন্ধ্যা /কৈশোরের বিকেল, তারুন্যর উদ্দিপনা সব কিছু নানারকম প্রতিযোগিতার মাঝে বিলিন করে দেই।
ভালো থাকুন ভাই, শুভ কামনা 🌹🌹
হালিম নজরুল
একদম ঠিক বলেছেন আপু। ধন্যবাদ।
আলমগীর সরকার লিটন
একটা মানুষ হওয়াটাই বড় কথা মানুষ্যত্ব না থাকলে এত বড় হয়ে কি হবে কবি দা ভাল থাকবেন
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ ভাই।
মোঃ মজিবর রহমান
টাকার কদর সবসময় ছিলো আছে থাকবেও। কিন্তু নিজ সন্তানকে নিজের আয় অনুযায়ী বা নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী পরিচালনা করার উপর আপ্রাণ চেশটা থাকা বাঞ্চনীয়।
আর সন্তানকে মানবতার দেওয়ালে গড়ে তুলতে হবে।
হালিম নজরুল
ঠিক বলেছেন ভাই। ধন্যবাদ।