❝জয় বাবা লোকনাথ

লোকনাথ ব্রহ্মচারী, যাঁকে ভক্তেরা “বাবা লোকনাথ” নামে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি ছিলেন এক পরম তপস্বী ও ধর্মানুরাগী সন্ন্যাসী। যাঁর জীবন ও বাণী কোটি মানুষের বিশ্বাস ও আস্থার কেন্দ্রে স্থান পেয়েছে। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর তিরোধান দিবস পালিত হয় বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের ত্রয়োদশী তিথিতে, যা সাধারণত ইংরেজি মে–জুন মাসে পড়ে। এই দিনটি ভক্তদের কাছে পবিত্র, আশীর্বাদময় এবং গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে।

লোকনাথ ব্রহ্মচারীর তিরোধান দিবস উপলক্ষে ভক্তসমাজে এক বৃহৎ উৎসবের রূপ নেয়। আজকের এই দিনে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ১০নং ওয়ার্ড গোদনাইল হাজারীবাগ (দক্ষিণ) লোকনাথ ব্রহ্মচারী মন্দিরে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী তিরোধান দিবস উপলক্ষে তাঁর ভক্তদের মনের দুঃখকষ্ট দূরীকরণ ও কামনা-বাসনা পুরণের আশায় দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়েছে।

তিরোধান দিবস উপলক্ষে গোদনাইল হাজারীবাগ এলাকার স্থানীয় ভক্তরা উপবাস, পূজা, কীর্তন, ধ্যান এবং আশ্রম পরিদর্শনের মাধ্যমে লোকনাথ বাবার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ভক্তরা মনে করেন এটি একটি মহাপবিত্র তিথি, তথা  সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা হিন্দুধর্মাবলম্বী ভক্তদের জন্য গভীর আস্থার উৎস।

লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবন সংক্ষেপে—লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জন্ম হয় ১৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে (বাংলা ১১৩৭) নদীয়া জেলার চৌমোহন গ্রামে (বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনার অন্তর্গত)। তাঁর পিতা রামনারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এবং মাতা কমলা দেবী ছিলেন ধর্মপরায়ণ ব্রাহ্মণ দম্পতি। জন্ম থেকেই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিকতার স্পষ্ট ছাপ দেখা যায়। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে সন্ন্যাস গ্রহণ এবং পরবর্তীকালে দীর্ঘ ৫০ বছর তপস্যা করেন হিমালয়ে। হিমালয় থেকে তিব্বত হয়ে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার সুন্দর একটা গ্রাম বারদীতে অবস্থান নেন। এই বারদী গ্রামেই তিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত বহু ভক্তের মন জয় করেন এবং এখানেই তিনি তাঁর দেহত্যাগ করেন।

বারদী আগমনের পটভূমি—লোকনাথ ব্রহ্মচারী বহু বছর হিমালয়ে তপস্যা করার পর যখন পৃথিবীর মানুষের কল্যাণে ফিরে ভাবনা তাঁর মনে জাগ্রত হয়, তখন তিনি হিমালয় থেকে তিব্বত হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো ভ্রমণ করে বারদীতে পৌঁছান। তারপর থেকে তাঁর শেষ জীবনের অধ্যায় পর্যন্ত বারদীতে বসবাস করেন।

কথিত আছে, ঈশ্বরের আদেশে তিনি বারদী আসেন এবং এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ২৪টি বছর তিনি এখানেই অতিবাহিত করেন। এই সময়কালে তিনি বহু অসুস্থ, দুঃখী ও আশাহীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন—চিকিৎসা করেছেন অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে, পরামর্শ দিয়েছেন এবং আধ্যাত্মিক উপদেশে প্রেরণা যুগিয়েছেন।

বারদী আশ্রমেও এই দিবসটি বিশেষভাবে উদ্‌যাপিত হয়: বারদী সেই সময় ছিল শান্ত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা একটি গ্রাম। এখানেই গড়ে ওঠে তাঁর আশ্রম। ধীরে ধীরে সেটি রূপ নেয় এক মহাতীর্থে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ এই পবিত্র স্থানে এসে ভক্তিসহকারে লোকনাথ বাবার আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।

লোকনাথ বাবার প্রতি অসংখ্য ভক্তরা লোকনাথ ব্রহ্মচারী “জীবন্ত ঈশ্বর” বলে বিশ্বাস করেন, যিনি মৃত্যুর পূর্বে নিজেই বলেছিলেন:

যখনই বিপদে পড়বে, আমাকে স্মরণ করবে—আমি তোমাদের রক্ষা করব।”

তিরোধান দিবস পালনের মূল বৈশিষ্ট্য—দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ লোকনাথ মন্দিরে গিয়ে পুজো দেন, উপবাস পালন করেন এবং সারারাত ধরে কীর্তন, পাঠ ও ধ্যান করেন। বিশেষত, বরাহনগর লোকনাথ আশ্রম (উত্তর কলকাতা) বাংলাদেশের অন্যান্য আশ্রমে যা হয়—

মহাস্নান ও পূজা-অর্চনা

ভোগ নিবেদন ও প্রসাদ বিতরণ

আখণ্ড নামকীর্তন ও রাতভর ভজন

দীপ্ত আলোয় সজ্জিত আশ্রম প্রাঙ্গণ

ভক্তদের বিশেষ প্রার্থনা ও মানসিক সংকল্প—এই বিশ্বাসে মানুষ আজও তাঁর কাছে সংকটের সময় প্রার্থনা করে এবং বলে থাকেন—“লোকনাথ বাবা আমাদের পাশে আছেন।”

”বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আবির্ভাব দিবস উপলক্ষে আজ ১৯শে জৈষ্ঠ্য-১৪৩২ বংগাব্দ ৩ জুন-২০২৫ইং নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১০নং ওয়ার্ডে অবস্থিত গোদনাইল হাজারীবাগ লোকনাথ ব্রহ্মচারী মন্দিরে আজ পবিত্র তিরোধান দিবস পালিত হচ্ছে অত্যন্ত ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও উৎসবমুখর পরিবেশে। সকাল থেকে মন্দির চত্বর ছিলো শত শত ভক্তের পদচারণায় মুখর।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর তিরোধান দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই এই দিনে আয়োজিত হয় নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এবারের তিরোধান দিবস উপলক্ষে আয়োজনে ছিলো ভোরবেলা মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বলন, পূর্ণাহুতি সহ বিশেষ হোমযজ্ঞ, ব্রহ্মচারী বাবার পূজা-অর্চনা, নামসংকীর্তন ও প্রসাদ বিতরণ।

সকাল আটটা থেকে শুরু হয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। মন্দিরে থাকা পুরোহিতদের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয় লোকনাথ বাবার মহাপূজা ও চন্ডীপাঠ। দুপুরে শতাধিক ভক্তের জন্য আয়োজন করা হয় মহাপ্রসাদ।

গোদনাইল হাজারীবাগ লোকনাথ ব্রহ্মচারী মন্দিরের পুরোহিত শ্রী বিশ্বজীৎ চক্রবর্তী ও মন্দির কমিটির সভাপতি শ্রী পবিত্র চন্দ্র বর্মন জানান, “লোকনাথ ব্রহ্মচারী আমাদের আত্মিক শক্তির উৎস। প্রতিবছর আমরা সাধ্যানুসারে এই দিনটি পালনের চেষ্টা করি। এলাকার মানুষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। বাবার কৃপায় এবারের আয়োজন সুন্দরভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।”

মন্দিরে আগত ভক্তদের জন্য ছিলো নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার বিশেষ ব্যবস্থা। স্থানীয় যুবসমাজ ও স্বেচ্ছাসেবীরা সার্বক্ষণিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এই উপলক্ষে মন্দির চত্বর রঙিন আলোকসজ্জা ও ফুলে সাজানো হয়। সন্ধ্যায় আয়োজিত হবে বিশেষ আলোচনাসভা ও ভজনসন্ধ্যা, যেখানে স্থানীয় কীর্তন দল পরিবেশন করবে বাবার গুণগান।

লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু মানুষ প্রতিদিন মন্দিরে প্রার্থনার জন্য আসেন। তবে তিরোধান  দিবসের এই অনুষ্ঠান তাদের কাছে এক পবিত্র মিলনক্ষেত্র—একসঙ্গে প্রার্থনা, সমবেদনা ও আত্মিক উপলব্ধির দিন।

মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে সবাই এই দিনটিকে যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য আহ্বান জানানো হয়

 

৩০জন ১জন

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ