ছোটবেলায় মায়ের কাছে সবচেয়ে বেশি বকা আর মার খেতাম যে কারণে, সেটা হল গল্পের বই পড়া। খুব নেশা ছিল বই পড়ার। একটা বই শেষ না হওয়া পর্যন্ত না পারতাম ঘুমাতে, না পারতাম পড়াশোনায় মন বসাতে। কখনো পড়ার বইয়ের মাঝখানে রেখে, কখনো বিকেলে ঘুমের নাম করে, কখনোবা রাতে মা ঘুমিয়ে পড়লে! বই শেষ না হওয়া পর্যন্ত শান্তি পেতাম না।
বিকেলে প্রায়ই খেলতে যেতাম বাসার নীচের গ্যারেজে…দড়িলাফ, বরফ পানি, মাংস-চোর এগুলোই বেশি খেলতাম। শহরে ছিলাম, বড় মাঠ কিংবা খেলার জায়গা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। আর এজন্যই আমাকে আর আমার ভাইকে ‘ফার্মের মুরগি’ উপাধি দিয়েছিলেন একাধিকজন। খুব মন খারাপ হতো। তবে নামকরা স্কুলে পড়তাম বলে কদরও নেহায়েত কম পাইনি।
আকর্ষণ ছিল কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্রতি। টানা কয়েকদিন ছুটি পেলেই খালার বাসায় কিংবা মামাবাড়ি ঘুরতে যাওয়ার যেই আনন্দ, ভাষায় প্রকাশ করার মত না। আর মায়ের কথামত ভালো রেজাল্ট করতে পারলে বাইরের দোকানে খাওয়ার সুযোগ হতো গুণে গুণে বছরে তিনবার, কারণ বড় পরীক্ষাও যে হতো বছরে তিনটা!
খুব অবাক লাগে এখনকার বাচ্চাদের দেখলে। হাঁটতে কিংবা কথা বলতে শেখার আগেই শিখে ফেলে মোবাইল চালানো। আগের মত এখনের বাচ্চাদের মধ্যে বই পড়া, খেলতে যাওয়া, আত্মীয়স্বজনের সাথে আন্তরিকতা বজায় রাখা কিংবা কোনো ভাল শখের চর্চা করা-এসব দেখা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
অবশ্য বাচ্চাগুলোকে দোষ দিয়ে কী লাভ মাটির পুতুলের মত তারা, যা দেখে তাই শিখে। আমরা প্রাপ্তবয়স্করা যেভাবে এই ৫ ইঞ্চি/৩ ইঞ্চি একটা বাক্সের মধ্যে আটকা পড়ে গেছি, সেখান থেকে বের হয়ে বাস্তব জীবনে পুরোপুরি ফিরে আসতে পারি কয়জন? সারাক্ষনই মোবাইলের নানান নোটিফিকেশনের চিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকি। ইউটিউবের নানা রঙচঙে ভিডিও যেন মাতিয়ে রাখে সারাদিন। বাসায় মা বাচ্চাদের চেয়ে এই যাদুর বাক্সটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। বাবারা অফিস শেষে ফিরে পরিবারকে সময় না দিয়ে পড়ে থাকে মোবাইল নিয়ে।
আর যারা একটু বয়স্ক, তারা বন্দী হয়েছে টেলিভিশনের বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলে। টিভির সামনে বসে একের পর এক সিরিয়াল দেখেই চলেন তারা। কোন শিক্ষণীয় কিছু নেই, জেনেও চোখ ফিরাতে পারেন না।
চারপাশের সবাই এখন বাক্সবন্দি; কেউ বুঝে, কেউবা না বুঝে। বড্ড আত্মকেন্দ্রিক বানিয়ে ফেলেছে আমাদেরকে এই বাক্সগুলো। একটা ভ্রমের মধ্যে সবাইকে ডুবিয়ে রেখেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় সেখানে, বেরিয়ে আসা বড়ই দুঃসাধ্য…
১৪টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
ভালই উপমা দিলেন ‘ বাক্সবন্দি’।
বর্তমানের ছোটরা আমাদের দেখেই শেখে।
” বরফ পানি, মাংস-চোর ” – এই খেলা আবার কেমন? এই প্রথম শুনলাম।
ভাল লেগেছে।
পথহারা পাখি
বর্ণনা করে বুঝানো কষ্টকর 😐
পথহারা পাখি
https://youtu.be/I5dFnj4MCfA
জিসান শা ইকরাম
এটাকে আমাদের এদিকে ‘ ছোয়াছুয়ি :বলে
মাহমুদ আল মেহেদী
জেনেও চোখ ফেরাতে পারিনা কেন ? কেন? আস্বাধারন লিখেছেন ।
পথহারা পাখি
ধন্যবাদ 😊
সাবিনা ইয়াসমিন
একবার বাক্সবন্দি হয়ে গেলে বেরিয়ে আসাটা কষ্টকর।তবে অসম্ভব নয়।আর বাচ্চাদের বাক্সবন্দি করা থেকে অবশ্যই বিরত রাখতে হবে।বাচ্চারা কাদা মাটির মতো,,যেভাবে তৈরি করা হবে সে ছাঁচেই গড়ে উঠবে।অনেক সুন্দর লিখেছেন।শুভকামনা রইলো। -{@
পথহারা পাখি
অবশ্যই সম্ভব, আর এই বাচ্চাগুলোকে বাঁচাতে পারে একমাত্র মা-বাবারাই… 🙂
সাবিনা ইয়াসমিন
সঠিক বলেছেন। -{@
রিতু জাহান
বাক্সবন্দী জীবন। সত্যিই তাই। আমার শৈশব বড় নির্মল। এদিক থেকে আমি খুব ভাগ্যবান। দুঃখ হয় নিজের দুই সন্তানের জন্য। একজনের শৈশব ও কৈশোর আমি নষ্ট করে পাঠিয়ে দিয়েছি। আর একজনকে সে চেষ্টা ন্য নিজেকে কম অপরাধী আমি ভাবি না।
বড় নিষ্ঠুর এক জাতি তৈরি করছি আমরা।
বেশ সুন্দর উপমা দিয়ে লিখেছেন।
লিখুন বেশি বেশি। শুভকামনা রইলো।
পথহারা পাখি
সত্যিই…খুব নিষ্ঠুর আর আত্মকেন্দ্রিক তারা। আগের মত সেরকম করে আর চারিত্রিক গুণগুলো চর্চা করার প্রবণতা বা সুযোগ কোনটাই নেই এখনকার বাচ্চাদের মধ্যে। ।
মায়াবতী
বাক্সবন্দি দেহ মন আর অস্তিত্ব নিয়ে ই আমরা আগামী প্রজন্ম কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি , শেষ পর্যন্ত কিন্ত সেই বাক্সবন্দী ই হয়ে যাবো সবাই আসলে । বিধাতা ই আমাদের বাক্সবন্দি করে রেখেছেন হয়তো।
পথহারা পাখি
জ্বী।
আগে মানুষ মৃত্যুর পর বাক্সবন্দি হতো। আর এখন এসব বাক্সের পাল্লায় পড়ে শারীরিক মৃত্যুর অনেক আগেই মানসিক মৃত্যু হয়ে যায় আমাদের। (-3
নীলাঞ্জনা নীলা
সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পালটে যায়। এই যে আমরা কাগজে-কলমে কি লিখি? বরং টাইপ করি সেলফোন কিংবা ল্যাপটপে। লেখালেখির জন্য একসময় পত্রিকা, ম্যাগাজিন এসব ছাড়া কিছুই ছিলোনা। কারো লেখা পত্রিকার পাতায় স্থান পেতো, কারু বা না। সব-ই তো পাল্টেছে। বাক্সবন্দী জীবন ঠিকই, কিন্তু আমরা নিজেরাও কি এই সময়ের সাথে পালটে নিইনি? আমাদের জীবনটাই বৃত্তবন্দী।
ভালো থাকুন।