আমরা রওয়ানা হয়ে চলে এলাম সাইকেল, মাইক্রোফোন, হর্ন , কাগজপত্র নিয়ে। জেলা লীগ আমাদের সাথে সহযোগিতা করবে। আমরা প্রত্যেক থানায় ও মহকুমায় একটা করে কর্মী শিবির খুলব। আমাকে কলেজ ছেড়ে চলে আসতে হল ফরিদপুরে। ফরিদপুর শহরে মিটিং করতে এসেছি মাঝে মাঝে, কিন্তু কোনোদিন থাকি নাই। আমাকে ভার দেওয়ার জন্য মোহন মিয়া সাহেব ক্ষেপে যান। সকলকে সাবধান করে দেন, কেউ যেন আমাকে বাড়ি ভাড়া না দেয়। তিনি মুসলিম লীগের সভাপতি, কিন্তু আমাকে চান না। আমি আব্দুল হামিদ চৌধুরী ও মোল্লা জালালউদ্দিনকে সকল কিছু দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। হামিদ ও জালাল ফরিদপুর কলেজে পড়ত, তাদেরও লেখাপড়া ছেড়ে আসতে হল। শহরের উপরে কেউই বাড়ি দিতে রাজি হল না। আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় শহর থেকে একটু দূরে তার একটা দোতালা বাড়ি ছিল, ভাড়া দিতে রাজি হল। বাধ্য হয়ে আমাকে সেখানে থাকতে হল। সেখানে আমরা অফিস খুললাম, কর্মীদের ট্রেনিং দেয়ার বন্দোবস্ত হল। সমস্ত জেলায় ঘুরতে শুরু করলাম। মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ীতে অফিস খুলে দিলাম, কাজ শুরু হল। থানায় থানায়ও অফিস করলাম। এই সময় মাঝে মাঝে আমাকে কলকাতায় যেতে হত। শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব কিছুদিন পূর্বে একবার গোপালগঞ্জ এসেছিলেন। বিরাট সভা করে গিয়েছিলেন। এই সময় সালাম সাহেবের দল শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবকে সংবর্ধনা দিতে রাজি হয় নাই, কারণ আমার অনুরোধে তাঁরা এসেছিলেন। তাঁর দলবল প্রশ্ন করল, আমি মুসলিম লীগের একজন সদস্য মাত্র। অফিসিয়াল লীগের কেউই নই, এই নিয়ে ঝগড়া হয়ে গেল গোপালগঞ্জে। শহীদ সাহেব আসবার মাত্র দুইদিন পূর্বে আমি বললাম, আমি গোপালগঞ্জ মুসলিম লীগের জন্মদাতা। শহীদ সাহেব আসবেন, তাঁকে সংবর্ধনা দিব, যদি কেউ পারে যেন মোকাবেলা করে। আমি রাতে লোক পাঠিয়ে দিলাম। যেদিন দুপুরে শহীদ সাহেব আসবেন সেদিন সকালে কয়েক হাজার লোক সড়কি, বল্লম, দেশি অস্ত্র নিয়ে হাজির হল। সালাম সাহেবের লোকজনও এসেছিল। তিনি বাধা দেবার চেষ্টা করেন নাই। তবে শহীদ সাহেব, হাশিম সাহেব ও লাল মিয়া সাহেবের বক্তৃতা হয়ে গেলে সালাম সাহেব যখন বক্তৃতা করতে উঠলেন তখন ‘সালাম সাহেব জিন্দাবাদ’ দিলেই আমাদের লোকেরা মুর্দাবাদ দিয়ে উঠল। দুই পক্ষে গোলমাল শুরু হল। শেষপর্যন্ত সালাম সাহেবের লোকেরা চলে গেল। আমাদের লোকেরা তাদের পিছে ধাওয়া করল। শহীদ সাহেব মিটিং ছেড়ে দুই পক্ষের ভিতর ঢুকে পড়লেন। তখন দুই পক্ষের হাতেই ঢাল, তলোয়ার রয়েছে। কতজন খুন হবে ঠিক নাই। শহীদ সাহেব এইভাবে খালি হাতে দাঙ্গাকারী দুই দলের মধ্যে চলে আসতে পারেন দেখে সকলে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। হাশিম সাহেব পূর্বেই আমার বাড়িতে চলে গেছেন। এই ঘটনার জন্য শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব সালাম সাহেবের উপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন।
আবার শহীদ সাহেব মাদারীপুর হয়ে গোপালগঞ্জ এলেন জনমত যাচাই করতে। অনেক লোক ইলেকশনে দাঁড়াতে চায়, কার বেশি জনপ্রিয়তা দেখতে হবে। পূর্বেকার এমএলএ খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদ সাহেবও মুসলিম লীগে চলে এসেছেন, পেনশনপ্রাপ্ত ডেপুটি পুলিশ কমিশনার খান বাহাদুর সামসুদ্দোহা, আবদুস সালাম খান সাহেব এবং আরও দুই একজন ছিলেন। সালাম সাহেব ব্যক্তিগতভাবে গোপালগঞ্জে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। শতকরা আশি ভাগ লোকই তাঁকে চায়। সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ ছিল না। আমার আব্বাকে শহীদ সাহেব জিজ্ঞাসা করলে আব্বা বলেছিলেন, সালাম সাহেবকে লোকে চায়। তবে সালাম সাহেব ও খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব উভয়ই উপযুক্ত প্রার্থী। শহীদ সাহেব আমাকে বললেন, জনসাধারণ তো সালাম সাহেবকে চায়, তোমার আব্বাও তাকে সমর্থন করেন। আমি বললাম, লোকে যাকে চায়, তাকেই দিবেন, আমার কোনো আপত্তি নাই। এর পূর্বেই সালাম সাহেবের সাথেও আমার কথা হয়েছিল। কিন্তু হাশিম সাহেব কিছুতেই রাজি হলেন না। এর কারণ জানি না।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং- ৪৬ হতে ৪৭)
৬টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
সততার রাজনীতিতে কতো কতো বাধা পার করতে হয়, বঙ্গবন্ধুর এই আত্মজীবনী থেকে জানতে পারছি।
লিখুন রুবা’পু।
ঈদ মোবারক। -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এটাও জানা হচ্ছে সততার রাজনীতি কণ্টকাকীর্ণ কিন্তু জয় অবশ্যম্ভাবী।
শুভেচ্ছা নীলাদি।
নীলাঞ্জনা নীলা
সত্যের পথে অনেক বাঁধা, কিন্তু সবশেষে মিথ্যের পরাজয় হয়।
ভালো থাকুন রুবা’পু।
লীলাবতী
কত কিছু জানছি এই আত্মজীবনী পড়ে। ধন্যবাদ আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আমিও লিখছি আর ব্রেনে প্রতিটা বিষয় ধারন করছি।
ব্লগার সজীব
নিয়মিত প্রতিটি পর্ব পড়ছি আপু। বইটি পড়েছি, তাঁর চেয়ে আপনার এই পোষ্ট পড়ে ভাল লাগছে বেশি। মনে থাকবে এই ছোট ছোট অংশগুলো।