এই সময় ফজলুর রহমান সাহেব আমাকে ডাকলেন, তিনি চিফ হুইপ ছিলেন। আমাকে বললেন, “আপনাকে এই বারটার সময় আসাম-বেঙ্গল ট্রেনে রংপুর যেতে হবে। মুসলিম লীগের একজন এমএলএ যিনি ‘খান বাহাদুর’ও ছিলেন তাঁকে নিয়ে আসতে হবে। টেলিগ্রাম করেছি, লোকও পাঠিয়েছি, তবুও আসছেন না, আপনি না গেলে অন্য কেউই আনতে পারবে না। শহীদ সাহেব আপনাকে যেতে বলেছেন। আপনার জন টিকিট করা আছে।” কয়েকখানা চিঠি দিলেন। আমি বেকার হোস্টেলে এসে একটা হাত ব্যাগে কয়েকটা কাপড় নিয়ে সোজা স্টেশনে চলে আসলাম। খাওয়ার সময় পেলাম না। যুদ্ধের সময় কোথাও খাবার পাওয়াও কষ্টকর। ট্রেনে চেপে বসলাম। তখন ট্রেনের কোন সময়ও ঠিক ছিল না, মিলিটারিদের ইচ্ছামত চলত। রাত আটটায় রংপুর পৌঁছাব এটা ছিল ঠিক সময়, কিন্তু পৌঁছালাম রাত একটায়। পথে কিছু খেতেও পারি নাই, ভীষণ ভিড়। এর পূর্বে রংপুরে আমি কোনোদিন যাই নাই। শুনলাম স্টেশন থেকে শহর তিন মাইল দূরে। অনেক কষ্ট করে একটা রিকশা জোগাড় করা গেল। রিকশাওয়ালা খান বাহাদুর সাহেবের বাড়ি চিনে, আমাকে ঠিকই পৌঁছে দিল। আমি অনেক ডাকাডাকি করে তাঁকে তুললাম, চিঠি দিলাম। তিনি আমাকে জানেন। বললেন, “আগামীকাল আমি যাব। আজ ভোর পাঁচটায় যে ট্রেন আছে সে ট্রেনে যেতে পারব না।” আমি বললাম, “তাহলে আপনি চিঠি দিয়ে দেন, আমি ভোর পাঁচটার ট্রেনেই ফিরে যেতে চাই।” তিনি বললেন, “সেই ভাল হয়।” আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন না কিছু খাব কি না, পথে খেয়েছি কি না। বললেন, “এখন তো রাত তিনটা বাজে, বিছানার কি দরকার হবে?” বললাম, “দরকার নাই, যে সময়টা আছে বসেই কাটিয়ে দিব। ঘুমালে আর উঠতে পারব না খুবই ক্লান্ত।” একদিকে পেট টনটন করছে, অন্যদিকে অচেনা রংপুরের মশা। গতরাতে কলকাতায় বেকার হোস্টেলে ভাত খেয়েছি। বললাম, এক গ্লাস পানি পাঠিয়ে দিলে ভাল হয়। তিনি তার বাড়ির পাশেই কোথাও রিকশাওয়ালারা থাকে, তার একজনকে ডেকে বললেন, আমাকে যেন পাঁচটার ট্রেনে দিয়ে আসে। আমি চলে এলাম সকালের ট্রেনে।
কলকাতায় পৌঁছালাম আরেক সন্ধ্যায়। রাস্তায় চা বিস্কুট খেয়ে নিয়েছিলাম। রাতে আবার হোস্টেলে এসে ভাত খাই। ভীষণ কষ্ট পেয়েছি, ক্ষেপেও গিয়েছি। ফজলুর রহমান সাহেবকে বললাম, “আর কোনোদিন এই সমস্ত লোকদের কাছে যেতে বলবেন না।”
একদিন পরে তিনি এসেছিলেন। তাঁকে পাহারা দেয়ার জন্য লোক রাখা হয়েছিল। তবু পিছনের দরজা দিয়ে এক ফাঁকে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। খোঁজাখুঁজি করেও তাঁকে আর পাওয়া যায় নাই। আমরা ছাত্র ছিলাম, দেশকে ভালবাসতাম, দেশের জন্য কাজ করতাম, এই সকল জঘন্য নীচতা এই প্রথম দেখলাম, পরে যদিও অনেক দেখেছি, কিন্ত এই প্রথমবার। এই সমস্ত খান বাহাদুরদের দ্বারা পাকিস্তান আসবে, দেশ স্বাধীন হবে, ইংরেজকে তাড়ানোও যাবে, বিশ্বাস করতে যেন কষ্ট হত! মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান পূর্বে ছিল খান সাহেব, খান বাহাদুর ও বৃটিশ খেতাবধারীদের হাতে, আর এদের সাথে ছিল জমিদার, জোতদার শ্রেণীর লোকেরা। এদের দ্বারা কোনোদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হত না। শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব যদি বাংলার যুবক ও ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় না করতে পারতেন এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে টেনে আনতে না পারতেন, তাহলে কোনোদিনও পাকিস্তান আন্দোলন বাংলার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারত না। যদিও এই সমস্ত নেতাদের আমরা একটু বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করতে পারি নাই। যার ফলে পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই এই খান বাহাদুর ও বৃটিশ খেতাবধারীরা তৎপর হয়ে উঠে ক্ষমতা দখল করে ফেলল। কি কারণে এমন ঘটল তা পরবর্তী ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে যাবে।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং- ৩৪ ও ৩৫)
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী (পর্ব-২৬)
৯টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
এ সমস্ত খানবাহাদুরদের জন্যই ব্রিটিশরা রাজত্ত্ব করেছিলো দু’শো বছর ধরে আর এদের রক্তের ধারায় জন্ম নিয়েছিলো ওসব রাজাকার, আর পা চাটা তোষামোদকারী দালাল। ভাগ্য ভালো আমাদের বাংলায় একজন মুজিব এসেছিলেন। জানেন আপু সেদিন একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে পরিচয় হলো, উনার নাম মুজিব। আমায় বললেন আপনি মুজিব কে জানেন? বললাম কে? বাংলাদেশের জনপ্রিয় নেতা। খুব সাচ্চা দিলওয়ালা। বললাম তাই নাকি? তারপর বললাম আমি বাংলাদেশের। অনেক কথা বললো। পাকিস্তানকে দেখতে পারেনা সে। পাকিস্তানের দালালীতে আফগানিস্তানের এই অবস্থা আজ। আজকের এই যে জঙ্গিবাদ তা পাকিস্তান আর আমেরিকার তৈরী। বললো তোমাদের দেশটাও একদিন আফগান হয়ে যাবে, তার আগেই সবাইকে বোঝাতে হবে ধর্মের নামে খেলছে পাকিস্তানীরা।
ভিনদেশে নিজের দেশের কোনো ভালো কিছু শুনলে অনেক পাওয়া হয়ে যায়। আরোও একবার তার প্রমাণ পেলাম। চলুক আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
বিশ্বনেতা আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বিশ্বের বুকে চির অম্লান হয়েই থাকবেন।
সর্বকালেই এসব সুবিধাবাদী দালালদের কারণে জাতি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, পড়ছে। আর তাদের চিনিয়ে দিতেই যুগেযুগে জাতির ইতিহাসে ত্রাণকর্তার আবির্ভাব ঘটে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের তেমনই একজন।
শুন্য শুন্যালয়
অনেকগুলো পর্ব মিস হয়ে গেছে, তবুও সব গুলোই এক একটা গল্প। বৃটিশরা চলে যেতেও এদের কারনে বিভাজন, রক্তারক্তি কখনোই থেমে ছিলোনা। পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া একজন লোক খান বাহাদূর টাইটেলধারী ছিলেন, শুনলেও কেমন লাগে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
বৃটিশরা এসব টাইটেলের বিনিময়ে অলিখিত গোলামি চুক্তি করতো ব্যক্তিবিশেষের সাথে যেমনটা করছে এখন মার্কিনীরা। উদাহরণ হিসাবে আমাদের ডঃ ইউনুছ আর মালালা ইউসুফ এর নাম উল্লেখ করা যায়। এমন আরো অনেক আছে। আছে রকমফের ডিগ্রী।
হ্যাঁ, সবগুলোই এক একটা গল্প।
জিসান শা ইকরাম
মুসলিম লীগ রাজনীতিবিদরা অনেকেই এমন, সুযোগ বাদী যা পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে।
মোঃ মজিবর রহমান
(y)
মারজানা ফেরদৌস রুবা
প্রমাণিত।
মোঃ মজিবর রহমান
এই দালাল শ্রেনী এখন বেশি মাত্রাই বেড়ে উঠেছে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
দালালশ্রেনী বরাবরই বেপরোয়া।