আমার তুমি,
কেমন আছো? জানি, চাঁতকী হয়ে অপেক্ষায় দিন এখনো গুণছো। আমি আছিতো বেশ, ভাল মন্দের মাঝখানে যতটুকু আলো আছে। ফের চলে যাবো জীবন ও জীবিকার তাগিদে দূর দেশে, যখনই গাড়ী স্টার্ড বিমানবন্দরের উদ্দ্যেশ্যে, মনে পড়ে বারবার সেই বিদায়ী ক্ষণ..তোমার নয়নে আবেগী জল, চোখ ছল ছল, আমাকে আটকে রাখার ব্যর্থ বাড়ন্ত সেই পাণিটি মেলে দিয়ে যেনো বলতে চাইলে ‘না যেও না আর….। কী করবো নিরুপায়, জীবনের অনাগত ভবিষৎ যে এ পথ চলায়।
এখানে ব্যাস্ত সবাই, কারো দিকে কারো ফিরে তাকানোর সময়টুকু নেই। চিঠিতে হয়তো তুমি অনেকটা অভিমান সুরেই বলেছিলে, এই ব্যস্ততার মাঝে তোমার কথা কি মনে পড়ে কখনো? এতো সব স্কার্ট পড়ুয়া ললনাদের ভীড়ে মনে কি ছায়া পড়ে তোমার মুখচ্ছবি? বড় অবিস্বাসী তুমি! ভাবলে কি করে এমনটি! কর্মের ব্যস্ততা শুরু হয় ভোর রাত হতেই, কোন এক দানব সর্দারের ডাকে। তারপর ওয়াসিং! বাথরুমের সিরিয়ালের ঝামেলা শেষ করা, অনেক সময় ব্রেকফাষ্টবিহীন চড়তে হয় কর্ম যাতায়াতের লরিতে। কখনো কখনো সিরিয়ালের কারনে উদরের প্রকৃতির ডাক উদরেই মিশে যায়, বাধ্য হয়ে সময়ের কাছে পরাজয় স্বীকার করে বের হতে হয় কর্মে। তখনো চোখে প্রচন্ড ঘুম, ঘুমু ঘুমু ভাবে লরি চলে যায় তার কর্মস্থলে, আমি তন্দ্রায় স্বপ্নে উড়াই ফেলে আসা তোমার আমার রঙ্গীন দিনগুলি। দেহের ঘাম শুকিয়ে লবন তৈরী করে দেশের একমাত্র বড় আয় রেমিটেন্স বৃদ্ধি করে সংসারকে স্বচ্ছল রাখার আপ্রান চেষ্টা, এতো সব কষ্ট কাদের জন্য বলতে পারো?
তুমি হয়তো ভাবছো,খুব সুখেই থাকি প্রবাসে, খাচ্ছি-দাচ্ছি ঘুরছি-ফিরছি এনজয়ে জীবনের ইচ্ছে গুলোকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছি, তবুও এ সব ভাবনার মাঝে অন্ততঃ এটাও ভেবে নিও, এ মনটা পড়ে থাকে স্ব-দেশের মাটিতে, তোমাদের কাছে, সকাল বিকেল সর্বক্ষণ মিররের ন্যায় প্রতিবিম্ব হয়ে মিশে থাকো অন্তরে। প্রতিবার দেশ ত্যাগের অন্ততঃ দুই তিনটি মাস সব কিছুতেই মনে ধোকা ধোকা লাগে। কেমন জানি নিজের কাছে সব কিছুতেই অবিস্বাসী অবিস্বাসী লাগে, মনে হয় এই আমি দেশেই রয়ে গেছি, মনে হয় এই তুমি পাশে দাড়িয়ে এখনো ভ্যান ভ্যান করে বলছো “কত রাত হলো এবার তোমার নাপ্তার বক্স(ল্যাপটপ)হতে সোনেলা ব্লগের পৃষ্ঠাটা বন্ধ করো, ঘুমুতে যাবে”। এতো সব মধুর স্মৃতি ভুলি কি করে!
বিদেশের মাটিতে শ্রমিকের কাজ করে থাকেন কারো ছেলে, কারো স্বামী, কারো প্রেমিকা কারো বা বন্ধু বান্ধব। সবার একই ধারণা খুব সুখেই আছি আমরা, কাড়ি কাড়ি ডলার কামাই খুব সহজেই, কয়েক বছরেই কোটিপতি বনে যাই কিন্তু কেউ ভাবেন না এ সব অর্জনের নেপথ্যে কতটা ত্যাগ-তিতিক্ষা লুকিয়ে থাকে সবার মনে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। “আমরা বলতে পারি কষ্টের উভয় চরে বসবাস করি। প্রবাসে একাকিত্বের কষ্ট, অন্যদিকে স্ব-দেশে স্বজন হারানো বেদনা মনে পীড়া দেয় প্রতিটি মূহুর্ত। মাত্র তিনটি মাসের মাথায় জন্মদাতা,অন্নদাতা, যৌবনদাতা পিতাকে হারাই, অথচ দেখো! তোমরা কত ভাগ্যবান, পিতার বিয়োগের সমাধি নিজ নয়নে দেখে, নিজ হাতে করলে দাফন, নিজ আত্মাকে দিলে শান্তি আর আমি সেই সূ-দূরে প্রবাসে গত হওয়ার সংবাদটিও পেলাম অনেক দেরিতেই। তোমরা হয়তো ভেবেছো আমি এ খবর শুনলে না জানি কি করি। এভাবে বছরের পর বছর হারানো আত্মীয়, নিকটাত্মীয় পাড়া প্রতিবেশীদের পৃথিবী বিদায়ে নিয়মানুবর্তিতায় অনড়, অথচ নেই আমি…গত হওয়া খবরটি শুনতেও দেরী হয়। এ যে জীবনের জন্য কতটুকু আফসোস সৃষ্টি করে তা কেবল ভুক্তরাই বুঝে।
তারপরও যতই যোগ বিয়োগের খেলায় আমি অনুপস্থিত, এখন আর মনে আফসোসের দাগ কাটে না কেননা জেনে গেছি এ সব পাওয়া না পাওয়া, দেখা না দেখা সবই এ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর চিরাচরিত বেঁচে থাকার নিয়ম তাই পরিশ্রম আর কর্ম শেষে দূরালপনে যখনই তোমাদের কথা শুনি,…কেবলই শুনতে ইচ্ছে করে, এই ইচ্ছেটিতে কোন কৃত্তিমতা নেই, আছে ভালবাসার গভীরতার অব্যক্ত অনুভূতি।
প্রয়াত শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন স্যার বলেছিলেন, “যে রাগের সঙ্গে সামান্যতম হলেও ভালবাসা মেশান থাকে, সেই রাগ মেয়েদের রূপ বাড়িয়ে দেয়”। দেশে এলে মূলত সে জন্য কারনে অকারনে তোমার হৃদয়ে রাগ তোলার চেষ্টা করি। তোমার মাঝে সেই রূপটি বারবার দেখবো বলে তোমাকে রাগাই যা দেখে প্রথম তোমারই প্রেমে মজেছিলাম। চিঠিতে সেকালের প্রেমিক প্রেমিকারা কত সুন্দর সুন্দর বচন ব্যবহার করতেন এই ধরো..
“আঁতা গাছে তোতা পাখি”
“ভুলনা আমায়”
“যাও পাখি বলো তারে সে যেনো ভোলেনা মোরে”
আরো কত সুন্দর সুন্দর বাক্য ব্যবহার করেন, সে সুবাদে আমি না হয় দুএক লাইন লিখলাম তবে তাদের মতো নয়, একালের হাফ ডিজিটালের ভাষায়। অক্কা পাওয়া চিঠির সেই কালের জল ছাপের কাগজ আর লাল নীল খামে নয়, এ যুগের সোনেলার ডিজিটালের পাতায় পাতায়।
ভালবাসি তোমায় কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় যদি বলতে হয় তবে বলব,
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা”।
তার মতে আরো বলবো:
“ পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে; পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে”।
অনেকে বলেন বিয়ের পর প্রেম নাকি তেমন আর থাকে না, আমি মানতে নারাজ। আমার মতে বিয়ের পরই হয় প্রেমের আসল মজা। তখন একে অন্যের খুব কাছাকাছি থাকা হয় বিধায় তাদের মাঝের খুনসুটিও লেগে থাকে সব সময়। এ সব ভাললাগার গতিকে আরো গভীর করে আর ত্যাগের মহান বাক্যতো আছেই। দুজনের মাঝে কে আগে ত্যাগ স্বীকার করবে তা যদি নির্ধারিত ঠিক থাকে তবে খোদার কসম এ প্রেম অমরত্ত্বের দাবীদার। আমরা তেমনি একটি প্রেমের স্বাক্ষী হবো যা মরনের পরেও বিচ্ছেদের স্পর্শ পাবে না।
জানি, এ চিঠি যখন তুমি পড়বে তখন আমি বহুদূর, পড়ার সময় সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কল্পনায় রবে আমারই পাশা-পাশি আ-জীবন।
ইতি
তোমারি আমি।
২৩টি মন্তব্য
ব্লগার সজীব
প্রবাসীর চিঠি ভাল লেগেছে খুবই। চিঠির মাঝে জীবনানন্দের লেখা এনে চিঠিকে সমৃদ্ধ করেছেন ভাইয়া।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ধন্যবাদ
নীলাঞ্জনা নীলা
চিঠির মধ্যে কবিতা, বেশ লাগলো মনির ভাই।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
হুম ধন্যবাদ দিদি আমি ছন্দের বদলে কবিতা দিয়েছি। -{@
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আপনি লিখছেন কবে?
নীলাঞ্জনা নীলা
মনির ভাই এখনও লেখা শুরু করিনি। কিছুতেই লেখা আসছেনা। ^:^
প্রহেলিকা
চিঠি নয় যেন, প্রবাস জীবনের রোজনামচা। খুব ভালো লিখেছেন। এই জীবনটা আসলেই খুব কষ্টকর।
বেশ ভালো লেগেছে আমার কাছে মনির ভাই। প্রতিযোগিতা ধীরে ধীরে জমে উঠছে। শেষতক পর্যন্ত সাফল্য কামনা করি।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
যারা প্রবাসে আছেন শ্রমিকদের সাথে মিশেন খোজঁ খবর নেন তারা বুঝতে পারবেন কতটা কষ্টে তারা জীবন অতিবাহিত করেন।যদিও ডলার পাওয়া যায় তবে এ ডলার কামাইতে বিদেশীদের ফাষ্টার ফাষ্টার কথা শুনতে শুনতে দৌড় আর থামে না।ধন্যবাদ -{@
মৌনতা রিতু
দেখছি সবাই একদম কোমর বেঁধে নেমেছে। প্রবাস জীবন আসলেই খুব কষ্টের। আমরা দেশে থেকে আমাদের সাজানো গোছানো সংসারে এসব উপলব্দি করতে পারি না। তবে কি জানেন তো মনির ভাই, বৈবাহিক সম্পর্কে কখনো কখনো স্বামীর একটু দূরে থাকাও ভাল। তবে এই বিদেশ না। এটাকে আসলে জীবন বলে না। এটাকে বলে যান্ত্রিক জীবন। কতো যে কষ্ট করতে হয়ওদের তা আসলে ভাবার বাইরে।
ভাল লাগলো চিঠিটা বেশ। চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আমি দেখেছি বিদেশে এক নব্য বিবাহিত ব্যাক্তির কান্না।কি করুন কান্না তাকে জিজ্ঞাস করলাম আপনি এ ভাবে কাদছোঁ কেনো?সে বলল ভাইরে নতুন বিয়া করছি বউরে ছাইরা থাকতে মন চায় না।আবার কেউ তার সন্তানের মায়ায় আকুতি করছেন কেউ বা পিতা মাতার জন্য।
তবে হ্যা বিদেশে যদি কাজ কর্ম ঠিক থাকে তবে এরকম আফসোস থাকলেও মাস শেষে ডলারের গন্ধে সব সয়ে যায় ধীরে ধীরে।তবে আর যাই হোক পরদেশ আর নিজ দেশের সুখ দুঃখের পার্থক্যতো থাকবেই।ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য। -{@
মেহেরী তাজ
ভাইয়া বেশ ভালো লেগেছে চিঠি
প্রবাস জীবন যে মধুর নয় না এই চিঠি পড়লে অনেক টায় বুঝা যায়!
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ধন্যবাদ আপু -{@
মিষ্টি জিন
প্রবাস জীবন কত কষ্টের তা আমি নিজে দেখেছি এবং এঁখন এ দেখছি। আপনার চিঠিতেও তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
খুব সুন্দর চিঠি মনির ভাই।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
হুম তইতো আপনিও ওদের দেখে বুঝতে পারবেন আসলে যারা বিদেশ বিভুয়ে তারা কিছুটা এ ব্যাথা অনুভব করতে পারেন।আসলে ওরা অনেক কষ্ট করে এ দেশে টাকা পাঠায় আর সরকরী কোষাঘার ভরপুর হয়।নিজেদেরও একটু গতি হয়।ধন্যবাদ।
শুন্য শুন্যালয়
খুব সুন্দর চিঠি মনির ভাই। একজন প্রবাসীর দুঃখ, হাহাকার, ভালবাসা আবেগ সবকিছু ফুঁটে উঠেছে লেখায়। কোনকিছুই বাদ নেই। সাফল্য কামনা করছি প্রতিযোগিতার শেষ পর্যন্ত। শুভকামনা।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ধন্যবাদ -{@
চাটিগাঁ থেকে বাহার
প্রবাসীর মনের লুকানো ব্যদনা ভালো লাগলো বললে হয়তো আপনার খারাপ লাগবে। বলতে পারেন আপনাদের দু:খ কষ্ট দেখে হাসছি।
ভালো লিখেছেন। -{@ -{@
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সহমত ভাই শুভেচ্ছা নিরন্তর। -{@
রুম্পা রুমানা
অনেকের না বলা কথাগুলো আপনি বলে দিলেন , ভাই। কতো যে ত্যাগ আর সংগ্রাম থাকে প্রবাস জীবনে তা সবার পক্ষে বুঝা মুশকিল। শুভ কামনা রইলো।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
হ্যা তাদের ত্যাগের ফসল আমরা ভোগ করছি অথচ তাদের খবর লই না।ধন্যবাদ। -{@
অপার্থিব
ভাল লাগলো চিঠি। প্রবাসীদের দুঃখ বেদনার কিছু খন্ড চিত্র উঠে এসেছে লেখায়।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ধন্যবাদ ভাইয়া -{@
মোঃ মজিবর রহমান
চিঠির মাঝে কবিতা থাকলে পত্র ছন্দময় পায়। পড়ার এক দারুন তৃপ্তি আসে। আপনাকে ধন্যবাদ।