
‘আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া, চম্পা কুঞ্জে আজি গুঞ্জে ভ্রমরা কুহরিছে পাপিয়া।’ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জীবদ্দশায় বহু গান লিখেছেন। তাঁর গানের কথায় মাধুর্য তুলে ধরতে বহু পাখির নাম উল্লেখ করেছেন। সেই সব পাখিদের মধ্যে পাপিয়া নামটি বহু গানে ব্যবহারও করেছেন।
বহুদিন ধরেই চেষ্টায় ছিলাম কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘পাপিয়া’ পাখির ছবি তোলার জন্য। অবশেষে পেয়েও গেলাম। দিনটি ছিল ২০২০ সালের ২৫ এপ্রিল। প্রতিদিনের মতো সেদিনও সকালে হাঁটতে বের হয়েছিলাম। আজিমপুর কবরস্থানের ভেতর দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ বড় একটা কড়ই গাছের দিকে নজর গেল। পাখিটা উড়ে এসে একটা ডালে বসলো। ৫ বছর আগে পাখিটির দেখা পেয়েছিলাম। কিন্তু ক্যামেরা সঙ্গে না থাকায় ছবি তুলতে পারিনি। সেদিন দেখার পর পাখিটির প্রেমে পড়ে যাই। মাথায় ঝুটি সংবলিত পাখিটির সৌন্দর্য যে কারো নজর কেড়ে নেবে। অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা পাখিটির ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।
সঙ্গে থাকা ক্যামেরা তাক করার আগেই উড়ে গিয়ে অন্য একটি গাছের ডালে বসলো। পখিটির পিছু নিলাম। নিজেকে আড়াল করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। একটি গাছের আড়ালে সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়ালাম। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালো আলো। আমি আলোর বিপরীতে আছি। এ অবস্থায় পাখির ছবি তুলতে গেলে ছবি কালো হবে। তাই মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ফিঙ্গে পাখির উপস্থিতিতে পাখিটি উড়ে আমার পেছনে একটি নিম গাছের ডালে বসলো। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে যা হয়। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরায় ফোকাস করে বেশ কয়েকটি ছবি নিলাম। মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় দিয়ে সে আবার উড়ে গেল! আর দেখা পেলাম না। সাদা বুক ও কালো পিঠের পাখিটি কোকিল প্রজাতির চাতক পাখি। আঞ্চলিক ভেদে পিউকাহা, পাপিয়া বা পাকড়া কোকিল নামে পরিচিত। পাখিটির ইংরেজি নাম Jacobin Cuckoo, Pied-crested Cuckoo বা Pied Cuckoo.
পাপিয়া Cuculidae গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Clamator গণের অন্তর্গত ৩৩ সেমি দৈর্ঘ্যের এবং ৬৫ গ্রাম ওজনের ঝুটিওয়ালা পাখি। এদের পিঠ কালো ও দেহের নিচের অংশ সাদা। ডানায় সাদা পট্টি আছে। লেজের পালকের আগা সাদা অংশ ওড়ার সময় নজর কেড়ে নেয়। চোখ বাদামী ও ঠোঁট কালো। পা ও পায়ের পাতা ধূসর ও নখ কালো। ঝুটি মাথার পেছনে ঝুলে থাকে। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারায় তফাৎ নেই। এরা ৩টি উপ-প্রজাতির। আমাদের দেশে Clamator Jacobinus pica উপ-প্রজাতিটি দেখা যায়।
পাপিয়া বন, আবাদি জমি, গাছপালায় পরিপূর্ণ এলাকা, বাগানে বিচরণ করে। সাধারণত একা বা জোড়ায় দেখা যায়। মাঝে মাঝে ৬-৮টি পাখির ছোট দলেও থাকতে দেখা যায়। ঘন পাতা ঘেরা গাছে, বনতলের গুল্মে, ঝোঁপে লুকিয়ে খাবার খায়। খাবারের মধ্যে শুঁয়োপোকা, পোকা, উইপোকা, পিঁপড়া ইত্যাদি এদের পছন্দ। এরা পরিযায়ী পাখি। পরিযায়ী পাখি পরিযায়নকালে বংশবৃদ্ধি করে না। কিন্তু পাপিয়া আমাদের দেশে পরিযায়ন কালে বংশবৃদ্ধি করে। অন্যান্য পরিযায়ী পাখি থেকে এরা ভিন্ন। এরা পরিযায়নকালে একই জায়গায় একই সময়ে বছরের পর বছর ফিরে আসে। জুন থেকে আগস্ট মাসে এরা প্রজনন করে।
প্রজননকালে পুরুষ পাখি পিউ-পিউ-পিইউ সুমধুর সুরে ডাকে। পুরুষের সুরেলা কণ্ঠে মেয়ে পাখি আকৃষ্ট হয়ে জোড়া বাঁধে। কোকিলের মতো এরাও বাসা তৈরি, ডিমে তা ও ছানাদের পরিচর্যা করে না। ছোট পাখি বা ছাতারে পাখির বাসায় মেয়ে পাখি একটি ডিম দিয়ে উধাও হয়ে যায়। ছাতারের ডিমের রঙের সঙ্গে মিল থাকায় পালকমাতার ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোঁটায়। ছাতারের ছানাদের সঙ্গে পাপিয়ার ছানা দিনে দিনে বড় হয়ে একদিন বাসা ছেড়ে উড়ে চলে যায়।
পাপিয়া বাংলাদেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি। গ্রীষ্মকালে দেশের সব গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়। শীতকালে পূর্ব আফ্রিকায় থাকে। আফ্রিকার অধিকাংশ অঞ্চল ও দক্ষিণ এশিয়ায় এদের বিস্তৃতি রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়া মহাদেশের পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ইরান, আফগানিস্তান ও মিয়ানমারে পাওয়া যায়। পাপিয়া বিশ্বে ও বাংলাদেশে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বণ্যপ্রাণী আইনে এই পাখি সংরক্ষিত।
বাংলা নামঃ পিউকাহা, পাপিয়া বা পাকড়া কোকিল
ইংরেজী নামঃ Jacobin Cuckoo, Pied-crested Cuckoo বা Pied Cuckoo.
বৈজ্ঞানিক নামঃ Clamator jacobinus (Boddaert, 1783)
ছবিটি ঢাকা থেকে তোলা।
১৭টি মন্তব্য
ইঞ্জা
সত্যি অনন্য অসাধারণ এক পাখি সম্পর্কে জানলাম, পাপিয়া শব্দটি অনেক শুনলেও আপনার মাধ্যমে এই প্রথম দেখলাম এবং জানলাম তাকে, সত্যি প্রেমে পরার মতোই সে।
ধন্যবাস ভাই আমাদের চোখকে, মনকে মুগ্ধ করার জন।
শামীম চৌধুরী
লেখাটি পড়ার জন্য কৃতার্থ রইলাম। শুভ কামনা রইলো।
ইঞ্জা
ভালোবাসা অফুরান ভাই।
পপি তালুকদার
সত্যিই পাখিটি দারুন সুন্দর। পাপিয়া পাখির নামের সাথে তো অনেক আগ থেকে পরিচিত কিন্তু আজ প্রথম বিস্তারিত জেনে ভালো লাগছে।আপনার কাছে মৌটুসী পাখির ছবি থাকলে একটু দেখাবেন।
শামীম চৌধুরী
আমাদের দেশে ৬ প্রজাতির মৌটুসী দেখা যায়। সবগুলোরই ছবি তোলা আছে। জ্বি আপু, দেখাবো। তাছাড়া Crimson sunbird বা সিঁদুরে মৌটুসী নিয়ে ব্লগে লিখেছি। আর আপনি আমার ফেসবুকে যুক্ত নন। তাহলে মেসেঞ্জারে সবগুলোর ছবি দিতে পারতাম। শুভ কামনা রইলো আপু।
পপি তালুকদার
ID কি নামে আছে? পাখির সাথে পরিচিত হতে চাই তাই ছবি দেখতে আগ্রহী।
শামীম চৌধুরী
Shameem Ali Chowdhury
https://www.facebook.com/amimdip0/
সুপর্ণা ফাল্গুনী
এ পাখির প্রেমে পড়তে সবাই বাধ্য। এতো দিন শুধু নাম ই শুনেছি নজরুলের গানে আজ আপনি দেখার সুযোগ করে দিলেন। চমৎকার ভাইয়া। অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই আমাদের কে দেখা ও জানানোর সুযোগ করে দেবার জন্য। একরাশ শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো । শুভ রাত্রি
শামীম চৌধুরী
আপনার জন্যও শুভ কামনা রইলো দিদিভাই।শুভ সকাল। ভালো থাকুন।
আরজু মুক্তা
পিউ কাহা বলে ডাকে পাখি।
এই সেই পাখি। দেখে মন জুড়ালো।
শামীম চৌধুরী
জ্বি মুক্তা আপু, এই সেই গীতিকারের পিউকাহা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
পিউকাহা শুনেছি কিন্তু দেখা হয়নি। হয়ত আপনার মত পাখি প্রেম নেই বলে! সত্যি আপনি একজন অসাধারণ পাখি প্রেমিক একেবারে কবিতার লাইনগুলোর মতই।
শুভ কামনা ভাই।
শামীম চৌধুরী
অনেক অনেক ভালো থাকুন আপু। আপনার জন্যও রইলো শুভকামনা।
তৌহিদ
শিরোনাম দেখে ভাবলাম এ কোন পাপিয়া!! পরে লেখা পড়ে দেখি এ পাপিয়া সেই পাপিয়া নয়, এতো পাখি ভাইয়ের পাখি পাপিয়া!!
পাপিয়া দেখতেও কিন্তু দারুণ সুন্দর! লেখা পড়ে পাপিয়া সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম ভাই। শুভকামনা।
শামীম চৌধুরী
অনেক ধন্যবাদ ভাই সময় নিয়ে লেখাটা পড়ার জন্য।
তৌহিদ
আপনার লেখা সবসময়ই মুগ্ধকর অনুভূতি দেয় আমাকে ভাই।
শামীম চৌধুরী
খুব খুশি হলাম ভাইয়া।